ছবি ‘গুমনামী’।
ছবি: ‘গুমনামী’
অভিনয়: প্রসেনজিৎ, অনির্বাণ, তনুশ্রী প্রমুখ
পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
নেতাজি সুভাষ কি সত্যিই ১৯৪৫-এর ১৮ অগস্ট প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন? বছরের পর বছরএই তথ্য, বিতর্ক ও তার সঙ্গে তীব্র আবেগ তোলপাড় করেছে ভারতবাসীর মননকে।
বেঙ্কটেশ ফিল্মসের প্রযোজনায় সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ফিল্ম ‘গুমনামী’ জমাট বেঁধে থাকা সেই আবেগের স্তরকে ঝাঁকুনি দিয়ে গেল। ফিল্মটির কাহিনি এবং সংলাপ রচনা সৃজিতের। নেতাজির মৃত্যু বা অন্তর্ধান নিয়ে যে রহস্য পুঞ্জীভূত হয়েছিল, তার সমাধানে বিভিন্ন সময়েগঠন করা হয়েছিল তিনটি কমিশন— শাহনওয়াজ(১৯৫৬), খোসলা (১৯৭০) এবং মুখার্জি(১৯৯৯)। এই তিনটি কমিশনের তথ্য এ ছবিতে ঘুরেফিরে এসেছে বারে বারে। অসম্ভব পরিশ্রম রয়েছে ছবিটির প্রতি পরতে।
ফিল্মটি শুরু হচ্ছে, সুভাষ দেখা করতে গিয়েছেন মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে, উপস্থিত নেহরু।স্বাধীনতা প্রায় আগত। গাঁধীজি অহিংস নীতিতেই স্থির থাকতে চান। কিন্তুসুভাষচন্দ্র মনে করেন সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া স্বাধীনতা সম্ভব নয়। তাই তিনি বিদায় নিতে চান।
কাহিনিমোড় নিয়ে এসে দাঁড়ায় রিপোর্টার চন্দ্রচূড়ের কাছে। নেতাজির রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হল তাকে। চন্দ্রচূড় কিন্তু অন্যদের মতো নেতাজি আবেগে ভেসে যাওয়া মানুষ নয়। তবু কাজের চ্যালেঞ্জে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পর্দায় দেখছি, নেতাজি সংক্রান্ত অসংখ্য বই, বাস্তবিকই সে সম্পূর্ণ ডুবে গেলএই অ্যাসাইনমেন্টে। কখন যেন মহাজীবন এসে হাত ধরল জীবনের! সূত্রধর চন্দ্রচূড়, দর্শক এগিয়ে চলেছে এক গভীর রহস্যময় ছায়াপথ ধরে।যেখানে প্রবল এক পুরুষকে দেখছি যাবতীয় অসম্ভবকে নস্যাৎ করে এগিয়ে চলেছেন স্বাধীনতা অর্জনের দিকে। কখনও মিত্র শক্তির সঙ্গে বৈঠক, কখনও আজাদ হিন্দ ফৌজ। অবশেষে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় আগুনে ঝলসে মৃত্যু অথবা মৃত্যু নয়।
আরও পড়ুন-‘প্যারিস ফ্যাশন উইক’-এ ঐশ্বর্যার ‘অভিনব’ সাজ! রোষের মুখে আয়োজক সংস্থা
নেতাজির ভূমিকায় প্রসেনজিৎ
ইতিহাস নয়, ইতিহাসের ছায়ায় ঘটে যাওয়া ঘটনা। সাংবাদিক চন্দ্রচূড় দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে চলে, নিশানা তার এন্ডিং পয়েন্ট। নেতাজি কি সত্যিই বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন? তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানাতে দেরি, মৃত্যু পরবর্তী শেষ কাজের কোনও ছবি নেই। চন্দ্রচূড়ের অনুসন্ধান ঘটনা ক্রমান্বয়িত হয়ে এগিয়ে চলে। দর্শক বুঁদ হয়ে থাকে রহস্যে, টানটান উত্তেজনায় শিরদাঁড়া স্থির।
তাহলে ফৈজাবাদে দেখা ভগবানজি আসলে কে? নেতাজি কি সত্যিই রাশিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন আর তাঁর মৃত্যু সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সবই এক কূটনৈতিক চাল?
দর্শকের চোখ নিবিষ্ট হয়ে থাকছে পর্দায়। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা সেই সন্ন্যাসী,তাঁর গলার স্বর নেতাজির মতো। পর্দার আড়াল থেকে তিনি কথা বলেন সুভাষচন্দ্রের কাছের মানুষজনদের সঙ্গে। তারা শিহরিত হয়, কারণ নেতাজির সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা উঠে আসে সেই আলাপচারিতায়। তাহলে কি ইনিই সুভাষ? না, তা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়।
জীবনের নাম চন্দ্রচূড়... আপ্রাণ পা চালায় সে এক মহৎ দুর্দমনীয় জীবনের ঘনীভূত রহস্যের অন্দরে।চন্দ্রচূড়ের চোখে নেতাজির মতো চশমা, সমস্ত ধ্যানজ্ঞান নেতাজির অন্তর্ধান।
ছবি কোনও সময় সাদা-কালো, কখনও রঙিন। কোনও সময় ১৯৪৫, পর্দা জুড়ে একটু অন্যরকম প্রকৃতি, নেতাজির চলার পথ, মহাত্মা গাঁধী, পণ্ডিত নেহরু।কখনও ১৯৮৫, সাধুবাবা, তাঁর নিভৃত আস্তানা। আবার কখনও ১৯৯৯, মিশন নেতাজি গ্রুপ, চন্দ্রচূড়েরবিভিন্ন যুক্তি, তর্কবিতর্ক।
আরও পড়ুন-এ কী হাল হয়েছে বাহুবলীর বল্লালদেবের! দুশ্চিন্তায় ডাগ্গুবতীর ফ্যানেরা
নেতাজি এবং পর্দার আড়ালে থাকা সাধুজির ভূমিকায় প্রসেনজিত অনবদ্য। চন্দ্রচূড়ের ভূমিকায় অনির্বাণ অসম্ভব ভাল। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। দৃশ্য এবং ঘটনা অনুযায়ী চিরাচরিত কিছু গান ব্যবহার হয়েছে, যা মন ছুঁয়ে যায়। গান গেয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়, সোনু নিগম এবং ঈশান মিত্র। সবশেষে ব্যবহার করা হয়েছে ‘জনগণমন’, যা এক অসাধারণ মূর্ছনা সৃষ্টি করে।
পরিচালক সৃজিতের মেধা এবং শিল্পভাবনার অপূর্বতা ছাপ রেখে গিয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে।