ফিল্ম ‘কর্জ’-এ জেনেশুনে গাড়ির ধাক্কা খেয়েছিলেন। ‘কসমে ওয়াদে’-তে ঝোপের মধ্যে দৌড়তে গিয়ে পা পিছলে পড়ে হাত ভেঙে যায়। সবচেয়ে কঠিন এবং জনপ্রিয় ‘শোলে’-তে হেমা মালিনীর ঘোড়ার গাড়ি ছোটানোর সময় চাকা ভেঙে যাওয়ার দৃশ্য।
বলিউড ফিল্মের সমস্ত বিপজ্জনক দৃশ্যের পিছনে লুকিয়ে থাকে অন্য মুখ। পর্দায় যাঁদের দেখা যায় না। কিন্তু সেই মানুষগুলোই জীবন বাজি রেখে ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যগুলোকে নিখুঁত করে তোলেন।
তেমনই একজন রেশমা পাঠান। ‘শোলে গার্ল’ হিসাবে পরিচিত রেশমাই বলিউডের প্রথম স্টান্ট ওম্যান। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা রেশমার কাহিনি কোনও বলিউড ফিল্মের থেকে কম নয়। গুজরাতের গলি থেকে ‘শোলে গার্ল’ হয়ে ওঠার জন্য নানা বাধা পেরোতে হয়েছে তাঁকে।
রেশমার জন্ম গুজরাতে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তাঁর মা-বাবা চাল চুরি করে দিন কাটাতেন। সেটাই ছিল তাঁদের জীবিকা।
রেশমার বয়স যখন মাত্র ৯ বছর, তখন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন তাঁর মা। বাবার শরীরও ভাল ছিল না। ৪ ভাইবোনের মধ্যে রেশমাই ছিলেন সবচেয়ে বড়। বড় বোন হিসাবে সংসার চালানোর ভার এসে পড়ে তাঁর উপর।
জেলবন্দি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে প্রথম প্রথম লুকিয়ে অন্য বন্দিদের কাছে বাইরে থেকে বিড়ির প্যাকেট পৌঁছে দিয়ে উপার্জন করতে শুরু করেন রেশমা। কিন্তু সেই টাকায় সংসার চলত না।
নিজের জীবন বাজি রাখা শুরু তখন থেকেই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সির উপর থেকে ডিগবাজি খেয়ে রাস্তায় পড়তেন সাহসী রেশমা আর চারপাশের ভিড় থেকে টাকা উড়ে আসত তাঁর দিকে।
এ ভাবেই দিন কাটতে শুরু করে তাঁর। একদিন তাঁর ডিগবাজি নজরে পড়ে যায় বলিউডের এক স্টান্টম্যানের। রেশমা তখন ১৪ বছরের মেয়ে। তাঁকে ট্যাক্সির ছাদ থেকে ডিগবাজি খেতে দেখে ফেলেন আজিম নামে এক স্টান্টম্যান।
রেশমাকে বলিউডে আসার প্রস্তাব দেন তিনি। সে সময় বলিউডকে খুব ভালচোখে দেখতেন না বেশিরভাগ মানুষ। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা তো ভাবতেই পারতেন না ফিল্মে কাজ করার কথা। রেশমা বাড়িতে গিয়ে বিষয়টি জানাতেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা।
উপার্জন করতে গিয়ে যদি মেয়ের বিপদ হয়? একেবারেই মানতে পারছিলেন না রেশমার বাবা। তার উপর সমাজের চাপ তো ছিলই। সমস্ত বাধা পেরিয়েই বলিউডে পা রাখেন রেশমা।
তাঁর প্রথম স্টান্ট ১৯৭২-এর ফিল্ম ‘এক খিলাড়ি বাওয়ান পাত্তে’-তে। প্রতিদিন ১৭৫ টাকা করে পারিশ্রমিক পাবেন এমনটাই স্থির হয়েছিল। কিন্তু প্রথমদিন হাতে পান মাত্র ১০০ টাকা। বাকি টাকা তাঁকে দেওয়া হয়নি। রেশমা বুঝে গিয়েছিলেন প্রতিবাদ করে কোনও লাভ নেই। এই ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে গেলে এটা তাঁকে মেনে নিতে হবে।
এরপর ওয়াহিদা রহমান, রেখা, হেমা মালিনী, শ্রীদেবী, ডিম্পল কাপাডিয়া, মীনাক্ষী শেষাদ্রির মতো তখনকার প্রায় সমস্ত হিট নায়িকার জন্য ফিল্মে নিজের জীবন বাজি রেখেছেন রেশমা।
তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় স্টান্ট মাইলস্টোন ফিল্ম ‘শোলে’-তে বসন্তীর ঘোড়ার গাড়ির ছুট। রামগড়ের পাহাড়ি রাস্তায় ডাকাতদের তাড়া খেয়ে নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে মরিয়া বসন্তী তাঁর ঘোড়ার গাড়ি ছুটিয়েছিলেন। সেই জনপ্রিয় দৃশ্যের পিছনে অবদান রেশমারই।
ওই দৃশ্য শ্যুট করতে গিয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছিল রেশমার। প্রথমবার চাকা ভেঙে ঘোড়ার গাড়িটি উল্টে যায়। গাড়ি থেকে ছিটকে পড়েন রেশমা। গাড়িটি গিয়ে পড়ে তাঁর পায়ের উপর। সেই জখম অবস্থাতেও শ্যুট করেন তিনি।
১৯৮০ সালের ফিল্ম ‘কর্জ’-এ অভিনেত্রী দুর্গা খোটের হয়ে তাঁকে গাড়ির ধাক্কা খেতে হয়েছে। পরিচালকের নির্দেশ মেনে তাঁর পিঠে এমন ভাবেই গাড়ি ধাক্কা দিয়েছিল, যে রাস্তায় ছিটকে পড়েছিলেন রেশমা। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল।
রেশমা জীবন বাজি রেখেছিলেন ঠিকই। কিন্তু বিনিময়ে সংসারে সুখ ফিরে এসেছিল তাঁর। ১৯৮০ সালে তিনি স্টান্ট ডিরেক্টর শকুর পঠানকে বিয়ে করেন। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু বিয়ের ৪ বছর পর জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন রেশমা।
ফিল্মে ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্য ১৯৮৪ সালে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। রেশমা এবং তাঁর স্বামী দুজনেই কাজ হারান।
রেশমার উপর তখন তাঁর বোনের ২ ছেলে এবং নিজের ১ সন্তানের দায়িত্ব। জমানো টাকা আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসে। একটা সময় এমন গিয়েছে, যে একবেলা খাবারের টাকাও ছিল না তাঁদের কাছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজে ঘর থেকে ১,৬০০ টাকা পেয়েছিলেন রেশমা। খুশিতে কেঁদে ফেলেছিলেন। একবার এক সাক্ষাৎকারে রেশমা নিজেই এ কথা জানিয়েছিলেন।
পরে অবশ্য দুর্দশা তাঁদের কেটে যায়। বোনের ২ ছেলে এবং নিজের ছেলেও পড়াশোনা শিখে প্রতিষ্ঠিত হন। রেশমার বোনের ২ ছেলের একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন এক গাড়িপ্রস্তুত কোম্পানির ম্যানেজার। আর রেশমার ছেলে চিকিৎসক।
২০১৯-এর ফিল্ম ‘দ্য শোলে গার্ল’ রেশমারই বায়োপিক। ওই ফিল্মে তাঁর ভূমিকায় দেখা গিয়েছে অভিনেত্রী বিনিতা বাগকে।