ছোটবেলায় দেখতেন তাঁদের বাড়িতে এলে বাবা পা থেকে জুতো খোলেন না। মা এবং তাঁদের দুই ভাইয়ের কাছে বাবা বেশি ক্ষণ থাকতেনও না। আসার পর থেকেই যেন যাওয়ার তাড়া থাকত। মা বলতেন, তাঁর বাবার অন্য সংসার আছে।
সে কথার অর্থ তখন বোধগম্য হত না। কৈশোরে পৌঁছে জানতে পেরেছিলেন, তাঁর বাবা মায়ের মধ্যে বিবাহিত সম্পর্ক ছিল না। নিজেকে ‘লভ চাইল্ড’ বলতে কোনও কুণ্ঠা কোনও দিনই নেই মহেশ ভট্টের।
তাঁর বাবা নানাভাই ভট্ট ছিলেন হিন্দি সিনেমার নামী পরিচালক ও প্রযোজক। স্ত্রী হেমলতা ও সন্তানদের নিয়ে তাঁর বড় পরিবার। কিন্তু নানাভাই কোনও দিন শিরিন মহম্মদ আলির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অস্বীকার করেননি। শিরিনকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেননি। কিন্তু শিরিন এবং তাঁদের সন্তানদের প্রতি কর্তব্য পালন করে গিয়েছেন বরাবর।
তাঁকেও বাবার পাশে দাঁড়াতে হবে, বলে দিয়েছিলেন মা। স্কুলজীবন থেকেই ছোটখাটো কাজ করতে শুরু করেন মহেশ। জীবনে সংগ্রামের পাশাপাশি এসেছিল প্রেমও। লোরেন ব্রাইট নামে এক কিশোরী পড়তেন মুম্বইয়ের এক অনাথাশ্রমের স্কুলে। পাঁচিল ডিঙিয়ে প্রেয়সী লোরেনের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন ডন বসকো স্কুলের ছাত্র মহেশ।
এক দিন ধরা পড়ে গেলেন। অনাথাশ্রমের স্কুল থেকে নাম কাটা গেল লোরেনের। মহেশের চেষ্টায় অন্য একটি সংস্থা থেকে পড়াশোনা শেষ করে টাইপিস্টের চাকরি পেলেন লোরেন। তত দিনে মহেশ বিজ্ঞাপন তৈরির কাজ শুরু করেছেন।
কুড়িতে পৌঁছে বিয়ে করে ফেললেন প্রেমিকাকে। লোরেন তখন নাম পাল্টে কিরণ ভট্ট। একুশে পা দিয়ে মহেশ প্রথম পিতৃত্বের স্বাদ পেলেন। মেয়ের নাম রাখলেন পূজা।
কিন্তু বিজ্ঞাপন তৈরির উপার্জনে সংসার তখন আর চলতে চায় না। মহেশ গেলেন পরিচালক রাজ খোসলার কাছে। কাজ শুরু করলেন সহকারী পরিচালক হিসেবে। কিন্তু পর পর ব্যর্থ হল প্রথম দিকের ছবিগুলি। সংসারেও তখন লোরেনের সঙ্গে তিক্ততা। দু’জনের দূরত্ব বেড়ে গেল পরভিন ববির আগমনে।
মানসিক অস্থিরতার শিকার পরভিন আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন মহেশের মধ্যে। তাঁদের দুরন্ত প্রেমপর্বের কথা লুকিয়ে রাখেননি দু’জনের কেউই। কিন্তু এর পরিণাম ছিল ভয়ঙ্কর। পরভিন আরও ডুবে যান মানসিক রোগে। মহেশ নিষ্কৃতি খুঁজেছিলেন মাদকে। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা।
১৯৭৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল মহেশের প্রথম ছবি ‘মঞ্জিলেঁ অউর ভি হ্যায়’। এর পর ‘নয়া দৌড়’, ‘লহু কে দো রং’ ছবির সাহায্যে ধীরে ধীরে বলিউডে নিজের জায়গা মজবুত করছিলেন মহেশ।
১৯৮২ সালে মুক্তি পেল তাঁর ছবি ‘অর্থ’। শুধু ছবি নয়, এ তাঁর জীবনের একাংশ। তাঁর জীবনের ত্রিকোণ প্রেম তিনি তুলে ধরেছিলেন শাবানা আজমি, স্মিতা পাতিল, কুলভূষণ খরবান্দা অভিনীত এই ছবিতে।
নিজের জীবন অবশ্য এর পরেও এসেছে তাঁর ছবির উপজীব্য হয়ে। ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আশিকি’ ছিল তাঁর এবং কিরণের দুরন্ত প্রেম। প্রথম স্ত্রী কিরণের কাছে পরে ফিরে গিয়েছিলেন মহেশ। পরভিনের সঙ্গে প্রেম ভেঙে যাওয়ার পরে, ‘অর্থ’ সফল হওয়ার সময়ে মহেশ চেয়েছিলেন কিরণের সঙ্গে নতুন করে জীবনটাকে শুরু করতে।
কয়েক বছর সংসার করলেন মহেশ-কিরণ। জন্ম হল তাঁদের ছেলে রাহুলের। কিন্তু আবার অন্য নারীর কাছে আত্মসমর্পণ করে বসলেন। এ বার মহেশ বিয়ে করলেন টেলিভিশনের অভিনেত্রী সোনি রাজদানকে। তবে কিরণের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদও কোনও দিন হয়নি।
স্বজনপোষণের কাঠগড়ায় ইদানীং অন্যতম নাম মহেশ ভট্ট। প্রথম স্ত্রী কিরণের সঙ্গে তাঁর দুই সন্তান পূজা ও রাহুল দু’জনেই অভিনেতা। তবে দিদি পূজা ভট্টের মতো বিখ্যাত হতে পারেননি রাহুল। মহেশের দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান আলিয়া তো এখন বলিউডের প্রথম সারির নায়িকা। আর এক মেয়ে শাহিনও ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত।
শোনা যায় নিজের তিন মেয়ে এবং এক ছেলেকে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টার খামতি রাখেননি মহেশ। সাহায্য করেছেন পরিবারের অন্য সদস্যদেরও। মহেশের মাসতুতো ভাইয়ের ছেলে হলেন ইমরান হাশমী। পাশাপাশি নানাভাই ভট্টের সূত্রে মোহিত সুরী মহেশের আত্মীয়। তাঁদেরও বলিউডের ভিত মজবুত করতে সাহায্য করেছেন মহেশ। কান পাতলে এখন ইন্ডাস্ট্রি সরগরম এই গুঞ্জনেই।
মহেশের হাত ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে পরিচিতি পেয়েছেন বা অন্যদের প্রতিযোগিতায় পিছনে ফেলে দিয়েছেন, এমন স্টারকিডও কম নেই। আমির খান, সঞ্জয় দত্ত, কুমার গৌরবের মতো তারকাপুত্রদের কেরিয়ারের প্রথম দিকে সুপারহিট সিনেমা এসেছে মহেশের হাত ধরেই।
তাঁর দীর্ঘ পরিচালক জীবনে উল্লেখযোগ্য ছবি অনেক। ‘সারাংশ’, ‘ঠিকানা’, ‘ড্যাডি’, ‘দিল হ্যায় কে মানতা নেহি’, ‘সড়ক’, ‘জুনুন’, ‘স্যর’, ‘হম হে রাহী প্যায়ার কে’, ‘দ্য জেন্টলম্যান’, ‘দ্য ক্রিমিনাল’, ‘পাপা কহতে হ্যায়’, ‘দস্তক’, ‘ডুপ্লিকেট’, ‘দুশমন’, ‘জখম’, ‘রাজ’, ‘মার্ডার’, ‘জিসম’, ‘কলযুগ’, ‘গ্যাংস্টার’-এর মতো বক্স অফিস সফল ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি।
এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন নিজের জীবনে শ্মশানের শান্তির থেকে সমুদ্রের উথালপাথাল ঢেউ বেশি পছন্দ করেন। বইয়ের খোলা পাতার মতো পড়ে থাকা সে জীবনে বিতর্কের ঢেউ আছড়ে পড়েছে বার বার। মেয়ে পূজার সঙ্গে লিপলক কিস নিয়ে উত্তাল হয়েছে আলোচনা। হাল আমলে রিয়া চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠ পুরুষ হিসেবেও উঠে এসেছে তাঁরই নাম।
কোনও বিতর্কই রুদ্ধ করতে পারেনি তাঁর গতি। ছবি এবং ব্যক্তিগত জীবন, দুই দিকই এগিয়েছে তাঁর নিজের শর্তে। স্পষ্ট জানিয়েছেন, তিনি ছবি করেছেন অর্থ রোজগারের জন্য ।
স্কুলজীবনে যখন গাড়ির রিফ্রেশনার বেচতেন বা যন্ত্রাংশ সারাতেন, তখন থেকেই জানেন অর্থের মূল্য। প্রথম উপার্জনের ৫৩ টাকা তুলে দিয়েছিলেন মায়ের হাতে। যে মা তাঁর রিপোর্ট কার্ডে সই করতেন কাঁপা কাঁপা হাতে।
অসুস্থতা নয়। মহেশ পরে বুঝেছিলেন তাঁর মা নিজের অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগতেন। পরিচয়হীনতার দংশন পেরিয়ে যেতে পারেননি শিরিন। মহেশের সান্ত্বনা, তাঁর জন্য অন্ত কিছুটা হলেও আইনি পরিচিতি পেয়েছিলেন মা। নানাভাইয়ের জীবনে দ্বিতীয় নারী থেকে হয়ে উঠতে পেরেছিলেন ‘মহেশ ভট্টের মা’। তবে মায়ের মৃত্যুর সময়ে তাঁর কাছে থাকতে পারেননি, এই আক্ষেপ জীবনভর থেকে যাবে মহেশের সঙ্গে।
মা ছাড়া আরও এক জনকে নিজের জীবনের কান্ডারি বলে মনে করেন মহেশ ভট্ট। তিনি দার্শনিক ইউ সি কৃষ্ণমূর্তি। ঈশ্বরে অবিশ্বাসী মহেশ ব্যক্তিগত জীবনে কৃষ্ণমূর্তির একনিষ্ঠ ভক্ত।
মহেশ বলেন, কৃষ্ণমূর্তিকে সরিয়ে নিলে তিনি শূন্য। মা তাঁকে জন্ম দিয়েছেন। তবে কৃষ্ণমূর্তির জন্য তাঁর পুনর্জন্ম হয়েছে। দ্বিধাহীন কণ্ঠে জানান মহেশ।
স্রষ্টা হিসেবে বার বার নবজন্মে বিশ্বাসী মহেশের নিজের কাজের প্রতি কিন্তু অমরত্বের জন্য কোনও আসক্তি নেই। চান, পরবর্তী প্রজন্ম এসে পুরনো, বাতিল করে দিক তাঁকে। এটাই তাঁর জীবনের নিজস্ব গান। স্বজনপোষণ বিতর্কে আপাতত যা অনেকটাই বেসুরো।