জনপ্রিয়তায় একসময় একে অপরকে টেক্কা দিতেন তাঁরা। সেখান থেকেই বিবাদের সূত্রপাত। তার পর এক দশকের বেশি সময় কেটে গেলেও, এক সঙ্গে কাজ করা তো দূর, এখনও একে অপরের মুখ দেখেন না হিমেশ রেশমিয়া এবং সোনু নিগম। দু’জনেই বলিউডের নামজাদা সঙ্গীতশিল্পী। কিন্তু যে পেশার সঙ্গে যুক্ত তাঁরা, সেই সঙ্গীতও তাঁদের সম্পর্কের বরফ গলাতে পারেনি।
বয়সে একে অপরের পিঠোপিঠি হলেও, খুব কম বয়সে সঙ্গীতচর্চায় হাতেখড়ি হয় সোনু নিগমের। চার বছর বয়স থেকে বাবার সঙ্গে স্টেজে পারফর্ম করতেন সোনু। সেই তুলনায় খানিকটা দেরি করেই সঙ্গীতের দুনিয়ায় পা রাখেন হিমেশ।
১৯৯০ সালে ‘জানম’ ছবিতে প্রথম প্লেব্যাকের সুযোগ পানম সোনু। সেই ছবি কখনও মুক্তি না পেলেও, তার পর রেডিয়ো এবং বিজ্ঞাপনে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। এর পর ১৯৯২ সালে ‘আজা মেরি জান’ ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পান তিনি। সেই বছরই তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘রফি কি ইয়াদে’ মুক্তি পায়।
এর পর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি সোনু নিগমকে। ‘মুকাবলা’, ‘বীরতা’, ‘মেহেরবান’, ‘শবনম’, ‘কসম তেরি কসম’, ‘আগ’, ‘খুদ্দার’, ‘হালচাল’, ‘জিত’-সহ একাধিক সুপারহিট ছবিতে গান গান তিনি। ‘১৯৪২: আ লভ স্টোরি’ ছবির বিখ্যাত ‘এক লড়কি কো দেখা তো’ গানটি সোনুকে দিয়ে গাওয়ানোর ইচ্ছা ছিল রাহুল দেববর্মণের। কিন্তু শেষমেশ কুমার শানুর গলায় বিখ্যাত হয়ে যায় গানটি।
এ রকম একাধিক কাজ হাতছাড়া হওয়ার পরও কুমার শানু, উদিত নারায়ণ, এসপি বালাসুব্রহ্মণ্যম-এ মতো প্রবাদপ্রতিম গায়কদের মধ্যে নিজের জায়গা তৈরি করতে পেরেছিলেন সোনু। ‘বেওয়াফা সনম’ ছবির ‘আচ্ছা সিলা দিয়া’ এবং ‘বর্ডার’ ছবির ‘সন্দেশে আতে হ্যায়’ গান দু’টি এত জনপ্রিয় হয় যে, রাতারাতি তারকা হয়ে যান সোনু। এর পর ‘দিল চাহতা হ্যায়’, ‘কাল হো না হো’-র মতো বিগ বাজেটের ছবি তাঁর ঝুলিতে ঢোকে।
কিন্তু সোনু যখন সাফল্যের স্বাদ পেতে শুরু করেছেন, সেই সময় বলিউডে পায়ের নীচে মাটি শক্ত করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন হিমেশ। তাঁর বাবা বিপিন রেশমিয়াও সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। সেই কারণে কম বয়সে হিমেশও সঙ্গীতে তালিম নেন। কিন্তু সঙ্গীতচর্চায় না গিয়ে শুরুতে টেলিভিশন সিরিজেই মন দেন তিনি।
২৬ বছর বয়সে ‘আন্দাজ’, ‘অহনা’, ‘আমন’, ‘আশিকি’, ‘অমর প্রেম’ এবং ‘জান’-এ মতো একাধিক টেলিভিশন সিরিজ প্রযোজনা করেন তিনি। এই টেলিভিশন সিরিজগুলির টাইটেল ট্র্যাক এবং ব্যাগগ্রাউন্ড স্কোর নিয়ে সেইসময় কাজ শুরু করেন তিনি।
নব্বইয়ের দশকে সলমন খানকে নিয়ে একটি ছবি তৈরি করার কথা ছিল হিমেশের বাবা বিপিন রেশমিয়ার। কোনও কারণে সেই ছবি হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সেখান থেকে হিমেশের সঙ্গে পরিচয় বাড়ে সলমনের। হিমেশের কাজ পছন্দ হয় সলমনের। তাই ১৯৯৮ সালে হিমেশকে ‘প্যায়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’ ছবিতে কাজ করার সুযোগ দেয় খান পরিবার।
ছবিতে সুরকার হিসেবে কাজ করেন হিমেশ। ‘প্যায়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’ টাইটেল ট্র্যাকটি এবং ‘তুম পর হম হ্যায় অটকে’, এই দু’টি গানই বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। সেখান থেকেই সুরকার হিসেবে যাত্রা শুরু হয় হিমেশের। এর পর সলমন খান অভিনীত ‘বন্ধন,’ ‘হ্যালো ব্রাদার’ ছবিতেও কাজ করার সুযোগ পান তিনি। কিন্তু ‘দুলহন হম লে জায়েঙ্গে’র মাধ্যমেই প্রথম একা একটা গোটা ছবির দায়িত্ব পান হিমেশ।
এর পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি হিমেশকে। ‘হমরাজ’, ‘তেরে নাম’, ‘ম্যায়নে প্যায়ার কিউঁ কিয়া’, ‘অ্যায়তরাজ’ ছবিতে তাঁর কাজ সুপারহিট হয়। সেই সময় হিমেশের সুরে একাধিক ছবিতে গান গাইতে দেখা যায় সোনু নিগমকেও। তাঁদের যুগলবন্দিতে ‘ছামিয়া’, ‘ধীরে ধীরে চলনা’, ‘তেরা পল্লু’, ‘জাস্ট চিল’, ‘সাজন তুমসে’-র মতো সুপারহিট গান পায় বলিউড।
কিন্তু ‘আশিক বনায়া আপনে’র সময় থেকেই ধীরে ধীরে প্লেব্যাকের দিকে ঝোঁকেন হিমেশ। শুরুতে ‘নাকি সুরে’ গান গাওয়ার জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে হিমেশের গান ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শুধু গানই নয়, হিমেশের চলাফেরা, তাঁর পোশাক, টুপি এ সবেরই অনুকরণ করতে শুরু করেন অনেকে। হিমেশের ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে তাঁকে নিয়ে ছবি পরিকল্পনা করতেও শুরু করে দেন প্রযোজক-পরিচালকরা।
২০০৬-’০৭ সালে গোটা দেশ যখন ‘হিমেশ ম্যানিয়া’য় ভুগছে, সেই সময়ই সোনু নিগমের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে ছেদ পড়ে। সেই সময় একটি সাক্ষাৎকারে সোনুর সঙ্গে তুলনা টানা হলে হিমেশ বলে বসেন, ‘‘সোনু নিগম কে? ও তো ছেটখাটো জায়গায় পারফর্ম করে। আমি রকস্টার। আমার গানে মাতোয়ারা সকলে। সোনুর সঙ্গে আমাকে তুলনা করবেন না। আমার কোনও কনসার্টে গেলেই বুঝতে পারবেন কে বেশি জনপ্রিয়।’’
সেই সময় হিমেশের এই মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন সোনু। তিনি পাল্টা বলেন, ‘‘হিমেশ পাগল হয়ে গিয়েছে। সাফল্য দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছে ওর। উপরের দিকে অনেকের জন্যই জায়গা রয়েছে। ওর সঙ্গে জায়গা ভাগাভাগি করে নিতে কোনও আপত্তি নেই আমার।’’ ছোট্ট বয়স থেকে ওস্তাদ গোলাম মোস্তাফা খানের কাছে হিন্দুস্তানি ক্লাসিক্যালের প্রশিক্ষণ নেওয়া সোনু হিমেশের গান গাওয়ার ধরন নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। এমনকি ইন্ডাস্ট্রিতে হিমেশের কোনও বন্ধু নেই বলেও দাবি করেন।
তার পর থেকেই আর একে অপরের সঙ্গে কাজ করতে দেখা যায়নি হিমেশ ও সোনুকে। কয়েক বছর আগে সেই নিয়ে হিমেশকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘‘দেশের অন্যতম সেরা গায়কদের মধ্যে এক জন সোনু। তবে আগের চেয়ে এখন প্রতিযোগিতা বেড়ে গিয়েছে। ১০ বছর আগে এত গায়ক ছিল না। তাই সেই সময় সোনু কী বলেছিল, তা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাই না আমি।’’
টুইটারে সোনুকে ট্যাগ করে হিমেশের সেই বক্তব্যটি পোস্ট করেন এক সাংবাদিক। তাতে বেজায় চটে যান সোনু। ওই সাংবাদিককে রীতিমতো শাসানি দেন তিনি। পরবর্তী কালে এই ধরনের কাজ করার আগে দু’বার ভাবা উচিত বলে ওই সাংবাদিককে হুঁশিয়ারিও দেন। সেই থেকে একে অপরের মুখোমুখি হননি হিমেশ ও সোনু।