প্রথম জনের পেডার রোডের বাড়িতে ফুল, কেক আর বার্থ ডে কার্ড ঢুকতে আর ঠিক দশ দিন। সে দিন তিনি পঁচাশি। বহু বছর হল মোটামুটি বাড়িতেই থাকেন। সুচিত্রা সেনের মতো পর্দাশিন না হলেও বিশ্বজগতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ রাখার জন্য রয়েছে বাড়ির তিনটে ল্যান্ডলাইন ফোন।
দ্বিতীয় জন দক্ষিণ মুম্বইয়ের প্রভাকুঞ্জে আটকে নেই। বরঞ্চ মেয়ের অকস্মাত্ মৃত্যুর পর যেন আরও বেশি করে বহির্মুখী। আজ মুম্বইতে তিন ঘণ্টার শো, স্টেজে উঠে নাচ-গান, তো পরের দিন ভোরে উঠেই কলকাতা। সেখানে নতুন সিডি প্রকাশ আর সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে আবার পরের দিন বাড়িতে। দু’দিনের মধ্যে রোমের ফ্লাইট। কে বলবে মাত্র দশদিন আগে তাঁর যে একাশি পূর্ণ হল!
প্রথম জন জানতেন ছোটবোনের এই ক’দিনের কর্মসূচি। খুব ভালই জানতেন। জানতেন যে, তিনি সম্মুখানন্দ হলে কতক্ষণের প্রোগ্রাম করেছেন। তারপর কখন কলকাতা থেকে ফিরবেন। কী সিডি করছেন।
দ্বিতীয় জন একেবারেই জানতেন না তাঁর ভারতবিখ্যাত দিদি যে মাত্র কয়েক দিন আগে চারবাংলার কাছে নিজের মিউজিক স্টুডিয়োতে গিয়ে নতুন সিডি রেকর্ড করেছেন। শুনে অবাকই হলেন দিদি, যে এত বছর বাদে পুজোর গান করছেন আর সেটা রেকর্ড অবধি করা হয়ে গিয়েছে।
প্রথম জন লতা মঙ্গেশকর। দ্বিতীয় জন আশা ভোঁসলে।
কোনও হিসেব কষে ডিজাইনমাফিক হয়তো এটা ঘটেনি। হতেই পারে সম্পূর্ণ কাকতালীয়। কিন্তু বাঙালিজীবনের সবচেয়ে বড় উত্সবে তাঁরা আবার মুখোমুখি! লতা দীর্ঘ আঠাশ বছর বাদে সলিল চৌধুরীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর পুজোর নতুন অ্যালবাম করে ফেলেছেন। এমনকী তার ভিডিয়ো অবধি শু্যট করেছেন। আশা রিমিক্স করেছেন আরডি বর্মনের কালজয়ী সব পুরনো গান। অ্যালবামের নাম ‘পঞ্চম তুমি কোথায়’।
পেডার রোডের বহুখ্যাত বাড়িতে বসে লতা বলছিলেন, “সলিলদা আমার খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। পুজোতে প্রতিবছর আমি ওঁর হয়ে গাইতাম। প্রথম যখন বিমল রায়ের স্টুডিয়োতে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়, আমাকে নিয়ে গেলেন ওঁর আন্ধেরির বাড়িতে। বৌদি ছিলেন। মেয়ে ছিল। আমাকে বললেন, ‘তুমি বাংলায় আমার জন্য গাও।’ গাইলাম দু’টো গান। ‘না যেও না’ আর ‘সাতভাই চম্পা’। দু’টো গানই সুপারহিট হয়ে গেল।”
কলকাতায় বসা আশা ভোঁসলেও স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ছেন। “পঞ্চম ছিল একজন জিনিয়াস। ওর গানগুলো বাঙালির নাড়িতে এমন ঢুকে গিয়েছে যে জানি না ওরা আমার গলায় কী ভাবে নেবে।” তাঁর অ্যালবামে যে পঞ্চমের সেই ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ তো প্রতিটি বাঙালি পুরুষের গান। প্রায় প্রত্যেকেই নিজের নিজের পাড়ায় কোনও না কোনও বাল্যপ্রেমিকাকে সেটা উত্সর্গ করেছে। শুনে আশা বলেন, “পঞ্চমও তো তাই।”
লতা মঙ্গেশকরের শারদার্ঘ্যের নাম ‘সুরধ্বনী’। সঙ্গীত পরিচালনা করছেন লতারই নিজস্ব এল এম মিউজিক কোম্পানির কর্তা ময়ূরেশ পাই। ময়ুরেশ আবার প্রতিভাবান সঙ্গীত পরিচালক। এই অ্যালবাম নিয়ে তাঁরও অনেক স্বপ্ন। লতা বলছিলেন, “সলিলদার লেখা এমন একটা গান উদ্ধার করেছি যা এর আগে কেউ গায়নি।” গানের লাইনগুলো নিজেই পড়ে শোনাচ্ছেন ছিয়াশি বছরের কোকিলকণ্ঠী।
আজকাল আমি আর মন দিয়ে
ভাবি না তো
সুর দিয়ে ভাবি
সুর ভাবা স্থির করে পর্দা দিয়ে বলি...
অ্যালবামে কলকাতার ব্যাঙ্ক অফিসার দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীর লেখা দু’টো গানও গেয়েছেন লতা। দেবপ্রসাদ এর আগে মান্না দে-র শেষ জীবনের বেশ কয়েক বছর টানা তাঁর জন্য গান লিখেছেন। লতা বলছিলেন, “দেবপ্রসাদ ভাল লেখেন। ওঁর লেখার মধ্যে একটা কবিতার সুর রয়েছে যেটা আমায় টেনেছে।” দেবপ্রসাদের লেখা একটা গানের সঙ্গীতপরিচালক আনন্দঘন।
এই ‘আনন্দঘন’ আবার কে? কোনও ছদ্মনাম? এর আড়ালে কে? জানা গেল, স্বয়ং লতা। তিনি বেশ কিছু মরাঠি ছবিতে নাকি এই ছদ্মনামে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। সে সব অনেক পুরনো কথা। কিন্তু আজ সলিল চৌধুরীকে শ্রদ্ধা জানাবেন বলে নিজে গাওয়া ছাড়াও পরিচালনাতেও সম্মত প্রভাকুঞ্জের কর্ত্রী।
দুই বোনের পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাত্কার
আশা ভোঁসলে - শুক্রবার
লতা মঙ্গেশকর - সোমবার
কোথাও যেন তাঁর চিরআক্ষেপ থেকে গিয়েছে ১৯৯৫-তে সলিল চৌধুরীর মৃত্যুর সময়ে তিনি পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারেননি। পারিবারিক মৃত্যু তাঁকে সেই সময় মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন রেখেছিল। মধ্য-আশিতে এই উদ্যোগ যেন মুষড়ে থাকা আবেগের ভাঁজগুলো হঠাত্ খুলে গিয়ে তার সরব আত্মপ্রকাশ।
আরডি স্মরণে আশাও কি তাই? নইলে স্বীকারই করছেন, এই মধ্য একাশিতেও তাঁর স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসেন আরডি। ঘুম ভেঙে তাঁর মনে হয়, আরডি তাঁর সময়ের অনেক আগে চলে এসেছিলেন! আজ ফিল্মি গানবাজনা যা হচ্ছে সব আরডি-র মডেলে হচ্ছে।
তা হলে কি মুখোমুখি নয়? বাঙালির দুই সর্বকালীন সঙ্গীত-আইকনদ্বয়কে মরাঠি দুই বোনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
নামটাই তাঁদের এত ভারী ভারী। লতা আর আশা। আসলে একই সঙ্গে পুজোর লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁরা। মুখোমুখি নন।
যাঁর যাঁর অঞ্জলিতে ব্যস্ত।