সময়ও আজ অশ্রুসজল। এ বিদায় বড় কঠিন বিদায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
সারি সারি গানের দল এসে নীরবে দাঁড়িয়েছে সেই নদীর পাড়ে, যে নদীর পাড়ে তারা শোক ও শ্রদ্ধায় বিদায় জানাবে তাদের উজ্জ্বলতম সঙ্গী ও সাথীটিকে। পথ পেরিয়ে নদী, নদী পেরিয়ে আগামীর আলোকবর্ষে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে আলো, এক বিস্ময়ঘোর। গানের ওপারে তখন নতুন ভোর। আগামীর পায়ে পায়ে পৌঁছতে হবে আরও দূরে, এ নদীর বাঁক পেরিয়ে অনন্ত নক্ষত্রবীথিতলে।
গানের সঙ্গে গানের কথা হয়, মুঠো খোলে আদিগন্ত হিমালয়। অফুরন্ত বাতাস বয়ে যায় গানের ছন্দ-দোলায়। আজ তারা সবাই প্রাণ মন ঢেলে সাজিয়ে দেবে তাদের জীবনধাত্রীকে। সময়ও আজ অশ্রুসজল।এ বিদায় বড় কঠিন বিদায়। তবুও এক মহাজীবন যে তাকে স্মরণ করছে সুরের আকুলি-বিকুলি মূর্ছনায় তাকে তো ধরণীর পথে পথে স্মৃতির কণায় কণায় গোটা ভারতবর্ষের অলিন্দ থেকে নিলয়ে উদ্ভাসিত হতে হবে। হয়তো এ ভাবেই চলে যেতে হয়। এই পৃথিবীর মায়া-স্মৃতি-প্রেম-প্রণয়, এই পৃথিবীর অভিমান-আদর-বিতৃষ্ণা-রাগ সব ফেলে চলে যাচ্ছেন আমাদের সম্রাজ্ঞী, না কি ভালবেসে আমরা তাঁকে বরণ করে নিচ্ছি মহাকালে। সুরের ভারতবর্ষ সঙ্গীতের ভারতবর্ষ সাধারণ ও অসাধারণ সমস্ত ভারতবর্ষ আজ নতমুখে দাঁড়িয়ে...।
এই পৃথিবীর সব ফেলে চলে যাচ্ছেন আমাদের সম্রাজ্ঞী...। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
আমি তখন উনিশ কি কুড়ি, ঘোর লেগে গিয়েছিল গ্র্যান্ড হোটেলে একটি রিহার্সালে। বম্বে ও কলকাতার স্বনামধন্য প্রায় আশি-নব্বই জন মিউজিশিয়ানের মাঝে বসে সং ভায়োলিন বাজাচ্ছিলাম। অবশ্যই পাঠক বুঝে নিতে পারেন, সলিল চৌধুরী নাইট হবে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। আজও মনে পড়ে, ঠিক পাশে বসেও আমি তাঁর কণ্ঠ শুনতে পাই না, কণ্ঠে যেন বাঁশি বেজে যায়। আমি হতভম্ব। অজান্তেই হঠাৎ ভায়োলিন থেমে গিয়েছে। আমি হাঁ করে সেই বিদ্যুৎ তরঙ্গিনীকে দেখছি, গোটা অর্কেস্ট্রা বেজে চলেছে, সলিল’দা ডিরেক্ট করছেন। তিনি যে আমার বাজনা শুনছিলেন বুঝলাম, একটা ইশারায় বাজনা চালিয়ে যেতে বললেন। আমি কী এক অনাবিল ঘোর, কী এক মায়াবি নেশায় আবিষ্ট হয়ে বাজিয়ে চললাম একের পর এক।
দেখা কি হয় সেসব মানুষদের সঙ্গে? তাঁদের আবির্ভাব ঘটে। আর তাঁরা একটা সাধারণ রক্তমাংসের শরীর ছেড়ে অনন্ত হয়ে যান। যাতে আমাদের সঙ্গে তাঁদের যুগ-যুগান্তর দেখাশোনা হতে পারে, কথা চালাচালি হতে পারে। সেই প্রথম দেখা মকবুল ফিদা হুসেনের সরস্বতী, যিনি দেবী কি ঈশ্বরী নন, জীবন্ত শরীরী এবং এক অনন্ত বিরহিনী রাধা। যিনি কণ্ঠে ধারণ করেছেন জীবনের গান। তা না হলে কি এত প্রেম, এত বিরহ, এত পূর্বরাগ, এত অভিসার অবলীলায় বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি হৃদয়ে সঞ্চারিত করতে পারতেন। আমি চুপ করে বসে সেই রাধারানিকে দেখছিলাম। লতা মঙ্গেশকরকে কেন্দ্র করে সলিল চৌধুরী নাইট, একের পর এক গান... কখনও ‘এ নদীর দুই কিনারে’ কখনও ‘আ যা রে পরদেসি’ হয়ে ‘না মন লাগে না’ থেকে ‘কেন কিছু কথা বলো না’, এ ভাবেই ‘না জানে কিউ’ ছুঁয়ে আরও কত গানে আমাদের গ্র্যান্ড হোটেলের রিহার্সাল রুমকে মোহিত করে তুলেছেন। দেখেছিলাম প্রতিটা মিউজিশিয়ানের চোখে কী অসম্ভব শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
আমি অনুভব করেছিলাম দুই মহান শিল্পীর অনুচ্চারিত প্রেম। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
সেই প্রথম খুব কাছ থেকে শুনেছিলাম সলিলদার সঙ্গে তার প্রিয়তম শিল্পীর বাক্যালাপ। যা মনে হয়েছিল কৈশোরের প্রথম প্রেমে আবিষ্ট এক কিশোরীর দু’টি অবনত চোখ যেন না বলা কথা হয়ে ঝঙ্কার তোলে সুরে। খুব কাছাকাছি বসে থাকায় দু’জনের বাক্যালাপে আমি নিবিষ্ট ছিলাম। সলিল’দাকে মনে হত এক ছায়াশীতল স্নেহপ্রশ্রয়। আমি অনুভব করেছিলাম দুই মহান শিল্পীর অনুচ্চারিত প্রেম।
রিহার্সালের শেষ প্রান্তে যখন ‘রাতোঁ কি শায়র’ গানটি শুরু হল, দেখলাম একটা ইন্টারল্যুড মিউজিকের পর আচমকা সব স্তব্ধ হয়ে গেল। কোনও এক অনিবার্য নৈঃশব্দ্য ঘিরে ধরল বিদ্যুৎ তরঙ্গিনীকে। গানটি লতা ধরলেন না। মাথা নিচু করে বসে আছেন শিল্পী। একটু দূরে সলিল’দা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিছু একটা কথা বলছেন। আমরা সবাই অবাক। একটু পরে যখন মুখ তুলে চাইলেন, খেয়াল করলাম তাঁর চোখে জল। সলিল’দাকে ডাকলেন, পাশে বসে গানটি সঙ্গে গাইবার অনুরোধ করলেন। অন্তরা থেকে গান ধরলেন সলিল’দা। আমরা মিউজিশিয়ানরা সাক্ষী হয়ে রইলাম এক মহৎ সঙ্গীতকার ও এক বিস্ময়শিল্পীর যুগলবন্দির।
বহু পরে গল্পগাছায় শুনেছিলাম, যেহেতু সলিল’দার ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল সঙ্গীতে অগাধ পাণ্ডিত্য তাই সলিল’দার জন্মদিনে লতা মঙ্গেশকর মোৎজার্ট, বিঠোফেন এই সব পাশ্চাত্য কম্পোজারদের বই উপহার দিতেন। সলিল’দার বাড়িতে সে সব বই আমি দেখেছি। মুম্বই (তৎকালীন বম্বে) যাওয়ার পর নতুন এই সুরকারের কাছে লতা মঙ্গেশকর শিখেছিলেন অনেক, বিশেষত পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ধারাটি। আমরা যারা কলকাতার মিউজিশিয়ান একথা জানতাম, পুজোর গানের সময় যত এগিয়ে আসত, সলিল’দার গানের খাতায় সবচেয়ে মনোগ্রাহী গানগুলি তোলা থাকত এই বিশেষ শিল্পীর জন্য। অদ্ভুত ব্যাপার, এ নিয়ে কারও কোনও আক্ষেপ ছিল না। থাকলেও তা জানতে পারিনি আমরা। এ যেন অবধারিত ছিল, এ যেন অনিবার্য ছিল।
কলকাতার এক বড় জলসায়। আশির দশকে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
কিছু বছর আগে তখন আমি মুম্বইয়ে। ১৯৯৫ সালে সেই ঝড়জলের রাতে সলিল’দা যখন চলে গেলেন, আমি প্রথম বার পিতৃহারা হলাম। এরও বেশ কিছু বছর পরে আমি নিজে যখন চলচ্চিত্র-সঙ্গীতে কাজ করছি, একটি ছবির কারণে আমার প্রযোজকের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সলিল চৌধুরীর সঙ্গে দীর্ঘ তেরো বছর ছিলাম এই কথা জানার পর আমায় তিনি এমন কিছু কথা বলেছিলেন, যা হয়তো আজকে প্রচণ্ড ভাবে প্রাসঙ্গিক।
ভারতবর্ষের অন্যান্য সঙ্গীতকারদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন সলিল চৌধুরী ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতকার। তাঁর একটা আক্ষেপ থেকে গিয়েছে সলিল চৌধুরী কলকাতায় চলে আসার পর অনেকটা সময় তাঁদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল বলে। হয়তো প্রিয় সঙ্গীতকারের জন্য কিছু করতে না পারার একটা অভিমান, একটা জমাটবাঁধা দুঃখ ছিল তার মধ্যে।
আমি প্রচণ্ড ভাবে সলিল অনুরাগী হয়েও বলব, একটি ‘রয়না বিত যায়ে’একটি‘লগ যা গলে’ কিংবা ‘কাঁটো কে খিঁচকে ইয়ে আঁচল’ এবং এ রকম অসংখ্য গানের মায়া যিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁর সামনে মৃত্যুও বড় বিব্রত, অবিন্যস্ত হয়ে তাঁর পায়ের কাছে শোকে মুহ্যমান। আজ সেই মহানদীর পাড়ে বিসর্জনের সানাই বাজছে। অথচ মৃত্যু সে কি নিশ্চিন্ত।চপলা হরিণীর মতো কিংবা এক অনন্ত মুগ্ধতার মাঝে আঁচল বিছিয়ে দিয়েছেন ঈশ্বর।
প্রতিটা বিসর্জনই তো একটা নতুন যাত্রা। এ যাত্রা মহাকালের। এ যাত্রা না শেষ হওয়া মুগ্ধতার। তবুও মন মানে না। রজনী সত্যিই এখনও বাকি...।
(লেখক সঙ্গীত পরিচালক)