সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র
সতেরোটি হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সে-সব গানের তুঙ্গখ্যাতির সূত্রে ‘মাত্র ১৭টি’ লেখা যেতেই পারে বোধ হয়। প্রথম ছবি ‘তারানা’য় লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে যুগলকণ্ঠ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। ছবির সঙ্গীত পরিচালক অনিল বিশ্বাস। গানটি ছিল ‘বোল পাপিহে বোল’। সন্ধ্যার গান শ্যামার ঠোঁটে, লতার অংশ মধুবালার। এই ছবির সূত্রেই লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সখ্যের শুরু।
সন্ধ্যা তখন কার্যত সদ্যই মুম্বই গিয়েছেন। মুম্বইয়ের ডাক এসেছিল শচীন দেববর্মণের কাছ থেকে। ১৯৪৮ সাল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঢাকুরিয়ার বাড়িতে সে-খবর পৌঁছনোর পর রীতিমতো চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল। চাঞ্চল্য সিদ্ধান্ত নেওয়া নিয়েই। সন্ধ্যা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি দ্রুত। মধ্যে শচীন দেববর্মণের স্ত্রী মীরা দেববর্মণের কলকাতার বাড়িতে গিয়ে তাঁকে গান শুনিয়ে এলেও মুম্বই যাওয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছতে অনেকটাই সময় নিয়েছিলেন। দিদি আর দাদার সঙ্গে মুম্বই পাড়ি দেন তিনি ১৯৫০ সালে। মুম্বইয়ে সন্ধ্যার থাকার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিলেন শচীন দেব। সন্ধ্যার এই মুম্বই-পর্ব খুব বেশি দিনের নয়। সেকালের অবিসংবাদী সঙ্গীতকার-শিল্পী শচীনকর্তা তাঁকে মুম্বইয়ে নিয়ে গেলেও তাঁর সুরে সন্ধ্যার প্রথম প্লে-ব্যাক নয় হিন্দি ছবিতে। প্রথম প্লে-ব্যাক ১৯৫১ সালে অনিল বিশ্বাসের সুরেই। তাঁর সুরেই লতা-সন্ধ্যা জুটির আত্মপ্রকাশ।
কিন্তু এই জুটি বা সন্ধ্যা-লতা সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে বহু কথা-কাহিনির উড়ান ঘটেছিল। কেন সন্ধ্যা মাত্র ১৭টি ছবিতে কাজ করেই মুম্বই ছেড়ে কলকতায় ফিরে এলেন? মুম্বইয়ের সে সময়ের অতি-প্রতিষ্ঠিত শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের কি বিশেষ কোনও ভূমিকা ছিল এর পিছনে? কেমন ছিল প্রবাদপ্রতিম এই দুই শিল্পীর মধ্যে সম্পর্ক? আর পাঁচটা ‘গসিপ’ যে ছন্দে চলে, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অথচ, ইতিহাস তা দেখাচ্ছে না। সন্ধ্যার নিজের বয়ানেই তার উল্লেখ রয়েছে। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তাঁর অতি সুসম্পর্কই ছিল।
মুম্বইয়ে থাকাকালীন সন্ধ্যার মা তাঁর মেয়ের কাছে গিয়ে থেকেছিলেন, দাদা-দিদি কলকাতায় ফিরে আসার পর। সে সময়ে লতা মঙ্গেশকর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মায়ের হাতের বাঙালি রান্নার ভক্ত হয়ে পড়েন। মাঝেমধ্যেই হাজির হতেন সন্ধ্যার বাড়িতে। একই ভাবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও হাজির হতেন লতা মঙ্গেশকরের বাড়িতে মরাঠি রসনার আস্বাদ পেতে। এই খাদ্যরস ছাড়াও সন্ধ্যা-লতার ছিল গানের আপনাপন ভিয়ান। তার টানে দু’জনের বন্ধন নিবিড় ছিল। নানা লেখাপত্রেই পাওয়া যায়, সাক্ষাতে বা পরে টেলিফোনে দু’জন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন গান নিয়ে, গান গেয়ে। একই ঘরে একই বিচ্ছানায় দু’জনে শুয়ে হাসিঠাট্টায়, গানের আলোচনায়, পরস্পরের বেড়ে ওঠার কথায় কেটেছে বহু সময়। কখনও লতার লম্বা চুলের গুণগ্রাহী সন্ধ্যা তাঁর বন্ধু লতার কেশচর্চা করে দিচ্ছেন, কখনও লতা তাঁকে শোনাচ্ছেন বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সংসারের হাল ধরার ইতিহাস।
লতা-সন্ধ্যা এক সময় এক সঙ্গে হিন্দি ও বাংলা ছায়াছবি ও বেসিক রেকর্ডের জগতে নক্ষত্রপ্রভায় কাজ করে গিয়েছেন। লতার কণ্ঠে বিমুগ্ধ সন্ধ্যা। সন্ধ্যার কণ্ঠে বিমুগ্ধ লতা। কিন্তু কেউ কারও দ্বারা প্রভাবিত হননি। গায়কির আদানপ্রদান সত্ত্বেও অক্ষুণ্ণ রেখে গিয়েছেন নিজস্বতা। দুই চুম্বকের এই বিজ্ঞান সহজ নয়।
বাংলা সংস্কৃতি চিরকালই লতা মঙ্গেশকরকে টেনেছে। তিনি মনেও করতেন, মরাঠি আর বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির মধ্যে মিল রয়েছে। সেই সূত্রে শচীন দেব বর্মণ, কিশোরকুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, রাহুল দেব বর্মণদের পাশাপাশি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও লতা মঙ্গেশকরের বঙ্গ-অভিকর্ষের অন্যতম সেতু। আরও একটি বন্ধনসূত্র ছিল লতা-সন্ধ্যার। তা অধ্যাত্ম-মার্গের। দু’জনেই শ্রীরামকৃষ্ণ-সারদাদেবী-স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারায় প্রাণিত। লতা মঙ্গেশকরের ঘরে যেমন তাঁদের ছবি সর্বক্ষণের আবহ, তেমনই সন্ধ্যা
মুখোপাধ্যায়ের ঘরেও।