অভিবাদন: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অমিতাভ বচ্চন। ২৪তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। শনিবার। ছবি: এএফপি।
অভিযান ছিল, ইতিহাস ছিল না।
কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধনী মঞ্চে মাধবী, সাবিত্রী থেকে ঋতুপর্ণা, ইন্দ্রাণী হয়ে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিত, দেব, শ্রাবন্তী, নুসরতদের গ্ল্যামারধোয়া চাঁদের হাট ছিল, সেই সঙ্গে মাল্টিপ্লেক্সে ট্রেলার লঞ্চের ঢঙে শাহরুখ খানের আসন্ন ‘জিরো’ ছবির প্রচার, দর্শকাসন থেকে সহর্ষ উল্লাস, আগামী রজত জয়ন্তীর বছরে ইন্ডোর স্টেডিয়াম ছাপিয়ে সল্টলেক স্টেডিয়ামের মতো আরও বড় জায়গায় উদ্বোধন করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি— সবই ছিল। ছিল না অমোঘ কোনও স্মৃতি।
সেই জায়গাটাই পূরণ করলেন ওঁরা। গত আড়াই দশক ধরে চলা উৎসবের মঞ্চে এই প্রথম ‘অভিযান’ ছবির নরসিংহ আর গুলাবি। এই প্রথম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে এলেন ওয়াহিদা রহমান। গুলাবির কি বয়স বাড়ে? ওয়াহিদা জানালেন, সত্যজিৎ রায়কে তিনি বাংলা না জানার কথা বলেছিলেন। সত্যজিৎ উত্তরে বলেছিলেন, চরিত্রের মুখে হিন্দি এবং নানা ভাষা আছে। সৌমিত্রজির সঙ্গে তাঁর ভাল রসায়নও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মঞ্চে বসে নীরবে শুনছিলেন আর এক মহাতারকা…অমিতাভ বচ্চন। সুন্দরীদের তালিকা করতে বসলে যিনি প্রথমেই ওয়াহিদা ও নিজের নাতনি নব্যা নাভেলিকে রাখেন। সেই অমিতাভের বক্তৃতাতেও এল একদা কলকাতা শহরে টেলিফোন অপারেটরের চাকরি-করা এক যুবকের কথা। গুরু দত্ত! গুরু-ওয়াহিদার ‘প্যায়াসা’ ছবির কয়েকটা দৃশ্যের শুটিংও হয়েছিল এই কলকাতাতেই। গুরু-ওয়াহিদার অনুষঙ্গে দর্শকের স্মৃতিতে চলে এলেন আর এক নারী। তিনি ফরিদপুরের মেয়ে… গীতা দত্ত! তিন সারিতে বসে-থাকা সব টলিউড তারকার ঝলকানি ম্লান হল সেই অনুষঙ্গের কাছে। স্মৃতি সততই সুখের!
আলাপচারিতা: কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শাহরুখ খান। ছবি: রণজিৎ নন্দী
সৌমিত্রও তো দূরাগত স্মৃতির কথাই বলছিলেন। ‘‘ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সারা পৃথিবী থেকে বাছাই করা অনেক ভাল ছবি আসে, সেগুলি দেখার জন্য উৎসুক হয়ে থাকতে হয়।’’ ১৯৫২ সালে সত্যজিতরা যে ফিল্মোৎসব করেছিলেন, সৌমিত্রের স্মৃতিতে সেটিই জাগরূক। ডি সিকা থেকে রসেলিনি, অনেকের ছবিই তখন দেখেছিল কলকাতা। ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘ওটাই ভারতের প্রথম সঠিক সিনেমা উৎসব।’ এ বার উদ্বোধনী ছবি দেখার জন্য অবশ্য বেশির ভাগ উৎসুকচিত্ত দর্শক আর বসে থাকেননি। তারকাদের দেখে, তাঁদের কথা শুনে আর সোল্লাসে চিৎকার করেই তাঁরা পড়িমড়ি ছুটেছেন। উদ্বোধনী ছবিটা তাঁদের অনেকেরই দেখা যে! উত্তম-তনুজার ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’।
ফিরিঙ্গি নয়, মঞ্চে বরং ছিলেন ইরানের পরিচালক মাজিদ মজিদি। দোভাষীর সাহায্যে তিনি এই উৎসবের সাফল্য কামনা করেছেন। নন্দিতা দাশ কিছু বলেননি। ‘ফিরাক’ বা ‘মান্টো’ ছবির পরিচালক বলবেন রবিবার। আজ বিকেল ৫টায় শিশির মঞ্চে সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা দেবেন তিনি।
এই প্রথম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে এসেছিলেন ওয়াহিদা রহমান। ছিলেন জয়া বচ্চনও। শনিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
বাকিটা যেমন হয়! শাহরুখ খান দর্শকদের সঙ্গে খুনসুটি করেছেন, ‘আমি ইন্টেলেকচুয়াল নই, উৎসবে তাই আমার ছবি দেখায় না’ বলে তাঁর নতুন ছবির ট্রেলার দেখিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বজিৎ মঞ্চে ছিলেন। ছিলেন মহেশ ভট্ট, রঞ্জিত মল্লিক, সব্যসাচী চক্রবর্তী এবং অনেকেই। এক মঞ্চে বাংলার প্রায় সব নায়কনায়িকা, এটাই এ বারের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বটমলাইন।
আর ছিল বাংলা ছবির শতবর্ষ উদযাপন। ১৯১৮ সালে তৈরি নির্বাক বাংলা কাহিনিচিত্র বিল্বমঙ্গলের কথা বলছিলেন উৎসব কমিটির সভাপতি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯১৯ সালের ৮ নভেম্বর। ফিল্মবেত্তারা বলেন, তারও ঢের আগে হীরালাল সেন নাটকের ছবি তোলেন, তৈরি করেন বিজ্ঞাপনী ছবি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ডকুমেন্টারিও করেন, সেটিই ভারতের প্রথম রাজনৈতিক ছবি। এ বারের উৎসবেও আছে ৩২২টি স্বল্প দৈর্ঘের ও ডকুমেন্টারি ছবি। সেই অনুষঙ্গটাই থাকবে না?
কার্নিভাল, তারকার মেলা, হইচই, অভিযান সবই তাই মজুত ছিল। শুধু ইতিহাস নয়।