ছবি: কৌশিক সরকার।
বর্ণনার ছটা নেই। ঘটনার ঘনঘটা নেই। নেই তত্ত্ব। নেই উপদেশ।
রইল তবে কী?
অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে শেষ হয়েও হইল না শেষ।
ছোট গল্পকে রবীন্দ্রনাথ ঠিক যে ভাবে সংজ্ঞা দিয়েছেন সে ভাবেই আটপৌরে জীবনের মাঝখান থেকে বেছে নেওয়া গল্প নিয়ে সন্দীপ রায় বারবারই তৈরি করতে চান শর্ট ফিল্ম।
একের বাই এক বিশপ লেফ্রয় রোডের বিখ্যাত বাড়িতে বসে তাঁর পরিচালনায় ‘চার’ ছবিটি রিলিজের আগের দিন বলছিলেন সে কথাই।
‘যেখানে ভূতের ভয়’ ছবিতে যোগসূত্র ছিল ভূত। বা ভূতের ভয়। কিংবা জাদুবাস্তবের মায়া। ‘‘কিন্তু ‘চার’য়ে আমি বিষয়গত কোনও যোগসূত্র রাখিনি গল্পের মধ্যে। চারটে চার ধরনের গল্প। চার রকমের মেজাজ,” বললেন সন্দীপ।
কিন্তু পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছবি করতে করতে কি কোনও ক্লান্তি আসে, যে পর পর দু’বার তিনি ছোট গল্প জুড়ে জুড়ে ছবি বানালেন? উত্তরে সন্দীপ বললেন, “হ্যাঁ ক্রমাগত ফিচার ফিল্মের ধাঁচে বড় বড় গল্প বলার মধ্যে একটা একঘেয়েমি আসে তো বটেই। ‘চার’ সেই ক্ষেত্রে একটা ব্রেক।”
আসল কথা ছোট গল্প সন্দীপের কাছে সাহিত্যের খুব প্রিয় একটা বিভাগ। আজ বলে নয়, ছোট গল্পের প্রতি তাঁর অনুরাগ আশৈশব। ঠিক যখন তাঁর বাবা সত্যজিত্ রায় ১৯৬১ সালে ‘তিন কন্যা’ নির্মাণ করেন তখন থেকেই। বললেন, “‘পোস্টমাস্টার’য়ের রতন, ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ী, কিংবা ‘মণিহারা’র মণিমালিকা প্রত্যেকের গল্পই আলাদা। কিন্তু তাদের মধ্যে একটাই সূত্র ছিল। নারীর নানা অনুভূতির উন্মোচন। সেই সঙ্গে সেটা ছিল রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষের উদযাপন উপলক্ষে তৈরি ছবি। অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। ছোট গল্পের প্রভাব তখন থেকেই নাড়া দেয় আমাকে। ছোট গল্পের মধ্যে এমন একটা ব্যঞ্জনা থাকে, যেটা বড় মাপের উপন্যাসে থাকে না। সেই জন্যই বারবারই মনে হয় ছোট গল্প নিয়ে কাজ করি।”
টেলিভিশনের জন্য সন্দীপ নানা সাহিতিকের লেখা নিয়ে প্রচুর শর্ট ফিল্ম করেছেন এক সময়। সেই অভিজ্ঞতার আনন্দকেই বইয়ে দিতে চাইছেন আজকের ছবি ‘চার’য়ে।
কী কারণে নাম ‘চার?’ কেবল চারটে গল্প নিয়ে ছবি বলেই? “অবশ্যই। অনেক রকম নাম যখন ভাবা হচ্ছিল, ‘চার’টাই মনে হল এমন নাম যা দর্শকের সঙ্গে কমিউনিকেট করবে সহজে।”
দর্শক তো সিনেমা বলতে বোঝেন একটা ভরাট দু’ঘণ্টা কি আড়াই ঘণ্টার ছবি। সে ‘শোলে’ই হোক বা ‘সাত পাকে বাঁধা’। সে ‘লগান ’ হোক বা ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’নানা চরিত্র, ঘটনার জাল, নাচ, গান নিয়ে জমজমাট চিত্রনাট্যের একটি মাত্র গল্প। সেখানে এই ধরনের ভিন্ন মাত্রিক চারটে গল্পকে এক আধারে হাজির করলে কি দর্শক কৌতূহলী হবেন? সংশয়টা উড়িয়ে দিতে পারলেন না সন্দীপ। বললেন,
“সেটা অংশত ঠিক। কারণ বাবার ‘তিন কন্যা’ দর্শক যেমন গ্রহণ করেছিলেন উচ্ছ্বসিত হয়ে, ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ কিন্তু দুটি গল্প নিয়ে ছবি হিসেবে তেমন বৃহত্তর দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিদ্দ্বজ্জনেরা প্রশংসা করেছিলেন। তার পর বাবা আর একাধিক গল্প নিয়ে ছবি বানাননি।”
তবে একাধিক গল্প নিয়ে জনপ্রিয় ছবি দৃষ্টান্তও অগণিত।। ফ্রান্সের ছবি ‘প্যারিস আই লভ ইউ’ দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। আঠারোটা গল্প নিয়ে এক ছবি। যার যোগসূত্র ছিল বর্ণময় প্যারিস শহর। নানা ভাবে। নানা পরিচালকের চোখে। সডারবার্গ, ওং কার ওয়াই, অ্যান্তোনিওনি তিন জন পরিচালক মিলে তৈরি করেছিলেন তিনটি গল্পের ছবি ‘ইরোস’। উডি অ্যালেনের পরিচালনায় ‘এভরিথিং ইউ অলওয়েজ ওয়ান্টেড টু নো অ্যাবাউট সেক্স’ ৮৮ মিনিটের ছবিতে গল্প ছিল সাতটা। এ ছবিও দর্শক দেখেছেন। উচ্চমার্গের সমালোচনা পেয়েছিল। অন্য দিকে মৃণাল সেনের কলকাতা ‘৭১ও চার জন গল্পকারের কাহিনি নিয়ে বলা যায় ‘কাল্ট’ ফিল্ম। চার গল্পের যোগসূত্রই আর্থ-সামাজিক অবক্ষয়। যার পটভূমি রাজনীতি। এক ছবিতে ছয় গল্প নিয়ে বেশ কিছু দিন আগে হয়ে গিয়েছে ‘এক মুঠো ছবি’। মানুষের মনে দাগ কেটেছিল তার গল্প বলার ধরন। “শুধু তাই বা কেন! দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বম্বে টকিজ’ও তো ভালই প্রশংসা পেয়েছে,” বলছেন সন্দীপ রায়।
তিনি আরও বলেন, “‘চার’ ছবিতে আমি লেখকদের একটু অন্য রকম ভাবেও দেখাতে চেয়েছি। যেমন বাবার গল্প মানেই ফেলুদা নয়। পরশুরাম মানে ‘বিরিঞ্চি বাবা’ গোত্রের গল্প নয়, আর শরদিন্দু মানে ব্যোমকেশ নয়। কথাশিল্পী হিসেবে এই সব লেখকের একটা আলাদা মনন তুলে ধরতে চেয়েছি। ফলে ‘চার’য়ে চার ধরনের গল্প থাকলেও যোগসূত্র একটাই খুব বড় করে রয়েছে। তা হল অসীম রহস্যময় মানুষের জীবন। মানুষের অন্তরের পরিচয়।’’
কী পাওয়া যাবে এই চারটে গল্পের সমন্বয় থেকে? “পরশুরামের লেখা ‘বটেশ্বরের অবদান’য়ের শেষটা নজিরবিহীন। এক লেখক এবং তার সৃষ্ট চরিত্র নিয়ে গল্প হলেও শেষটা পৌঁছবে এক নাটকীয় মাত্রায়। দ্বিতীয় গল্প ‘দুই বন্ধ’ু বাবার লেখা। খুব দরদি একটা গল্প যেখানে মানুষের ভেতরকার রূপটা বেরিয়ে আসে। ‘কাগতাড়ুয়া’ও বাবার লেখা। এখানে আছে রহস্যময় অলৌকিকের ছোঁয়া। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পরীক্ষা’ গল্পটা পিরিয়ড পিস। চল্লিশের দশকের গল্প। মানব-মানবীর সম্পর্ক নিয়ে ভিন্নমাত্রার এই ফিল্মটায় সাদাকালো ছবি ব্যবহার করা হয়েছে ওই সময়কার সিনেমা শিল্পীদের শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতেই,” এমনই বর্ণনা দিলেন সন্দীপ।
তিনি যে ছোট গল্প নিয়ে ছোট ছোট ফিল্ম গেঁথে ছবি করতে ভালবাসেন তার আর একটা কারণ নতুনত্বের উত্তেজনা। একই ছবিতে বারবার গল্প বদলে যায়, বদলে যায় কাস্টিং ও লোকেশন। ফলে কাজের মধ্যে বৈচিত্র আসে।
‘চার’য়ের দুটি ছবিতে অভিনয় করেছেন সেই শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। সেই ছোটবেলা থেকেই শাশ্বতকে দেখছেন পরিচালক। তোপসের ভূমিকায় তাঁকে নিয়ে যখন সন্দীপ কাজ শুরু করেন তখনই বুঝেছিলেন শাশ্বত ভার্সাটাইল অভিনেতা। যে কোনও চরিত্রই তিনি আত্মস্থ করতে পারেন। “দিনে দিনে শাশ্বতর অভিনয় আরও পরিণত হচ্ছে। সেই জন্য দুটো ছবিতে ওকে নিয়েছি। সম্পূর্ণ দুটো আলাদা রোলে। ‘পরীক্ষা’ গল্পে আবীরকে নিয়ে কাজ করার সময় বুঝেছিলাম ফেলুদা হিসেবে নতুন করে তাকে নিয়ে ভাবা যাবে। ফেলুদা যে নতুন করে কাউকে ভাবতেই হবে সেটা বুঝেছিলাম। কিন্তু সব্যসাচী চক্রবর্তী ফেলুদা হিসেবে এতটাই মাননসই হয়ে গিয়েছিলেন যে সেরা কিছু গল্প ওঁকে নিয়ে করিয়ে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি।”
সন্দীপের মতে এ ছবিতে যে যেমন চরিত্র পেয়েছেন প্রাণ ঢেলে অভিনয় করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কোয়েল মল্লিক থেকে রজতাভ দত্ত। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সুদীপ্তা চক্রবর্তী, শ্রীলেখা মিত্র, পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়, শাশ্বত, আবীর প্রমুখ।
তা এই সব দাপুটে শিল্পীদের নিয়ে জীবনধর্মী উপন্যাস ভিত্তিক ছবিও তো হতে পারে? “সেটা যে আমি ভাবি না তা নয়। ইচ্ছেও আছে একটা ছবি করার যেখানে ফেলুদার গল্প থাকবে না। থাকবে শুধুই জীবনের গল্প। সম্পর্কের গল্প।
বেশ কিছু গল্প পড়া আছে। কিন্তু এখনই কোনটা বলতে চাই না।” চার রকম মেজাজের চারটে গল্প নিয়ে ছবি হলেও ‘চার’ হল শেষ পর্যন্ত মানুষের জীবনের গভীর থেকে কিছু সত্যকে খুঁজে বের করারই প্রয়াস। “শীর্ষ রায়ের ক্যামেরার ট্রিটমেন্ট এ ছবিতে মায়াবী আলো-আঁধারির রং ছড়িয়েছে। ক্যামেরার কাজেই বদলেছে চরিত্রদের অভিনয়ের মেজাজ,” শেষ কথা সন্দীপের এটাই।