ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে মেঘনাদ।
অরিজিৎ বিশ্বাসের ‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে’র দু’বছর পরে ফের বড় পর্দায় মেঘনাদ ভট্টাচার্য। এ বার তিনি প্রবীর রায়ের ‘অগ্নিমন্থন’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘দিব্যজ্যোতি’। গল্পে ‘নগর দর্পণে’ ছায়াছবির ছায়া। চরিত্রে উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রের আদল! মহানায়কের জুতোয় পা গলাচ্ছেন মঞ্চ-পর্দার দাপুটে অভিনেতা?
প্রশ্ন: দু’বছর পরে আবার বড় পর্দায়?
মেঘনাদ: হ্যাঁ, ২০২০-তে অরিজিৎ বিশ্বাসের ‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে’ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ডাক পেয়েছিলাম। ছবিতে অভিনয় করে খুব তৃপ্তি পেয়েছিলাম। ২০২২-এ প্রবীর রায় তাঁর ‘অগ্নিমন্থন’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য আবার ডাকলেন। চরিত্র, গল্প শুনে ভাল লেগেছে। তাই রাজি।
প্রশ্ন: কী ধরনের চরিত্রে আপনাকে দেখা যাবে?
মেঘনাদ: আমার চরিত্রের নাম দিব্যজ্যোতি। বেশ বিপ্লবী মনোভাব। সাধারণত যেমন মঞ্চের চরিত্রাভিনেতারা যেমন হন। অথবা নাটকে এই ধরনের চরিত্র দেখা যায়। বাড়ির কর্তা। প্রচুর পুরস্কারজয়ী পরিচালক। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। তাই পরিচালনা ছেড়ে দিয়েছে। কাজ ছেড়ে দেওয়ার পরে দেখলেন বাড়িতে থাকতে গেলেও প্রতি মুহূর্তে আপোস করে চলতে হয়। এ দিকে অন্যায়ের প্রতিবাদ তার অভ্যাস। দিব্যজ্যোতির ছেলের চ্যানেলের ব্যবসা। জামাই সৎ সাংবাদিক। স্ত্রী, দিব্যজ্যোতির কলেজ বন্ধু এবং ছেলে মিলে অনৈতিক কাজে জড়িত। যা একে বারে সহ্য করতে পারে না সে। পরিবারে মনোবিদ পুত্রবধূ আর নাতনির সঙ্গে সদ্ভাব তার। জামাই একটি খবর করতে গিয়ে খুন হয়। তখনই বিস্ফোরক দিব্যজ্যোতি। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ‘উন্মাদ’ আখ্যা দিয়ে পাগলাগারদে বন্দি করবে স্ত্রী, ছেলে আর বন্ধু! কারণ, তাঁদের পথের কাঁটা হয়ে উঠেছিল দিব্যজ্যোতি।
প্রশ্ন: ‘অগ্নিমন্থন’-এ যেন ছায়াছবি ‘নগর দর্পন’-এর ছায়া! দিব্যজ্যোতি-তে উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রের আদল?
মেঘনাদ: আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ‘নগর দর্পন’ উত্তমকুমারের শ্রেষ্ঠ ছবিগুলোর অন্যতম। অনেক দিন আগে পড়েছিলাম। সেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র বড় ভাই। যিনি প্রতিবাদী। তাঁকেও একই ভাবে পাগল আখ্যা দিয়ে জোর করে পাগলাগারদে বন্দি করা হবে। যদিও চরিত্র এবং গল্পটি যখন শুনি তখন এত কিছু মাথায় আসেনি। এত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আমাদের মতো মঞ্চাভিনেতাদের ক’জন পরিচালক দেয়? প্রবীর ডাকতেই তাই দ্বিতীয় বার ভাবিনি।
প্রশ্ন: পর্দায় অনেক দিন পরে দাপিয়ে অভিনয়ের সুযোগ করে দিচ্ছে ‘দিব্যজ্যোতি’?
মেঘনাদ: বলতে পারেন। জানি না কতটা পারব। তবে খুব বাস্তব দিক ধরেছেন প্রবীর। আপোস কাকে করতে হয় না বলতে পারেন? মঞ্চ, পর্দা, সাংবাদিকতা, সাহিত্যের দুনিয়ায় আপোস অনিবার্য। আমরা সবাই কোনও না কোনও ভাবে আপোস করি। সেই যন্ত্রণা আমরা প্রতি মুহূর্তে বহন করে চলি। সেটাই যেন প্রকাশ্যে আনার সুযোগ করে দিচ্ছে দিব্যজ্যোতি। নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
দু’বছর পরে আবার বড় পর্দায় মেঘনাদ।
প্রশ্ন: নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন নাকি নিজের করা আপোসের যন্ত্রণাকে?
মেঘনাদ: নিজের যন্ত্রণাকে। পর্দায় আমি তুলনায় অনিয়মিত। বেশি দেখা যায় মঞ্চে। সেখানেও আপোস করতে হয়েছে বইকি। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এগোতে হয়েছে। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়েছে। কেউ কোনও পেশায় নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে ধরতে পারে না। আর এই যন্ত্রণা শুধুই একার। আমারও তেমনি অনেক যন্ত্রণা আছে। দিব্যজ্যোতি আমার ভিতরে জমে থাকা যন্ত্রণা বাইরে আনার সুযোগ করে দিচ্ছে।
প্রশ্ন: পর্দার দিব্যজ্যোতি হতে গিয়ে নিজেকে খুব বদলাতে হল?
মেঘনাদ: আমি চরিত্রটি করে দেখাইনি। অভিনয় করতে গিয়ে মেঘনাদ ভট্টাচার্য ‘দিব্যজ্যোতি’তে রূপান্তরিত হয়েছিল। আমায় আমার চরিত্র হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল এত বছরের অভিজ্ঞতা। আমার ভিতরের যন্ত্রণা। সেই সঙ্গে খুঁটিয়ে চিত্রনাট্য পড়েছি। আমার সঙ্গে ছিলেন মৌমিত গুপ্ত, অনিন্দ্য সরকার। ওঁরাও যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। আর ছিলেন বেশ কিছু নতুন প্রতিভা।
প্রশ্ন: নতুনদের সঙ্গে কাজ করে কেমন লাগল?
মেঘনাদ: বেশ ভাল লেগেছে। ওঁদের জানার আগ্রহ প্রবল। আমার নাতনি যিনি হয়েছিলেন তিনি প্রায় প্রতিটি দৃশ্যের আগে আমার থেকে জেনে যেতেন, কী ভাবে অভিনয় করবেন।
প্রশ্ন: অতিমারির পরে বলিউড, বাংলা ছবির দুনিয়া অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মঞ্চের কী অবস্থা?
মেঘনাদ: যত ক্ষণ না দর্শক আগের মতো আসবেন তত ক্ষণ মঞ্চ তার পুরনো জায়গা ফিরে পাবে না। দর্শক আর অভিনেতার মেলবন্ধন ঘটে থিয়েটারে। এবং এটি অন্য বিনোদনের মতো ততটা লাভজনকও নয়। মঞ্চ এমন এক প্রেমিকা যাকে ধরে রাখতে গেলে প্রচুর রসদ লাগে। প্রতি দিন হাজার বায়নাক্কা, এটা চাই সেটা চাই! এক বার ক্যানবন্দি করে বারেবারে দেখানোর সুবিধেও নেই। তাই প্রতি দিন আমাদের প্রচুর আয় করার চেষ্টা করতে হয়। সেটা সম্ভব হয় দর্শক এলে। অতিমারিতে পাশাপাশি বসে নাটক দেখতে ভয় পেয়েছেন সবাই। তাই সভাগৃহ বন্ধ ছিল। এখন একটু একটু করে সব স্বাভাবিক হচ্ছে। দর্শকও ফিরছেন।
প্রশ্ন: গত দু’বছর আপনি কী করলেন?
মেঘনাদ: বাকি শিল্পীদের মতো ছ’মাস কাজ করেছি। দেড় বছর বসেছিলাম। গত ছ’মাস ধরে নতুন নাটক নেমেছে। শো বেশি হয়নি। ছোট ছোট নাটক করেছি। দল ছোট নাটকের উৎসবে সেই সমস্ত নাটক নিয়ে যোগ দিয়েছিল। যাতে আমাদের অভিনয়ে জং পড়ে না যায়। নাট্য মেলাতেও ভাল লোক এসেছে। ২০ মার্চ থেকে মিনির্ভায় রাজ্য নাট্য উৎসব শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে আমরা আবার আগের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। গিরিশ মঞ্চে নাটক ‘আত্মজন’-এর শো আছে।
প্রশ্ন: নাট্য কলা-কুশলী, অভিনেতারা দুঃসময়ে রাজ্য সরকারকে পাশে পেয়েছেন?
মেঘনাদ: স্বীকার করতে বাধা নেই, বামফ্রন্টের আমলে থিয়েটারের পিছনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হত বর্তমান রাজ্য সরকার তার থেকে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করছে। তার ফলে, প্রশিক্ষণ, আলোচনা সভা সহ নাট্য একাডেমির সব কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। এ ছাড়া, ৩০০টি নাট্যদলকে মাথাপিছু ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেয় বর্তমান সরকার। বামফ্রন্টের আমলে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ১০-১৫ হাজার টাকা।
প্রশ্ন: আপোস করতে করতে ক্লান্ত হননি? মনে হয়নি, মঞ্চ ছেড়ে পর্দায় চলে আসবেন?
মেঘনাদ: (হেসে ফেলে) কী করে মনে হবে? মঞ্চ আমার প্রথম এবং একমাত্র প্রেম। পরিবার প্রতিপালন করতে গিয়ে কাস্টমসে চাকরি করেছি। কিন্তু মঞ্চকে ফাঁকি দিয়ে নয়। আমার জীবন ১০-৫টার নয়। বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টায় বাঁধি। বরং, নাটক করি বলে অফিসের উপরমহল আমায় স্নেহ করতেন। তাঁরা অভিনয়ের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধেও করে দিতেন। একটা সময় চুটিয়ে ছোট পর্দাতেও অভিনয় করেছি। তখন ধারাবাহিকে অভিনয় করেও বিকেল ৫টায় ছুটি পাওয়া যেত। নাটকে অভিনয়ের জন্য। এখন সেটা পাওয়া যায় না। তাই আমি আর ছোট পর্দায় নেই।
‘অগ্নিমন্থন’ ছবি মেঘনাদ।
প্রশ্ন: কাস্টমসে চাকরি মানেই ঘুরপথে উপার্জন?
মেঘনাদ: কোনও দিন করতে পারিনি। নাটক করতে দেয়নি। ৫০ বছর ধরে মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত। পর্দার পিছনে ভারী জিনিস বওয়া দিয়ে নাট্যজীবন শুরু। আস্তে আস্তে অভিনয়ে এসেছি। আমি আজও সৎ মঞ্চের দৌলতে। মাথার উপরে দাপুটে সিনিয়রেরা অভিভাবক-সম। তাঁদের নজরে এ সব পড়ে গেলে কী উত্তর দেব? সেই ভয়েই কিছু করিনি।
প্রশ্ন: মঞ্চাভিনেতাদের প্রতিবাদী সত্তাদের রাজনীতিতে আগের মতো দেখা যাচ্ছে না কেন?
মেঘনাদ: গণনাট্যের পুরোধা বিজন ভট্টাচার্য শিখিয়েছিলেন, রাজনীতির এক চোখ খোলা। নাটকের মানুষদের দু’চোখ খোলা। তাই নির্দিষ্ট কোনও ব্যানারে না থাকলেও আমরা মূলত বামপন্থী। এখন সামাজিক স্তরে বাম আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত। ফলে, সেই আন্দোলন মঞ্চেও তুলনায় হয়তো কম দেখা যাচ্ছে। কারণ, নাটক সমাজের আয়না। সেখানে সমাজের ছবি প্রতিফলিত হয়। যদিও সম্প্রতি এক দল শিক্ষিত, ঝকঝকে তরুণ-তরুণী রাস্তায় নেমে পড়েছেন। এঁরা আমাদের নতুন করে অনুপ্রাণিত করছেন। এঁরাই বামদলের টাটকা অক্সিজেন। এঁরা বাম আন্দোলনকে আবার উজ্জীবিত করছেন। যার প্রতিফলন খুব শিগগিরিই দেখা যাবে থিয়েটারে, সাহিত্যে, নাটকের গানে, মঞ্চে।
প্রশ্ন: এঁদের মধ্যে কারা লম্বা রেসের ঘোড়া?
মেঘনাদ: (হেসে ফেলে), কাউকে সে ভাবে নম্বর দিতে পারব না। অতিমারির সময় থেকে রেড ভলান্টিয়ার্সে যাঁরা কাজ করছেন প্রত্যেকেই ভীষণ প্রতিভাধর। এঁরা আপদে-বিপদে সারা ক্ষণ সাধারণের পাশে। প্রচণ্ড কাজ করেছেন। এঁদেরই অনেকে রাজ্য কমিটিতে এসেছেন। এটা ভাল পদক্ষেপ। এর দরকার ছিল। চার দিকের হতাশার রাজনীতিতে এঁরাই আমার চোখে আশার আলো।
প্রশ্ন: ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ দেখেছেন?
মেঘনাদ: দেখিনি, দেখতে হবে বলে মনে হচ্ছে। তবে যে ভাবে ঢাক পেটানো হচ্ছে তাতে আসল উদ্দেশ্য স্পষ্ট। গেরুয়া শিবির কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। কঙ্গনা রানাউতেরা সদলবলে প্রচারে। এর থেকেই তো বোঝা যাচ্ছে, কাশ্মীরী পণ্ডিতদের দুঃখে সবার প্রাণ কাঁদছে না, ফের বিভেদ নীতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। ছবি না দেখেও এটি কিন্তু পরিষ্কার। এ সব বুঝতে ছবি দেখতে হয় না। আর এই ধারণা যদি সত্যি হয় তা হলে আমি এই ছবির ঘোর বিরোধী।