অনন্যা সেন, অভিনেত্রী।
প্রশ্ন: ‘একান্নবর্তী’ মুক্তির পরেই নাকি অনন্যা সেনকে জানতে সবাই উইকিপিডিয়া ঘাঁটছেন?
অনন্যা: এই রে! তাই নাকি? উইকিপিডিয়ায় আমার ছবি দিয়ে ভুল তথ্যও আছে। আমি নাকি ‘তিন কাহন’ নামের একটি ছবি করেছি। ওটা আমি নই। অন্য অনন্যা সেন করেছেন। আমি ‘ভার্জিন মোহিতো’, মীরা নায়ারের ‘এ স্যুটেবল বয়’, ‘মারাদোনার জুতো’ করেছি। খুব শিগগিরি হইচই প্ল্যাটফর্মে ‘গোরা’ বলে একটি সিরিজ আসবে। এখন স্টার জলসায় ধারাবাহিক ‘মন ফাগুন’ করছি।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে আরও চর্চা, এই মুহূর্তে অনন্যার জীবনে নাকি ‘মন ফাগুন’ বনাম ‘একান্নবর্তী’...
অনন্যা: কোনও ‘বনাম’ নেই। দুটো আলাদা মাধ্যম। একটি ছোট পর্দা অন্যটি বড় পর্দা। ফলে, দুটোই সমান্তরাল ভাবে গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। এটা ঠিক, ‘একান্নবর্তী’ একটু বেশি কাছের। কারণ, আমার প্রথম ছবি, প্রথম মুখ্য চরিত্র। এর বাইরে কোনও দ্বন্দ্ব নেই।
প্রশ্ন: মেগা করতে করতে বড় পর্দাকে সময় দিলেন কী করে? নিশ্চয়ই ছোট পর্দায় কম মুখ দেখিয়েছেন ক’দিন?
অনন্যা: অ্যাক্রোপলিস এন্টারটেনমেন্টের স্নিগ্ধা বসু, সানি ঘোষকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমায় বড় পর্দায় অভিনয়ের জন্য সময় বের করে দিয়েছেন। সোমবার থেকেই আবার আমি ছোট পর্দায় ফিরে এসেছি। কোথাও কাজে কোনও খামতি নেই।
প্রশ্ন: ‘মন ফাগুন’-এর সবাই আপনার ছবি দেখেছেন?
অনন্যা: সেটে ফিরেছি। এ বারেই ঘ্যানঘ্যান করতে থাকব। সবাইকে বলতে শুরু করব, কবে ‘একান্নবর্তী’ দেখবে? শিগগিরি গিয়ে দেখে এস।
প্রশ্ন: আপনার অভিনয় প্রশংসিত, রাতারাতি জনপ্রিয়ও, খুব খুশি?
অনন্যা: ছবিটি বাণিজ্যিক ভাবে সফল হলে বেশি খুশি হব। এমনিতেই মেয়েদের নিয়ে খুব কম ছবি হয়। সেখানে মৈনাক ভৌমিকের ‘একান্নবর্তী’ মেয়েদের গল্প বলেছে। ছবি হিট করলে মেয়েদের কষ্ট, ব্যথা সমাজ জানতে পারবে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে। চাইছি, এই ছবি মেয়েদের সম্বন্ধে ইতিবাচক বার্তা দিক।
প্রশ্ন: দর্শকেরা কী বলছেন?
অনন্যা: (উচ্ছ্বসিত গলায়) দুর্গাপুর প্রেক্ষাগৃহে গিয়েছিলাম। ছবি শেষে সবার মুখোমুখি হতেই ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছেন দর্শক। এক প্রবীণা প্রচণ্ড আবেগতাড়িত হয়ে জানালেন, আমায় দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। বয়সে অনেক বড় কেউ আমায় জড়িয়ে ধরেছেন, আমায় দেখে উদ্বুদ্ধ! ভাবা যায়? আবার এই প্রজন্মের অনেক মেয়ে জানিয়েছেন, তাঁরা চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছেন। আমারও এটাই লক্ষ্য ছিল। পিঙ্কি যেন মেয়েদের বোঝাতে পারে, ‘চেহারা যেমনই হোক, আদতে তুমিও মানুষ’।
প্রশ্ন: ‘পিঙ্কি’ হয়ে উঠতে মৈনাক কতটা সাহায্য করেছেন? আপনি কী কী করলেন?
অনন্যা: চিত্রনাট্য নিয়ে মৈনাকদা সবার সঙ্গে কথা বলেছেন। কী ভাবে ‘পিঙ্কি’ হয়ে উঠব, তার পরামর্শও দিয়েছেন। আমিও নিজের মতো করে চরিত্রটি নিয়ে ভেবেছি। তবে সব থেকে বেশি সাহায্য করেছেন সৌরসেনী মৈত্র। ওঁর সঙ্গে আমি এর আগেও কাজ করেছি একটি ওয়েব সিরিজে। ‘নাইন মান্থস’ তার নাম। এখনও মুক্তি পায়নি। কিন্তু বন্ধুত্বটা তখনই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাই যখনই জানতে পারলাম, সৌরসেনী আমার দিদি ‘শীলা’ হচ্ছে, দারুণ ভাল লেগেছিল। ফোনে আমাদের প্রথম কথাই ছিল, ‘আমরা আবার এক সঙ্গে কাজ করছি!’ তার পরেই দু’জনের সারাক্ষণ আলোচনা। জানেন তো, সৌরসেনী কিন্তু আমার থেকে ছোট! অথচ পর্দায় ও আমার দিদি। বাস্তবেও ও যেমন তেমনটা কিন্তু ‘শীলা’ নয়। ফলে, দু’জনেই দু’জনকে চরিত্র হয়ে উঠতে অনেকটাই সাহায্য করেছি।
‘একান্নবর্তী’ ছবির দৃশ্য।
প্রশ্ন: আপনি ‘পিঙ্কি’র মতোই? নাকি আলাদা?
অনন্যা: মিল আছে। পাশাপাশি, পিঙ্কির অনেক কিছু আমায় শিখতে হয়েছে। যেমন, পিঙ্কি কী খায়, কী পরে, কী ভাবে বড় হয়েছে। বুঝতে হয়েছে। আবার পিঙ্কির মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস নেই সেটা আমার মধ্যে মারাত্মক ভাবে আছে। না থাকলে, আমি অভিনেত্রীই হতে পারতাম না। আমি যেমন তেমনই আমি ভাল। ভীষণ খুশি এবং সুখী মানুষ। নিজেকে ভীষণ ভালবাসি। নিজের চোখে সেরা সুন্দরী! (হো হো হাসি)
প্রশ্ন: পরিবার, পড়শি, ইন্ডাস্ট্রি ভারী চেহারার অনন্যাকে নিয়ে কটাক্ষ করেনি?
অনন্যা: আমার বেড়ে ওঠা ইন্ডাস্ট্রিতেই। বাবা পার্থ সেন পরিচালক। ‘এক নম্বর মেসবাড়ি’, ‘অনুব্রত ভাল আছ?’-র পরিচালনা করেছেন। তাই ছোট থেকেই জানি, ইন্ডাস্ট্রিতে থাকব, অভিনেত্রী হব। বড় হওয়ার পরে মনে হল, কী করে অভিনেত্রী হব? আমি তো মোটা! মঞ্চে অভিনয়ের সময়েও মনে ‘কু’ ডাকত, এ যাত্রায় আর অভিনেত্রী হওয়া বোধ হয় হল না! কারণ, ওই একটাই। ফলে, আস্তে আস্তে পরিচালনার দিকে ঝুঁকতে থাকি। তখনই আমার উপলব্ধি, পরিচালনা নয় আমি অভিনেত্রী হওয়ার জন্যেই জন্মেছি। আমি পরিচালক হতে পারব না। তখন ইন্ডাস্ট্রির অনেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘একটু অপেক্ষা কর। এক্ষুণি তুই ডাক পাবি না। আর কিছু দিন পরে ধারাবাহিকে মাসি-পিসির চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাবি।’’ ঈশ্বর বোধহয় এতটাও নিষ্ঠুর নন। আমায় কিন্তু কেউ ‘মোটা মেয়ে’র চরিত্র দেননি! ‘মন ফাগুন’-এও তাইই। শন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বোন। বরং, ‘একান্নবর্তী’তে আমি ‘মোটা মেয়ে’! অথচ দেখুন, দর্শকদের মুখোমুখি যখন হয়েছি কেউ কিন্তু ‘মোটা মেয়ে’ হিসেবে আমায় দেখেননি। চেহারা নিয়ে কোনও কটাক্ষের মুখোমুখি হইনি!
প্রশ্ন: স্কুল, কলেজের বন্ধুরা ‘মোটা’ বলে খ্যাপাত না?
অনন্যা: আমায় খ্যাপাবে! আমি সব জায়গায় রীতিমতো দাদাগিরি চালাই। স্কুল-কলেজেও সেটাই হয়েছে। স্কুলে আমি প্রিফেক্ট ছিলাম। আমাকে সবাই খুশি মনে মেনে নিত। ভালবাসত। ফলে, খ্যাপানোর কোনও সুযোগই দিতাম না।
প্রশ্ন: বাবা পরিচালক মেয়ে সহকারী-পরিচালক, অভিনেত্রী, অনন্যা স্বজনপোষণের জলজ্যান্ত উদাহরণ
অনন্যা: (আবার হাসি) বাবা আমায় কোনও সাহায্য করেননি। পার্থ সেনের নাম আমি কোথাও উচ্চারণ করিনি। নিজের যোগ্যতায় সুদেষ্ণা রায়-অভিজিৎ গুহ-র সহকারী পরিচালক ছিলাম। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়কে ‘লড়াই’ ছবিতে সহযোগিতা করেছি। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সহকারী পরিচালক ছিলাম ‘নির্বাক’, ‘রাজকাহিনী’ ছবিতে। প্রথম ছবিতে ছোট্ট চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলাম। অঞ্জন দত্তের ‘কাজের মেয়ে’! যেখানে অভিনয় করেছি পরীক্ষা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করে তার পর কাজ পেয়েছি। যা পেয়েছি নিজের চেষ্টায়, পরিশ্রমে।
‘একান্নবর্তী’ ছবির দৃশ্য।
প্রশ্ন: পরীক্ষা দিয়েও সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের কোনও ছবির বড় চরিত্রে নেই কেন?
অনন্যা: সৃজিতদার বড় গুণ, ওঁর কোনও চরিত্রের জন্য দরকার মনে হলে সেই অভিনেতাকে নিজে ডেকে নেন। আমাকেও প্রয়োজন পড়লে ঠিক ডাকবেন। তা ছাড়া, দাদা প্রচণ্ড সমর্থন করেছেন আমায়। ‘ইয়েতি অভিযান’-এর সময় আমি মাঝ পথে ছেড়ে চলে এসেছিলাম। ধারাবাহিকে অভিনয়ের ডাক পেয়ে। সৃজিতদা একটুও রাগ করেননি। উল্টে বলেছিলেন, আগে স্বপ্নপূরণ তার পর বাকি সব।
প্রশ্ন: বড় পর্দা থেকে আবার ছোট পর্দায় প্রত্যাবর্তন, একটু কি মনখারাপ?
অনন্যা: মীরা নায়ারের ‘এ স্যুটেবল বয়’-এর পরে যে ধারাবাহিকে ফিরতে পারে এটা তার কাছে কোনও ব্যাপারই না। তখন খুব কষ্ট হয়েছিল। মনে হয়েছিল, আবার ছোট পর্দা! পরে দেখলাম, এই ছোট পর্দাই আমায় ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। এখানেও ভাল পরিচালকেরা কাজ করছেন। আমার এখনকার ধারাবাহিকে নীল মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ বসু, শাশ্বতী গুহঠাকুরতা, শন বন্দ্যোপাধ্যায়, রব দে-র মতো অভিনেতারা রয়েছেন। তা হলে আমিই বা করব না কেন?
প্রশ্ন: সত্যিই তো, মীরা নায়ারের পর বলিউড থেকে আর ডাক নেই!
অনন্যা: যত নষ্টের গোড়া, সাল ২০২০ আর অতিমারি। কাজের সুযোগ তৈরি হয়েও ভেস্তে গেল। আমিও পরিবারের মুখ চেয়ে ফিরে এলাম কলকাতায়। আপাতত এখানেই কাজ করব। তবে এরই ফাঁকে সমানে পরীক্ষা দিচ্ছি। আশা করছি, নিশ্চয়ই সুযোগ পাব।
প্রশ্ন: বাস্তবে ‘স্যুটেবল বয়’-এর খোঁজ পেলেন?
অনন্যা: খুব খারাপ খবর! কাউকে পাইনি। আমি কিন্তু আশা হারাইনি। খুঁজেই চলেছি। জানি, দেখা হবে... (দিলখোলা হাসি)।