ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।
আজকালকার ফিল্মি দুনিয়ায় এই প্রবচনটাকে একটু ঘুরিয়ে লেখা চলে। বলা যেতেই পারে লেখাপড়া করে যে পরিচালনা
করে সে।
সৃজিত মুখোপাধ্যায়, সুমন ঘোষ, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, বেদব্রত পাইনের দলে এক নতুন পরিচালকের নাম যোগ হল এ বার। মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক— দুটোতেই পঞ্চম হয়েছিলেন তিনি। তার পর আইআইটি থেকে ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়াশুনো করে আমেরিকা চলে যান। সেখানে গিয়ে এমএস, এমবিএ করার পর চাকরি। পেশাদার জীবনের সাফল্যে বুঁদ হয়ে থাকলেও সিনেমা বানানোর স্বপ্নটা অয়নাংশু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিছু ছাড়েনি কোনও দিন। ঠিক করলেন ৩০ বছর বয়সে দেশে ফিরে আসবেন। মাতৃভাষায় ছবি বানাবেন। দেশে ফেরার ১২ বছর পরে মুক্তি পাচ্ছে অয়নাংশুর ছবি। নাম ‘বোধন’। মুখ্য ভূমিকায় অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, জয় সেনগুপ্ত, মমতাশঙ্কর, পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ প্রমুখ।
তবে ছবি মুক্তির দু’দিন আগে পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষের ওপর হামলার খবর শুনে বেশ বিচলিত অয়নাংশু। ‘‘আমেরিকায় থাকতেই ওঁদের সঙ্গে আলাপ। আমাকে ছেলের মতো স্নেহ করেন বলেই ওঁরা অর্পিতার শ্বশুর-শাশুড়ির ভূমিকায় অভিনয় করতে রাজি হয়েছিলেন। এই প্রথম ওঁরা দুজনে একসঙ্গে কোনও ছবিতে স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করলেন। ভাগ্যিস চোট খুব গুরুতর নয়! তবে আফসোস হচ্ছে প্রিমিয়ারে ওঁরা থাকতে পারবেন না,’’ বলেন পরিচালক।
তার পর চলে যান নিজের স্বপ্নপূরণের গল্পে। আমেরিকার বড় চাকরি, বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ছেড়ে কলকাতায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধে হয়নি? ‘‘ওদেশে অনেক বাঙালি আছেন যাঁরা দেশে ফিরতে চান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠে না। এটাকে আমরা বলি ‘N+1’ সিনড্রোম। আর এক বছর থেকে দেশে ফিরব ফিরব করতে করতে আর দেশে ফেরা হয় না। কিন্তু যাতে লোভে পড়ে ‘N+1’ সিনড্রোম-এ না আটকে যাই, আমি এমন সময়ে ফিরে আসি, যাতে আমার গ্রিন কার্ড পাওয়ার প্রসেসটাই শেষ না হয়!’’ হেসে বলেন অয়নাংশু।
কী এমন তাগিদ ছিল এ রকম করার? বাবা-মা অবশ্যই একটা কারণ ছিেলন। অন্য কারণগুলো একান্তই ব্যক্তিগত। ‘‘চেয়েছিলাম ইডেনে খেলা হলেই দেখতে যেতে। কলকাতার মেলাগুলো চুটিয়ে উপভোগ করতে। আর ঘুম থেকে উঠে আনন্দবাজার পত্রিকাটা পড়তে! ইন্টারনেট সংস্করণ পড়ে সে মজা পেতাম না,’’ বলেন অয়নাংশু। দেশে ফেরার পর প্রথম দু-তিন বছর সে ভাবেই কাটিয়েছিলেন। তার পর ব্যস্ততা বাড়ে। ‘‘মাথা ব্লকড্ থাকত টার্গেট, বিলিং, কালেকশন, ফায়ার ফাইটিং আর রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট নিয়ে। কবিতা লিখতে চাইলেও শব্দগুলো আসত না। চল্লিশে ঠিক করলাম চাকরি ছাড়ব,’’ বলেন অয়নাংশু।
তবে ফিল্ম বানাব বললেই তো হয় না। বড় হয়েছিলেন সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, বুদ্ধদেবের ছবি দেখে। বিদেশে ফিল্ম নিয়ে থিয়োরেটিক্যাল কোর্সও করেছিলেন। কিন্তু হাতে গরম কিছুই শেখেননি। তাই শুরু হল স্ব-শিক্ষা পর্ব। পছন্দের ছবির চিত্রনাট্য পড়তে শুরু করলেন। ‘‘তার পর ছবিগুলো আবার দেখলাম। বুঝলাম যে চিত্রনাট্য তিনটে ধাপে লেখা হয়। সিনপসিস, ট্রিটমেন্ট, তার পর ডায়লগ। কী অদ্ভুত! কর্পোরেট দুনিয়ায় প্রোপোজালও আমি ও ভাবেই লিখতাম,’’ হেসে বলেন তিনি।
ইতিমধ্যে কলকাতার কিছু নামকরা পরিচালকের কাছে গিয়েছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন যাতে তাঁকে শ্যুটিং দেখতে দেওয়া হয়। কিন্তু সে রকম সাড়া পাননি। তত দিনে রাজ্য সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি দফতরে কনসালট্যান্ট হিসেবে চাকরি নিয়েছেন। এই সময় নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের অ্যালামনি সূত্রে এসআরএফটিআই-এর এক শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ‘‘দেবাশিস ঘোষাল আমাকে বলেছিলেন যে সিনেমা করতে গেলে ৯০ শতাংশ প্রয়োজন হল গল্প, চিত্রনাট্য, আর এটা জানা যে কী ভাবে সেটা তোমার দর্শককে দেখাতে চাও। এগুলোর প্রযুক্তিগত প্রয়োগের জন্য কলাকুশলী পাওয়া কঠিন নয়,’’ জানান অয়নাংশু।
সেই পথেই এগোন তিনি। প্রথমে দেবশঙ্কর হালদারকে নিয়ে তৈরি করলেন বারো মিনিটের একটা শর্ট ফিল্ম। নাম ‘ক্যাটারপিলার হ্যাজ উইংস’। তারপর শুরু হল ফিচার ছবির কাজ। ‘বোধন’য়ের গল্প নিজেরই লেখা। মুখ্য চরিত্রে অর্পিতাকে কেন নিলেন? ব্যক্তিগত ভাবে তো আলাপ ছিল না। উত্তরে অয়নাংশু বলেন, ‘‘আমার বিশ্বাস ছিল এই চরিত্রে অর্পিতা বেস্ট অভিনয় করবে। গল্পটা শুরু হয় মহালয়ার দিনে। অর্পিতার ছেলে অসুস্থ হয় ওই দিনেই।’’ চিত্রনাট্যের একটা স্তরে দেখানো হয় ছ’দিন ধরে সেই ছেলের জন্য লড়াই। কিন্তু এর পরেও আরও একটা গভীর ক্রাইসিস থেকেই যায়। সেটা বোঝানোর জন্যই ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হয় নানা ঘটনা। ইতিমধ্যে ছবিটা ইফি-র ইন্ডিয়ান প্যানোরামাতে দেখানো হয়েছে। দিল্লির গ্লোবাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আর জয়পুর ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও ছবি নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। বায়োস্কোপ গ্লোবাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা পরিচালকের পুরস্কারের পর নর্থ ক্যারোলিনা গ্লোবাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা ছবি আর সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার এসেছে টিম ‘বোধন’য়ের ঝুলিতে।
কখনও মনে হয়েছে তাঁর কেরিয়ার গ্রাফের সঙ্গে বেদব্রতর বেশ মিল রয়েছে? ‘‘হ্যাঁ, আইআইটিতে উনি আমার সিনিয়র ছিলেন। আমাদের সিনেমা বানানোর যাত্রার মধ্যেও মিল আছে,’’ উত্তরে বলেন অয়নাংশু।
এই ডিজিটাল ছবির যুগে বেশ কিছু বিলেতফেরত ইঞ্জিনিয়ার দক্ষ কলাকুশলী জোগাড় করে পরপর ছবি বানিয়ে ফেলেছেন, তা কী শুধুই হুজুগ? স্পষ্ট জবাব দেন, ‘‘সিনেমাটা টেকনিক্যাল সাহায্য নিয়ে বানানো যেতেই পারে। কিন্তু সেটা ভাল হচ্ছে কি না, তা নির্ভর করবে পরিচালকের উপর। নিজে টাকা ধার করে ছবি বানিয়েছি। প্রিমিয়ারের কার্ড বিলি থেকে পরিচালনা— সবই নিজে করেছি। কারণ আমি আমার স্বপ্নকে একটা সুযোগ দিতে চেয়েছিলাম।’’
আর সেটা করতে গিয়ে একটা কথা সার বুঝেছেন অয়নাংশু। শেষ পর্যন্ত সব লড়াই নিজের সঙ্গে, নিজের মধ্যেই হতে থাকে। ‘‘যখন দেখতাম আমার বন্ধুরা মার্সেডিজে চড়ে যাচ্ছে আর আমি ছবি করার নেশায় ওয়ান ফোর্থ মাইনের চাকরি নিয়ে বাসে ঝুলে ঝুলে যাচ্ছি, তখন মনে হত, ঠিক করলাম তো? নিজের সঙ্গে সেই যুদ্ধটা জয় করাটাই সবচেয়ে বড় লড়াই।’’
আজ ‘বোধন’ মুক্তি পেলে বোঝা যাবে সেই লড়াইয়ে অয়নাংশু জয়ী হলেন কি না।