লক্ষ্মী মনে হত আমার এক বন্ধুর মাকে
জহর সরকার
প্রসারভারতীর সিইও
লক্ষ্মী বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুশ্রী কোমল এক নারীর মুখ। তিনি কোনও সেলিব্রিটি নন। সেলিব্রিটি জগতে আমি লক্ষ্মীর খোঁজ করতে চাইও না। সেই নারী আমার বন্ধু রানা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা। শান্ত, স্নিগ্ধ, কোমল সেই নারী যেমন ছিলেন সংসারী, তেমনি গোছালো। হাজরা রোডে রানার বাড়িতে গেলে মাসিমার সঙ্গে দেখা হত। আর মনে মনে ভাবতাম অবিকল যেন লক্ষ্মী প্রতিমা। তাঁর সঙ্গে আমার গত চল্লিশ বছর দেখা নেই। জানি না উনি কেমন আছেন!
লক্ষ্মী বলতে আমার আরও এক নারীর কথা মনে হয়। তাঁর নাম রাজশ্রী বেহেরা। আমার বোনের মতো। তিনি আইসিসিআরের ডিরেক্টর। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি না বাপের বাড়ি, না শ্বশুরবাড়ির মুখাপেক্ষী হয়েছেন। নিজে একা দুটি সন্তানকে মানুষ করছেন এবং উচ্চপদে চাকরি করেছেন, সংসার চালাচ্ছেন। ছেলেমেয়েকে মানুষ করার জন্য নিজে বড় চাকরির সুযোগ ছেড়ে কলকাতায় রয়ে গিয়েছেন। এই নিষ্ঠাই লক্ষ্মীরূপের প্রতীক।
লক্ষ্মী আমার বৌ
বিক্রম ঘোষ
তালবাদ্যশিল্পী
আমার লক্ষ্মী আমার বৌ। শ্রীমতী জয়া শীল ঘোষ। ও একজন পেশাদার অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী। ইচ্ছে করলেই কেবল পেশাটা নিয়ে থাকতে পারত। কিন্তু ঘরসংসার সামলে পেশাটাও বজায় রেখে কেমন করে সব্যসাচী হওয়া যায় সেটা ও দেখিয়ে দিয়েছে। সোজা কথায় সংসারটাকে কল্যাণের প্রতিমূর্তি করে রেখেছে নিজের গুণে। বিয়ের পর আমাদের দুই সন্তান হয়েছে। তাদেরকে দেখভাল আর পেশার কাজ করা সমান তালে সামলায় জয়া।
আমি কখনওই মনে করি না লক্ষ্মী হতে হলে সংসারে অনেক ত্যাগ বা স্যাক্রিফাইস করতে হয়। কিংবা স্যাক্রিফাইস করাটাই লক্ষ্মীর প্রতীক হয়ে ওঠার সব থেকে বড় নজির। আত্মত্যাগের পাশাপাশি আত্মপ্রতিষ্ঠাও লক্ষ্মীর মধ্যে থাকা দরকার। যেটা জয়ার আছে। আমার বাবা-মায়ের বিভিন্ন প্রয়োজনে জয়া সব থেকে আগে ছুটে যায়। তাঁদের প্রয়োজনে আন্তরিক ভাবে পাশে দাঁড়ায়। আসল কথা জয়ার মধ্যে এমন একটা ভালত্ব বা গুডনেস আছে যেটা ওকে লক্ষ্মীরূপে আমার সংসারে খুব সুন্দর করে প্রতিষ্ঠা করেছে।
মোহিনী রূপের আড়ালে সাক্ষাত্ লক্ষ্মী
সুতপা তালুকদার
নৃত্যশিল্পী
ভারতী শিবাজী মোহিনীআট্টমের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে সাধারণ মানুষ উর্বশী, সরস্বতীর খোঁজ পায়। কিন্তু ভারতীদির মধ্যে আমি সাক্ষাত্ লক্ষ্মীকে দেখেছি। দিল্লিবাসী শিল্পী উনি। ওখানে নৃত্যশিল্পী মাত্রেই মাথায় ফুল লাগান, চোখে টানা টানা করে কাজল পরেন। আমি ভারতীদিকে কোনওদিন এই সাজে দেখিনি। খুব সাদামাঠা কেরল-সুতির শাড়ি পরে অত্যন্ত অনাড়ম্বর সাজে উনি আমার কাছে লক্ষ্মীপ্রতিমা রূপেই উজ্জ্বল হয়ে আছেন।
অপর্ণা সেনের মধ্যে দেখেছি লক্ষ্মীকে
ডা. রাজীব শীল
চিকিত্সক
আমি আমার নিজের দিদির কথা বলতে পারি যাঁকে দেখে আমার চিরকাল মনে হয়েছে রূপে লক্ষ্মী, গুণেও লক্ষ্মী। খুব সুন্দর দেখতে, সেই সঙ্গে সংসারী। আরও একজন নারীকে আমার লক্ষ্মী বলে মনে হয়। তিনি অপর্ণা সেন। যেমন শিক্ষিতা, তেমনই গুণী মহিলা। ঘর সংসার সামলানো, ছবি করা, পত্রিকা সম্পাদনা সব দিক থেকে তিনি সমান দক্ষ। আর সুন্দরী তো বটেই।
আশাপূর্ণা দেবীকে লক্ষ্মী মনে হত
সুচিত্রা ভট্টাচার্য
সাহিত্যিক
যাঁকে প্রথমেই আমার জীবন্ত লক্ষ্মী বলে মনে হয় তিনি আমার মা। বয়সের ভারে এখন ন্যুব্জ। কিন্তু যৌবনে ছিলেন অসীম শক্তিময়ী। দু’হাত দিয়ে সংসার সামলেছেন। নিজে চাকরি করতেন না। কিন্তু সংসার খরচের টাকা থেকে সঞ্চয় করে আমাদের প্রয়োজনের দিনে হাতে টাকা তুলে দিয়েছেন।
মা আমার কাছে তাই আজও ধনদায়িনী। পাঁচ সন্তানকে নিয়ে সংসারটা নিপুণ ভাবে চালাতেন। ঘরের সব কাজ নিজেই দেখাশোনা করতেন। বাবা ব্যস্ত থাকতেন অফিস নিয়ে। মায়ের চেহারাও ছিল স্নিগ্ধ। সেই সঙ্গে ছিল একটা তেজি ব্যক্তিত্ব।
আরও একজন নারীকে আমার লক্ষ্মী বলে মনে হয়। যদিও তিনি গুণে সরস্বতী। তিনি আশাপূর্ণা দেবী। তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও সাহিত্য রচনা করেছেন ঘরের ভেতরে বসে।
ঘরের জানলা দিয়ে দেখেছেন বাইরের পৃথিবী। সেই দেখেই কত লেখা। আশাপূর্ণা দেবীর চেহারার মধ্যেও একটা মমত্বের ভাব ছিল। যা কিনা লক্ষ্মীর প্রধান গুণ। গৃহবধূ হয়েই যিনি সরস্বতী হয়েছেন তাঁকে লক্ষ্মী বলব না তো কাকে বলব?
লক্ষ্মী মানে উন্নত থেকে উন্নততর হওয়া মানুষ
ডা. রূপালী বসু
অ্যাপোলো হসপিটাল গোষ্ঠীর সিইও
পৃথিবীতে যা কিছু ঠিক, যা কিছু নীতি অনুযায়ী তাই লক্ষ্মী। কোনও মানুষই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। অবিরত নিজের কাজের গুণগত মানের উন্নতির চেষ্টা যাঁরা করে যান তাঁরা আমার কাছে লক্ষ্মী। কাজের জায়গায় এমন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এঁরা বরবার আমায় বলে এসেছেন কোনও কাজ একটা উন্নত জায়গায় পৌঁছোলেই, সেই কাজের মান আরও উন্নত করার জন্য একটা নতুন শৃঙ্গ তৈরি করে নিতে হয়। পরবর্তী চলাটা হয় ওই উন্নততর শৃঙ্গকে ছুঁয়ে ফেলার জন্য। আমি এই কথা মেনে চলি। কারণ এই কথাটার মধ্যে এক ধরনের লক্ষ্মীবোধ আছে।