SoumitraChatterjee

Soumitra Chatterjee: ‘আপনার সঙ্গে কাজের ইচ্ছে পূরণ হল না... কিন্তু আপনার ইচ্ছে পূরণ করেছি স্যার’

সৌমিত্র বলেছিলেন, ‘‘যখন উপার্জন করবে, তখন থেকে নাটকের শো আর বিনামূল্যে দেখবে না।’’

Advertisement

গাজী আব্দূন নূর

ঢাকা শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২১ ১৭:৫০
Share:

ছবিতে সৌমিত্রর নানা চরিত্র এক ক্যানভাসে একাকার।

সোমবার ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম প্রয়াণবার্ষিকী। প্রয়াত শিল্পীকে নিয়ে তুলি-কলা শিল্পী অনিকেতের একটি ছবি সবার হাতে হাতে ফিরছে। তাঁর তুলির টান থেকে মুখ ফেরাতে পারেননি কেউই। ছবিতে সৌমিত্রর নানা চরিত্র এক ক্যানভাসে একাকার। ছবি দেখতে দেখতে আমিও বিভোর ফেলে আসা কলেজ-বেলায়।

ক্লাসে বরাবর আমি এবং আমার বন্ধুরা অমনোযোগী। ব্যতিক্রম কয়েক জন শিক্ষকের ক্লাস। সেই সব ক্লাসে নাটক বিভাগের সব থেকে অমনোযোগী দলের উপস্থিতির হার সব থেকে বেশি! আমরা মন থেকে চাইতাম, শনিবার এবং রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হোক! বিটি রোডের ক্যাম্পাসের পর আমাদের আবেগের জায়গা ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদালান, কুঠিঘাট, নন্দন চত্বর, গিরিশ মঞ্চ, রবীন্দ্র সদন, অ্যাকাডেমি। সিঁথির মোড় থেকে কুঠিঘাট সাত টাকা অটো ভাড়া। সেটিও পকেট না থাকায় পায়ে হেঁটে পৌঁছে যেতাম সবাই।

Advertisement

বিভিন্ন নাট্যদলের শো দেখা আমাদের নেশা ছিল। সেই নেশা মেটাতে কখনও যাওয়ার ভাড়া পকেটে থাকলেও ফিরে আসা বা শো দেখার টিকিটের টাকা থাকত না। নাটকের শো দেখার ব্যবস্থা হত সেই দলে কাজ করা বন্ধুদের মাধ্যমে। সেই দলের পরিচিত কেউ না থাকলে কী হত? নানা ফন্দি-ফিকির খুঁজতে হত। কখনও নিরাপত্তা রক্ষীকে ‘ম্যানেজ’ করে! কখনও সেই দলের লোক সেজে! আর এই কাজের প্রধান ছিল সম্রাট এবং ভাস্কর। কানে ফোন নিয়ে এমন একটা ভাব করে সাজঘরে ঢুকত, যেন দলেরই কেউ। তার পর বেরিয়ে এসে আমাদের সবাইকে ধরে ঢুকিয়ে নিত। কোনও কোনও দিন তাতেও অবশ্য খুব লাভ হত না।

তেমনই এক দিন। অ্যাকাডেমিতে শো দেখার আপ্রাণ চেষ্টায় ব্যর্থ আমরা। শেষে সম্রাট এবং ভাস্করের বুদ্ধিতে ঠিক হল, যে দিক থেকে নাটকের সেট ঢোকে সেই শাটার তুলে আমরা ভিতরে ঢুকব। অনেক সাহস করে আমি, সম্রাট, ভাস্কর সেই শাটার তোলার কাজ শুরু করলাম। পিছনে দাঁড়িয়ে সূর্যকন্যা, তনুশ্রী সহ আরও কয়েক জন বন্ধু। নিঃশব্দে শাটার খানিক তুলেই থমকে গেলাম। সামনে স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়!

তিনি ভাল করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধপ করে শাটার নামিয়ে পালিয়ে এলাম নন্দনে। কিন্তু অপরাধবোধ যে কিছুতেই পিছু ছাড়ে না! এ দিকে সম্রাট সহ কয়েক জন বড় কয়েকটি নাটক দলের সঙ্গে যুক্ত। তারা পরিচিত মুখ। তাই ফিরে গিয়ে ‘ক্ষমা’ চাইব, সেই সাহসও নেই। একমাত্র আমি অপরিচিত মুখ, তখনও কোনও নাটকের দলে যোগ দিইনি। ফলে, দায়িত্ব পড়ল আমার উপরেই। অপরাধবোধ এবং ভয় নিয়ে শো শেষে পায়ে পায়ে সাজঘরে গেলাম।

Advertisement

শো-এর পর সাজঘরে ভাল ভিড়। অনেকেই দেখা করতে এসেছেন। আমি অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছি। দূর থেকেই চিনতে পারলেন সৌমিত্র! হাতের ইশারায় ডাকলেন। আমি একটু দূরত্ব রেখে প্রণাম জানালাম। বুঝলেন, ভয় পেয়েছি। হেসে ফেলে বললেন, ‘‘দেখতে পেরেছ?’’ মাথা নেড়ে আস্তে করে বললাম, ‘‘না।’’ প্রশ্ন করলেন, ‘‘তোমার বাকি সঙ্গীরা কোথা?’’

আমি বললাম, ‘‘স্যার, ভুল হয়ে গিয়েছে। এ রকম আর হবে না।’’ আবারও হাসলেন। এ বার কাছে ডাকলেন, ‘‘এদিকে এসো।’’ কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদ নিলাম। গড় গড় করে বলে ফেললাম, ‘‘বাংলাদেশ থেকে এসেছি, রবীন্দ্রভারতীতে পড়ছি…’’ আরও অনেক কথা! সবটা আর মনে নেই। কিন্তু ওঁর একটি কথা মনে থাকবে আজীবন। সৌমিত্র বলেছিলেন, ‘‘যখন উপার্জন করবে, তখন থেকে নাটকের শো আর বিনামূল্যে দেখবে না।’’ স্কলারশিপ পাওয়ার পর থেকে আর কখনও নাটকের শো, ছবি বিনামূল্যে দেখিনি। এবং কোনও লেখকের থেকে বিনামূল্যে বই নিইনি।

আপনার সঙ্গে কাজ করার খুব ইচ্ছে ছিল। পূরণ হল না... কিন্তু আপনার ইচ্ছে পূরণ করেছি স্যার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement