বেহালা আর্ট ফেস্টে শিল্পী সনাতন দিন্দার আঁকা পরিযায়ী শ্রমিকদের অন্তহীন পথ চলার ছবি। নিজস্ব চিত্র।
গত এক বছরে দেশবাসীর কত রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছে। অতিমারি থেকে লকডাউন, টালমাটাল আর্থিক পরিস্থিতি থেকে কৃষক আন্দোলন। সময়ের সেই কথাই তুলে ধরতে ব্রতী হয়েছেন একদল শিল্পী। নিজেদের নান্দনিক ভাবনায়, শিল্পাঙ্গনকেই গড়ে তুলেছেন প্রতিবাদের এক ক্যানভাস হিসেবে। বেহালার রায় বাহাদুর রোড সংলগ্ন ১৪ নম্বর বাস স্ট্যান্ডের ইট-কাঠ-পাথরের কংক্রিটের জঙ্গলকে এক শিল্পপীঠ গড়ে তোলা হয়েছে। বেহালা নূতন সংঘের উদ্যোগে গত বছর থেকে শুরু হয়েছে ‘বেহালা আর্ট ফেস্ট’।
শুক্রবার থেকে রবিবার পর্যন্ত চলবে এই উন্মুক্ত শিল্পী প্রদর্শনী। এই ‘আর্ট ফেস্ট’-এর আহ্বায়ক শিল্পী সনাতন দিন্দা। শিল্প প্রদর্শনীর কিউরেটর ঐন্দ্রিলা মাইতি সুরাই। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বোঝাতে তিনটি আপ্তবাক্যের ব্যবহার করেছিলেন প্রয়াত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহম লিঙ্কন, ‘বাই দ্য পিপল, ‘ফর দ্য পিপল, অব দ্য পিপল’। একটি বিশাল দেওয়ালে শিল্পী সনাতন তুলে ধরেছেন লকডাউনে মাইলে পর মাইল হেঁটে চলা পরিযায়ী শ্রমিকদের তৈলচিত্র। সঙ্গে লেখা ওই তিন বাক্য। গণতান্ত্রিক ভারতে শ্রমিক শ্রেণির প্রতি কী ছিল রাষ্ট্রের ব্যবহার? সেই প্রশ্নই তোলা হয়েছে। পাশাপাশি, কৃষক আন্দোলনের প্রতি তাঁর সমর্থন উজাড় করে দিয়ে লাঙল, মাটি ও মাউথপিসের সমাহারে গড়ে তুলেছেন ‘বি-কর্ষণ’ ভাস্কর্য।
শিল্পী অনির্বাণ দাসের 'এখনও অনেক যোজন বাকি' ভাবনায় দরিদ্র নিরন্ন মানুষের ছবি। সঙ্গে আর্ট ফেস্টে শিল্পীদের শিল্প কর্ম। নিজস্ব চিত্র।
বিশ্বনাথ দে আবার ‘মোদের কোনও দ্যাশ নাই’ ভাবনায় একটি বিহঙ্গ সীমানা না মেনেই উড়ে চলেছে। অডিয়ো-ভিডিয়ো ব্যাক প্রজেকশন, কাজে লাগানো হয়েছে ভোটার লিস্ট।
রূপক বসুর শিল্প ভাবনায় স্থান পেয়েছে রায় গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যের ‘অন্নপূর্ণা ও ঈশ্বরী পাটনী’। তাঁর ভাবনার নাম, ‘জন্মভূমি আজ আঁশবঁটি, হাঁড়ি, উনুন’।
তরুণ শিল্পী কৃষানু পালের ‘দ্য ব্রোকেন ব্যারিয়র’ ভাবনায় উঠে এসেছে, গণ আন্দোলন দমন করতে রাষ্ট্রের হাতিয়ার ব্যারিকেড।
শিল্পী রবীন রায়ের 'শিরোনামহীন' শীর্ষক ছবির সংকলন। নিজস্ব চিত্র।
শিল্পী উপাসনা চট্টোপাধ্যায়ের শিল্পকর্ম ‘দ্য ন্যুয়েসেন্স অব মেমোরি: টেল মি হোয়াট ইউ রিটেন’-এ মিলেছে ছিন্নমূল মানুষের যন্ত্রণা নিয়ে বিভেদ ভুলে মানুষের প্রতি মানুষের শিকড়ের সম্পর্ক। শিল্পী অনির্বাণ দাসের ‘এখনও অনেক যোজন বাকি’ শিল্প ভাবনায় ব্যক্ত করা হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের শুকতলা খয়ে যাওয়া জুতোর পাহাড় ও মাইলস্টোন।
শিল্পী প্রদীপ দাসের ভাবনা ‘রিয়্যালিটি অ্যান্ড ওয়েজ অব পারসিভিং ইট’-এ নতুন পুরনো মাইক্রোআভেনের সমাহারে তৈরি হয়েছে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার ইনস্টলেশন। এই ভাবনাটি এসেছে মূলত দিল্লির কৃষক আন্দোলন থেকে। বেশ কয়েকটি মাইক্রোআভেনের ভিতরে ইটের টুকরো দিয়ে শিল্পী বোঝাতে চেয়েছেন কৃষক আন্দোলন ও তার প্রাণশক্তির কথা।
'দ্যা ব্রোকেন বেরিয়র' ভাবনায় শিল্পী কৃষাণু পালের ইনস্টলেশন। নিজস্ব চিত্র।
শিল্পী রবীন রায় আবার তাঁর ‘শিরোনামহীন’ ভাবনায় তুলে ধরেছেন মানবজাতির সুষুম্নাকাণ্ডের প্রকারভেদ। জীবনের পথ চলায় মানুষ কী ভাবে বিকিয়েছে তাঁর সুষুম্না, সেই প্রশ্নই উঠে এসেছে। শিল্পী দেবাশিস বারুইয়ের ‘জিরো ইন্টু জিরো’ আবার রাজনৈতিক পরিসরকে উঠিয়ে এনেছেন সাঙ্কেতিক ভাবে।
শিল্পী ভবতোষ সুতারের ক্যানভাস এখানে ত্রিপল। ‘এক অচিনের নাতিদীর্ঘ ইতিহাস’ ভাবনায় অডিয়ো বার্তায় একটি অ্যালুমিনিয়ামের থালা ঘূর্ণায়নকে বোঝানো হয়েছে, দেশভাগের সময় বাংলাদেশ থেকে চলে আসা শরনার্থীদের পরিবারবর্গের কথা।
বিমল সামন্তের ভাবনা ‘আনটাইটেল্ড’, অ্যানালগ যুগ পেরিয়ে ডিজিটাল যুগের কথা।
দেবজ্যোতি জানার ‘অনিশ্চয়ের মুখোমুখি’ ভাবনায় কৃষকের ফসলের নিষ্প্রাণ নিরাপত্তারক্ষী কাকতাড়ুয়াকেই দাঁড় করিয়েছেন প্রতিবাদীর ভূমিকায়। তাঁর দাঁতকপাটিতেই স্থান পাচ্ছে সংসদ ভবন।
শিল্পী আশিস সাহার শিল্প-ভাবনা। নিজস্ব চিত্র।
এই শিল্প যজ্ঞে সামিল হয়েছেন শিল্পী মল্লিকা দাস সুতার, অসীম পাল, তিমির ব্রহ্ম, সুব্রত সাহা, স্নেহাশিস মাইতি, দীপ দাস, আশিস সাহা, অভিজিৎ ঘটক, শিবশঙ্কর দাস, সোমনাথ মুখোপাধ্যায় এবং নির্মল মল্লিক। নিজেদের এই ‘আর্ট ফেস্ট’ প্রসঙ্গে উদ্যোক্তা অভিষেক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমরা গত বছর থেকে এই ফেস্ট করছি। এখানে শিল্পীদের উপর কোনও রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক চাপ থাকে না। তাঁরা তাঁদের স্বাধীনতায় তৈলচিত্র থেকে ভাস্কর্য তৈরি করেন। পৃথিবীতে ঘটে চলা নানান ঘটনাও উঠে আসে তাদের কাজের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রেও তেমনটা হয়েছে। শিল্পের এই বিকশিত হওয়ার প্রক্রিয়া আসলে একটা বিল্পব।’’