‘বর্ণ পরিচয়’-এর দৃশ্য
থ্রিলারের কারখানা
বাংলা সিনেমার বাজারে থ্রিলার বরাবরই লাভজনক ছিল। কিন্তু প্রতিটি প্রযোজনা সংস্থার প্রায় সব পরিচালকই পরপর থ্রিলার ঘোষণা করছেন দেখে মনে হয়, ট্রেন্ড এখন থ্রিলারের দিকে ভালই ঝুঁকেছে। একে তো থ্রিলার মানে ভাল কনটেন্ট, তার উপরে হিটেরও রমরমা! সামনে আসছে মৈনাক ভৌমিকের ‘বর্ণ পরিচয়’, সুদেষ্ণা রায়-অভিজিৎ গুহের ‘সামসারা’, প্রতিম ডি গুপ্তের ‘শান্তিলাল ও প্রজাপতি রহস্য’, সৌকর্য ঘোষালের ‘রক্তরহস্য’।
একেবারে নতুন গোয়েন্দা সিরিজ়ের প্ল্যানিং নিয়েও এগোচ্ছেন পরিচালকরা। প্রতিম গোয়েন্দা শান্তিলালকে নিয়ে নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি আনতে চান। পরিচালক অরিন্দম শীল বড় পর্দায় নিয়ে আসছেন মিতিন মাসিকে। খবর বলছে, আবীর চট্টোপাধ্যায়-মিমি চক্রবর্তীকে নিয়ে ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পূর্ণ আলাদা থ্রিলার করার দিকে এগোচ্ছেন। মৈনাক ভৌমিক ‘গোয়েন্দা জুনিয়র’ নামে নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির কথা ঘোষণা করেছেন সম্প্রতি, যেখানে গোয়েন্দা হবেন ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়। ঋত্বিক চক্রবর্তীও ‘সামসারা’, ‘শান্তিলাল...’ এবং হরনাথ চক্রবর্তীর থ্রিলারে কাজ করলেন। আবার অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিককে এ বছর অরিন্দম শীল এবং সৌকর্য ছাড়াও পরিচালক অভিমন্যু মুখোপাধ্যায়ের থ্রিলারে দেখা যাবে।
কেন থ্রিলারে ঝোঁক
আসলে রোম্যান্সকেন্দ্রিক কিংবা অ্যাকশনভিত্তিক কমার্শিয়াল ছবির বাজার অনেক দিন ধরেই পড়তি। দক্ষিণী রিমেকের উপরে নির্ভর করেও লাভ হচ্ছে না পরিচালকদের। থ্রিলারের ক্ষেত্রে আবার বাংলা ছবি কিন্তু বেশ লাভবান হয়েছে ইদানীং কালে। ব্যোমকেশের কত ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ভাবুন! সায়ন্তন ঘোষালের ‘যকের ধন’ হিট হওয়ার পরে তাঁর উপরে ভরসা করেছেন প্রযোজকরা। ‘সাগরদ্বীপে যকের ধন’ আনছেন তিনি। নতুন ব্যোমকেশও তাঁর হাতে। ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সোনাদা ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি হিট। গুঞ্জন উঠেছে, ভেঙ্কটেশ তাঁকেই দিতে পারে ব্যোমকেশের ভার। আবার মাসখানেক আগে ‘ভিঞ্চিদা’ও লোকে পছন্দ করেছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও থ্রিলারেরই রমরমা। একের পর এক থ্রিলার সিরিজ় কিংবা অরিজিনাল থ্রিলার ছবি সেখানে। সুতরাং প্রশ্ন ওঠে, দর্শককে হলমুখী করতেই কি থ্রিলারের দিকে ঝুঁকছেন সকলে? না হলে যে পরিচালকরা কোনও দিন থ্রিলার বানাননি, তাঁরাও থ্রিলারেরই শরণাপন্ন কেন?
কে কী বলছেন
মৈনাক ভৌমিক সাধারণত ফিল-গুড এন্টারটেনার বানান। তাঁর ‘বিবাহ ডায়েরিজ়’ বা ‘জেনারেশন আমি’ সেই ধরনের ছবি। তিনি কিন্তু অনেকটা ঘুরে গিয়ে থ্রিলারের পথে হেঁটেছেন। পরিচালকের কথায়, ‘‘থ্রিলার বানানো সোজা। প্লটকে নানা দিকে ঘোরানো যায়। আনএক্সপেক্টেড টুইস্ট আনা যায়। আমি অনেক দিনই থ্রিলার বানাতে চাইছিলাম। ‘বর্ণ পরিচয়’-এর পরে প্রযোজনা সংস্থা আরও থ্রিলার করতে বলে।’’ সেখান থেকেই ‘গোয়েন্দা জুনিয়র’ নিয়ে আসার প্ল্যান মৈনাকের।
সামনেই মুক্তি পেতে চলেছে সুদেষ্ণা রায়-অভিজিৎ গুহের ‘সামসারা’। ছবিটি পরিচালকদ্বয়ের প্রথম থ্রিলার। সুদেষ্ণা বলছিলেন, ‘‘আমাদের ছবিটা কিন্তু সোজাসুজি থ্রিলার নয়। জীবন নিয়ে থ্রিলার। যেখানে বন্ধুত্ব, নস্ট্যালজিয়ার একটা জায়গা রয়েছে।’’ তবে ট্রেন্ড সম্পর্কে তিনি সচেতন। ‘‘থ্রিলার যে বক্স অফিসে ভাল চলছে, সেটা তো সকলেই দেখতে পাচ্ছেন। সায়ন্তন-ধ্রুবদের মতো নতুনরাও হিট থ্রিলার দিয়েছে ইন্ডাস্ট্রিকে। দর্শক ওঁদের ছবিগুলো দেখতে হলে গিয়েছেন। এখন কমেডি আর থ্রিলারেরই সময়। দর্শক কমার্শিয়াল রোম্যান্স দেখতে চাইছেন না,’’ বললেন সুদেষ্ণা। নারায়ণ সান্যালের লেখা অবলম্বনে ‘কাঁটায় কাঁটায়’ নামে একটি থ্রিলার করেছিলেন হরনাথ চক্রবর্তী। কিন্তু তা মুক্তি পায়নি। সম্প্রতি ঋত্বিক, পার্নো মিত্র এবং রঞ্জিত মল্লিককে নিয়ে তাঁর ছবির শুট করে ফিরলেন নর্থ বেঙ্গল থেকে। হিসেব মতো এটিই তাঁর প্রথম থ্রিলার। ছবিতে গোয়েন্দা হয়েছেন রঞ্জিত মল্লিক। থ্রিলারই এখন ট্রেন্ড কি না সেই প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘‘ট্রেন্ড ভেবে ছবিটা বানাইনি। আমার থ্রিলার ফেলুদা-ব্যোমকেশ ধরনেরও নয়। কনসেপ্টটা অন্য রকম। তবে মনে করি, সবাই লাইন দিয়ে থ্রিলার বানালে দর্শক আর দেখবেন না!’’
অন্য রকম থ্রিলার
আসলে থ্রিলারে ‘হুক’ বা টানটান এক ধরনের ব্যাপার থাকে, যা দর্শককে সিটের কোনা আঁকড়ে বসিয়ে রাখে। সেই জায়গা থেকেই এর সাফল্যকে পুঁজি করছে প্রযোজনা সংস্থারা। কিন্তু শুধু ‘হুডানইট’ বা ‘ট্রেজ়ার হান্ট’ নয়, ভাল কনটেন্টের স্বার্থে থ্রিলারেও এখন নানা দিক যোগ করছেন পরিচালকরা। সুদেষ্ণা-অভিজিৎ বা হরনাথের কথা থেকেই সেটা পরিষ্কার। সৌকর্য ঘোষালও ‘রক্ত রহস্য’কে ইমোশনাল থ্রিলার হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বললেন, ‘‘অনেক থ্রিলারই মূলত হয় রিভেঞ্জ স্টোরি। কিন্তু আমার ছবিতে দেখানো হয়েছে এক জন ভালমানুষ, নিজেকে একটুও না বদলে, ইমোশনকে গুরুত্ব দিয়ে কী ভাবে রিভেঞ্জ নেয়। তার জীবনের সব কিছু আবেগের নিরিখেই। ঠিক যেমন আমরা...’’
সুতরাং নেহাত রহস্যের সমাধান নয়। থ্রিলারে এমন কিছু এই পরিচালকরা যোগ করতে চাইছেন, যা শুধুই বক্স অফিসে লাভের দিকে নয়, সিনেমার মানবিক দিককেও গুরুত্ব দেয়। যাতে দর্শক শুধু বিনোদন নয়, পান ভাবনার খোরাকও।