অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা....
সেই যাত্রার সাক্ষী হতেই যেন তিন বৃদ্ধ ঘরে ঢুকলেন। তিনতলা সাবেক বাড়ির বৈঠক খানায় বনেদি আনার ছাপ স্পষ্ট। বিরাট সোফায় ওই তো গা এলিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত তিন বৃদ্ধের একান্ত বন্ধু প্রণব। সকালবেলায় আচমকা মৃত্যু এসে প্রাণবাতি নিভিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে। বাড়িতে লোকজন বলতে কেউ নেই। ছেলে অনি বিদেশে থাকে।
দেশপ্রিয় পার্কের কাছে এক বাড়িতে সোমবার সকালে ঘটছিল এই সব ঘটনা। উপলক্ষ্য মায়ামীর অর্থনীতির অধ্যাপক এবং পরিচালক সুমন ঘোষের পরের ছবির শ্যুটিং। ছবির নাম ‘পিস হেভন’।
মৃতদেহের পাশে বসা ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে শুরু করবেন যেই, পরিচালক সুমন ঘোষ বলেন ‘অ্যাকশন।’ আলো জ্বলে উঠল। ক্যামেরা সক্রিয় হল।
শ্যুটিংয়ের ফাঁকে আড্ডায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায়। ছবি: কৌশিক সরকার।
মৃত্যুর অমোঘ সত্য জীবনের শেষপ্রান্তে গিয়ে যখন খুব কাছাকাছি চলে আসে তখন ঠিক কেমন অনুভূতি হয়? কী ভাবে জীবনকে নানা অভিজ্ঞতার আলোয় দেখতে ইচ্ছে করে তারই অভিজ্ঞান সুমনের এই ছবি। আর ওই তিন বৃদ্ধের ভূমিকায় অভিনয় করছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায়।
মৃত্যু দৃশ্য শ্যুট করার আগে কে বলবে তিনজনের তুমুল আড্ডা হচ্ছিল নীচের ঘরে। সেখানে বিষন্নতা নেই। নাটক নিয়ে হাজারো গল্প। তিন দাপুটে অভিনেতার জীবনের উল্লাস। তিনজনেই দুরন্ত মঞ্চাভিনেতা। সেই মিল থেকেই তো এত গল্প। গল্প করতে করতেই উপরে উঠে এলেন। বসলেন পাশাপাশি সোফায়। মুহূর্তে মুখে নেমে এল বিষন্নতা। জাত অভিনেতার মতো পাল্টে ফেললেন ওঁরা মুড। ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট লিখে মৃতের ছেলে অনির বন্ধু সুজন মুখোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেন। এবং বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার ডেডবডির দিকে ফিরে তাকান।
শটটা দুবার টেক করা হল। দুবারই ডাক্তার বেরিয়ে যাওয়ার আগে ডেডবডির দিকে ফিরে তাকালেন। সৌমিত্র বলে উঠলেন, “ডেডবডির দিকে ফিরে তাকাবেন না।”
কেন ডাক্তার কি ডেডবডির দিকে ঘুরে তাকাতে পারেন না?
সোফার হাতলের ওপর হালকা সবুজ পঞ্জাবী আর জিনসের প্যান্ট পরে বসে কেতাদুরস্ত গলায় বললেন সৌমিত্র, “সেটা হয় নাকি? এই সব পাড়ার ডাক্তার। ডেথ সাটিফিকেট লিখতে এসেছে। তার আবার কীসের মায়া যে ডেডবডির দিকে ঘুরে তাকাবে! তাই মানা করলাম।”
সুমনের প্রথম ছবি ‘পদক্ষেপ’য়ের জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সুমনের প্রায় সব ছবিতেই তাঁকে দেখা গেছে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। কিন্তু জীবনের উপান্তে এসে মৃত্যু অনুভব নিয়ে ‘পিস হেভন’ করতে গিয়ে কী ভাবে এই তিন দাপুটে অভিনেতাকে এক সঙ্গে নিয়ে এলেন সুমন? “আমি যখন চিত্রনাট্য লিখি তখন থেকেই ঠিক করে নিই কে কোন চরিত্র করবেন। সেই ভাবেই এই তিন বন্ধুর চরিত্র এঁকেছি আমি। সৌমিত্রকাকু যেমন এই ছবিতে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আসা একজন মানুষ, কিছুটা অ্যারোগেন্ট। তেমনি পরাণকাকু পাউরুটির ব্যবসা করে বড়লোক হয়েছে কিন্তু ঠিক স্টেটাসটা নেই। অরুণকাকু বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছেন। বাঙাল ভাষায় কথা বলেন। কিছুটা ভীরু প্রকৃতির। কিন্তু তিনজনে দারুণ বন্ধু। ওঁদেরই এক বন্ধুর মৃত্যুর পর ছেলে যখন এসে সময় মতো সত্কার করতে পারে না, মৃতদেহ কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে সংশয় হয়। তখন মৃত্যুর পর সঠিক ঠিকানায় দেহ রাখার একটা নতুন স্বপ্ন এসে দানা বাঁধে। এই স্বপ্নের পুরোধা সৌমিত্রকাকু।”
কিন্তু মৃত্যু নিয়ে ছবির কথাটা মাথায় এল কী ভাবে? “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন মারা যান ওঁর ছেলে বিদেশে। সেই ঘটনা থেকেই গল্পটার কিছুটা সূত্রপাত। চিনি সল্টলেকের একদল মানুষকে যাঁরা মৃতদেহ সংরক্ষণাগার তৈরির পরিকল্পনা করছেন। জীবন, বাস্তব। দর্শন। স্বপ্ন সবই মিলে গিয়েছে এই ছবির কেন্দ্রবিন্দুতে কী ভাবে সেটা ছবি শেষ না হলে বোঝা যাবে না,” হেসে বলেন সুমন।
কথা শেষ না হতেই সুমন আবার ছুটে যান ফ্লোরে। শট রেডি হচ্ছে।
কাহিনির নিজস্ব ছাপ আনতে বাড়ির চেহারায় কিছুটা রদবদল করেছেন শিল্প নির্দেশক ইন্দ্রনীল ঘোষ। সাবেকি আসবাব জোগাড় করেছেন। যেহেতু প্রেক্ষাপটে থাকছে মৃত্যু, তাই কুশন কভার, ছবি, আসবাবের রং সব কিছুতেই ছড়িয়ে আছে সাদা- কালো ধূসর রঙের প্রলেপ। যোগাড় করেছেন প্রচুর বই। সেই সাদা-কালো ধূসরতার মধ্যেই আবার আলো জ্বলে উঠল।
নাট্যপরিচালক অরুণ মুখোপাধ্যায়ের ছোট ছেলে সুজন মুখোপাধ্যায়। একই ছবির শ্যুটিংয়ে হাজির পিতাপুত্র। সুজনের প্রচণ্ড সর্দি। সস্নেহে অরুণ জিজ্ঞেস করলেন, “ওষুধ খেয়েছিস! কেমন লাগছে শরীরটা এখন!”
এ হেন সুজন এই ছবিতে সদ্যমৃত প্রণবের ছেলে অনির বন্ধু। তাকেই এখন সামলাতে হচ্ছে বন্ধুর বাবার শেষকৃত্যের সব দায়। সুজন ছবিতে একজন সফট-ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে সুমনের হাতে চলতে থাকে দুটো মোবাইল। দুই মোবাইল কানে দিয়ে ডায়লগ দু’রকম “পিস হেভন খালি নেই। রিজার্ভড। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ফোন তুলছে না।’ আবার অন্য মোবাইলে অফিসের সহকর্মীকে বলছেন, “হোয়াট? কাস্টমার ডেটাবেস ডিলিটেড? ইডিয়ট! ননসেন্স! কে করল? নতুন ছেলেটা প্র্যাকটিস করতে গিয়ে কেলো করেছে। ওকে, ওকে লেট মি থিঙ্ক।” মৃত্যুর ধূসরতার পরিবেশে সুজন এক প্রাণের প্রতীক। জীবন যে বয়ে চলেছে। কোথায় থেমে থাকে না দৈনন্দিন। এই সত্যকে যেন মিলিয়ে দিয়ে সুজন বললেন, “আমার কাছে দুর্দান্ত একটা অভিজ্ঞতা এই তিন জন স্টলওয়ার্টের সঙ্গে কাজ করা।”
নীচের ঘরে আবার বিশ্রাম নিতে যান সৌমিত্র, পরাণ, অরুণ। খাওয়াদাওয়ার ফাঁকে পরাণ বলেন, “এর আগে সুমন অন্য একটা ছবির জন্য বলেছিল। কিন্তু করতে পারিনি। এই বার সুমন বলল, ‘পরাণকাকু তোমাকে করতেই হবে। না শুনব না। চিত্রনাট্য শুনে মনে হল অসাধারণ ভাবনা আর কল্পনাকে রূপ দিতে পারে সুমন।” সৌমিত্র পাশ থেকে বলেন, “সুমনের ভাবনার একটা স্টাইল তো আছেই। ছবিতে বয়স্কদের মৃত্যু নিয়ে যে সমস্যাটার প্রসঙ্গ সেটাও খুব সমসাময়িক। রোজই এমন হচ্ছে।” অন্য দিকে অরুণ মুখোপাধ্যায় বলছেন, “আমার কাছে গল্পের একটা টান তো ছিলই। তার সঙ্গে ভাবলাম আমি, পরাণ, সৌমিত্রবাবু এক সঙ্গে কাজ করব। সেটাও একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। ছবিটার মধ্যে একটা দর্শন আছে সেটা আমাকে নাড়া দিয়েছে।”
সেই দর্শন কী? লাঞ্চের অবসরে সুমন বললেন, “দর্শনটা জীবন আর মৃত্যুর এই সন্ধিক্ষণ নিয়েই। শেষ পর্যন্ত ছবিটা শেষ হয় জীবন-মৃত্যুর একটা সমন্বয় ঘটিয়ে পরাবাস্তবের মধ্যে।”
ইতিমধ্যে এসি বিশ্রাম ঘর থেকে ভেসে এলো গান। সৌমিত্র-পরাণ-অরুণেরা মিলে গান ধরেছেন। অরুণ বললেন, “আমি এর পর তারাশঙ্করের ‘কবি’ নাটক করছি। সেই ‘কবি’ তো ছবিও হয়েছিল। সে ছবিরই গান এটা।” বলে আবার শুরু করেন ত্রয়ী প্রায় কোরাসে, “জীবনে যা মিটিল নাকো/ মিটিবে কি তা মরণে/ এ জীবনে ঝরল যে ফুল”। গান বিভোর হয়ে যান তিন নট। সেই সুরের পরিমণ্ডলে দাঁড়ালে মনে হবে না মৃত্যুর পরের অনিশ্চয়তা নিয়ে এক ছবির শ্যুটিং করতে এসেছেন তাঁরা।
আড্ডা আর দুপুরের বিশ্রাম শেষ। ক্যামেরায় চোখ রেখে অপেক্ষা করছেন সিনেমাটোগ্রাফার সন্দীপ ঘোষাল। শুরু হয়ে গেল নতুন একটা টেক। তিনবৃদ্ধই হাজির।
পরাণ বললেন, “ডাক্তারবাবু কী যেন বলে গেল। পিস হেভ্ন না কি যেন?’
সৌমিত্র: উফফফ হেভেন নয় হাভেন। পরে বুঝিয়ে বলব।
পরাণ: ও তার মানে প্রণব ছেলে আসা অবধি হেভেনে থাকবে। তাই বলো।
সৌমিত্র: আরে বাবা হেভেন নয় হাভেন এইচ এ ভি ই এন।
মৃত্যুর মুখেও যেন রসিকতার হাসি! বেরিয়ে আসতে আসতে মনে হল মৃত্যু আর জীবন তো একই গানের দুটি ছন্দোময় শব্দ। নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু তালে তালে....
‘পিস হেভন’র সুর কি সেই তালেই বাঁধা পড়বে? জানেন শুধু সুমন। ওঁদের পরাবাস্তবের শ্যুটিংটা হবে তাজপুর বা মুকুটমণিপুরে। সেখানেই যে আসল নাটক! নাটক নয়। এ ছবির আসল দার্শনিক উপলব্ধির প্রহর তৈরি হবে সেইখানেই।
“ছবিতে বয়স্কদের মৃত্যু নিয়ে যে সমস্যাটার প্রসঙ্গ সেটাও খুব সমসাময়িক।
রোজই এমন হচ্ছে। সেই জন্যই গল্পটা আমার ভাল লেগেছে”
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
“সুমন বলল, ‘পরাণকাকু এবারের ছবিটা করতেই হবে’।
চিত্রনাট্য শুনে মনে হল ভাবনা আর কল্পনাকে রূপ দিতে পারে সুমন”
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
“ভাবলাম পরাণ, সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে কাজ করব এক ছবিতে। একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে”
অরুণ মুখোপাধ্যায়