প্রকৃত অভিভাবক কে, জানে পোস্ত

সোনাঝুরি...ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ...লালমাটি...ছাতিমতলা...উপাসনাগৃহ ভেসে যাচ্ছে ‘পোস্ত...পোস্ত’ ডাকে! ভেসে যাচ্ছে শালের জঙ্গল...জোনাকির দল...সে ডাক শোনার সময় কোথায় তখন সেই ছেলের?

Advertisement

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৭ ০০:০০
Share:

পোস্ত

Advertisement

পরিচালনা: শিবপ্রসাদ-নন্দিতা

অভিনয়: সৌমিত্র, লিলি, যিশু, মিমি, অর্ঘ্য

Advertisement

৭.৫/১০

সোনাঝুরি...ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ...লালমাটি...ছাতিমতলা...উপাসনাগৃহ ভেসে যাচ্ছে ‘পোস্ত...পোস্ত’ ডাকে! ভেসে যাচ্ছে শালের জঙ্গল...জোনাকির দল...

সে ডাক শোনার সময় কোথায় তখন সেই ছেলের? ততক্ষণে সে ছুড়ে ফেলছে বেতের ঝাঁপি, রং পেন্সিল, বালিশ— আরও কত কী যে! এ ঘর থেকে ও ঘরে, বাগানে বাগানে সে দাপিয়ে বেড়ায় তার শৈশবের অমরত্ব নিয়ে!

সাত বছরের পোস্তকে নিয়ে তার ঠাকুরদা আর ঠাকুমা, দীনেন লাহিড়ী ও গৌরী দেবীর পৃথিবী। পোস্তর বাবা অর্ণব ও ‘মাম্মাম’ সুস্মিতা জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত কলকাতায়। পোস্ত বড় হওয়ার সময় তাদের কাছে সন্তানকে রাখা সম্ভব হয়নি। আধুনিক দম্পতি নিজেদের কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে আর পোস্ত বেড়ে উঠেছে শান্তিনিকেতনে, তার ‘গুরুজি’ দীনেন আর ‘মা’ গৌরীর কাছে। অন্য ছেলেমেয়েদের মতো পোস্তও গানের ক্লাসে তার ঠাকুরদার ছাত্র। ফলে ঠাকুরদা তারও ‘গুরুজি’। প্রৌঢ় এই দম্পতির পৃথিবী আবর্তিত হয় পোস্তকে ঘিরে। আর পোস্তর রঙিন, কল্পনা ঘেরা, অনাবিল শৈশব পায়ে পায়ে হাঁটতে থাকে তাদের হাত ধরে।

পোস্তর বাবা-মা শান্তিনিকেতনে আসে উইকএন্ডে। পোস্তর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটায়। বাবা-মায়ের সঙ্গে পোস্তকে নিয়ে অর্ণব-সুস্মিতার টানাপড়েন চমৎকার ফুটে উঠেছে ছবির অসংখ্য ফ্রেমে।

তার পর? একদিন তার অভিভাবকত্ব নিয়ে টানাপড়েন পৌঁছয় আদালত পর্যন্ত। পোস্তকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে চিত্রনাট্য।

তার সঙ্গে গল্প করতে করতে ‘গুরুজি’র পথ চলা যেন জীবনপথের এক পরিক্রমা। গোল্লা করে করে নাতির মুখে যখন ভাত তুলে দেয় ‘মা’, সেই দৃশ্য যেন মুহূর্তে সর্বজনীন হয়ে ওঠে! এ রকমই অজস্র সর্বজনীন মুহূর্ত গোটা ছবি জুড়ে উপহার দিয়েছেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়। কখন যেন সে সব ফ্রেম আরও অজস্র জীবনের ফ্রেম হয়ে ওঠে!

পোস্তর অভিভাবকত্বের অধিকার কার? তার ‘বায়োলজিক্যাল’ বাবা-মায়ের, না কি যাদের কাছে সে বেড়ে উঠেছে, হাসি-কান্না-সৃষ্টি ভাগ করেছে, সেই ঠাকুরদা-ঠাকুমার? উপাসনাগৃহে তার গান গাওয়ার সময় বাইরে অপেক্ষায় থাকে যে ‘গুরুজি’ ও ‘মা’, স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে ঘুম থেকে ওঠার পর পোস্তকে নিয়ে খেলার মাঠে যায় যে ঠাকুরদা, তার রেজাল্ট বেরোনোর দিন যারা মুখোমুখি হয় শিক্ষিকাদের, নাতিকে নেওয়ার আগে স্কুলের বাচ্চাদের অসমবয়সি মায়েদের সঙ্গে আড্ডায় মাতে যে ঠাকুমা, সেই তাদের কাছ থেকে পোস্তকে নিজেদের হেফাজতে নিতে যাওয়ায় সম্পর্কের টানাপড়েন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে গোটা ছবি জুড়ে।

অভিনয়-জীবনের দীর্ঘ পথ পেরোনোর অবসরে বহু অসামান্য চরিত্র উপহার দিয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এ ছবিতে তাঁর অভিনয় সেই তালিকার উপরের দিকে থাকবে। যে দক্ষতায় ‘গুরুজি’র স্নেহ, অসহায়তা, কান্না, নির্ভরতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন সৌমিত্র, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। তাঁর সঙ্গে অনবদ্য যুগলবন্দি লিলি চক্রবর্তীর। উচ্চকিত অভিনয় না করেও ভিন্ন মাত্রায় গৌরীকে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। এঁদের পাশাপাশি তাল মিলিয়ে অভিনয় করেছেন বাড়ির পরিচারিকার ভূমিকায় দেবলীনা দালাল।

যত দিন যাচ্ছে আরও পরিণত হচ্ছেন যিশু সেনগুপ্ত। অর্ণবের চরিত্রের হাসি-কান্না, মানসিক চাপ, বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর পোস্তর অভিভাবকত্ব ঘিরে একরাশ বিদ্বেষ, যিশু এক কথায় অসাধারণ! মিমি চক্রবর্তীকেও অন্যান্য বাণিজ্যিক ছবিতে সাধারণত যেভাবে দেখা যায়, এখানে তাঁর চরিত্র সেই ধারার একেবারে উল্টো। সুস্মিতার ক্ষতবিক্ষত মনটাকে আরও অজস্র মায়ের মধ্যে চারিয়ে দিতে পেরেছেন তিনি। এই ছবির আরও এক সেরা আবিষ্কার পরান বন্দ্যোপাধ্যায়! পোস্তর ঠাকুরদার বন্ধু, আইনজীবী অলোকরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ওরফে ‘আলুদা’র ভূমিকায় চমক দিয়েছেন তিনি। কোর্টরুমের অজস্র টানটান বাঁক তৈরি করে দেওয়া থেকে শুরু করে, নানা ছোট ছোট মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন পরান। এই কোর্টরুমেরই আর এক পাওনা আইনজীবী নিবেদিতার ভূমিকায় সোহিনী সেনগুপ্তর অসাধারণ অভিনয়। ছোট্ট ভূমিকায় বাবুল সুপ্রিয় এবং বিচারকের ভূমিকায় সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় নজর কাড়বেন।

গোটা ছবি জুড়ে আলো ছড়িয়ে দিয়েছে পোস্তর ভূমিকায় ছোট্ট অর্ঘ্য। ছবির শেষ কথাটি সে-ই বলেছে! পরদা জুড়ে তার উপস্থিতি। না বুঝেই দিকপাল অভিনেতাদের সঙ্গে খেলার মতো করে অভিনয় করে যাওয়া পরিচালনার মুনশিয়ানাকেই সামনে আনে। হেলিক্যামের ব্যবহারে কিছু দুর্ধর্ষ ফ্রেম উপহার দিয়েছেন তাঁরা। অনুপম রায়-অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের সংগীতের সম্ভার সম্ভ্রান্ত করেছে এ ছবিকে। চমৎকার গেয়েছেন নচিকেতা ও অনুপম।

সেই ‘ইচ্ছে’ থেকে শুরু করে আজকের ‘পোস্ত’— একের পর এক বিষয়-বৈচিত্রের উপহারে ধীরে ধীরে নাগরিক কবিয়াল হয়ে উঠছেন শিবপ্রসাদ-নন্দিতা।

ছবি নয়, ‘পোস্ত’ কখন যেন গোটা একখানা কবিতা হয়ে উঠল!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement