চিত্রকর
পরিচালনা: শৈবাল মিত্র
অভিনয়: ধৃতিমান, অর্পিতা, দেবদূত, শুভ্রজিৎ
৬/১০
প্রাচীন বনাম নবীন। কৃষ্টি বনাম পণ্য।
এই দুই দ্বন্দ্ব শিল্পক্ষেত্রে চিরন্তন। তবে শিল্পীর সৃষ্টি মানে না এই দ্বন্দ্বের বাঁধন। কিংবদন্তি শিল্পীদের সৃজন তা ছিঁড়ে ফেলে। তাই সেই শিল্পকর্ম শাশ্বত। সেই সৃজনকে বাঁধা যায় না দেশ, কালের সীমা দিয়ে।
এমনই দু’জন কিংবদন্তি শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় এবং মার্ক রথকো। একই সময়ে বিশ্বের দুই প্রান্তে তাঁরা কাজ করেছেন। বিনোদবিহারী বাংলা এবং ভারতে। রথকো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। শৈবাল মিত্রের ছবি ‘চিত্রকর’ এই দুই শিল্পীকেই শ্রদ্ধার্ঘ্য। সেই সঙ্গে আর এক কিংবদন্তি, বিনোদবিহারীর ছাত্র, সত্যজিৎ রায়কেও স্মরণ করেছেন পরিচালক।
দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও অমর শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছিলেন বিনোদবিহারী। কারণ শিল্পীর ‘অন্তর্দৃষ্টি’ তাঁর ছিল। সত্যজিৎ তাঁর তথ্যচিত্র ‘ইনার আই’-তে নিজের শিক্ষকের এই সত্তাকে তুলে ধরে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। কিন্তু এই সময়ে শিল্পের প্রতি, সৃজনের প্রতি এই শ্রদ্ধার অস্তিত্ব কি আছে? আজকের দর্শক কি পারেন ‘ভাললাগা’ আর ‘শ্রদ্ধা’র মধ্যে ফারাক করতে? প্রশ্ন তুলেছেন শৈবাল।
ছবিতে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তিথিকে (অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়)। প্রশ্ন করেন শিল্পী বিজন বোস (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়)। বিজনের চরিত্রে পরিচালক মিশিয়ে দিতে চেয়েছেন বিনোদবিহারী ও রথকোর জীবন, দর্শন। ছবিকে এনেছেন আজকের সময়ে। সেই সময়ের ঘূর্ণিতে দিশাহারা শিল্পী তিথি। পলাশের (দেবদূত ঘোষ) মতো ব্যবসাসর্বস্ব আর্ট কিউরেটরদের প্যাঁচে যে ছবি আঁকা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে বাধ্য হয়। বিজনের সঙ্গে তিথির আলাপচারিতাই ছবির গতিপথ।
সেই পথে দর্শকের যাত্রা কিছুক্ষণ আকর্ষক। যতক্ষণ সেই পথে তিথি ও বিজনের কথোপকথন আজকের সমাজচিত্রকে মনে পড়ায়। ধরিয়ে দেয় আজকের চটজলদি জনপ্রিয়তার যুগে শিল্পীর সাধনা, একাগ্রতা কতটা দুর্লভ। ঝটিতি উন্মাদনার এই সময়ে সৃজনের গভীরতার সন্ধান পাওয়া ভার। শিল্পী হওয়া এখন যেন বড়ই সহজ!
কিন্তু এই পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাড়তি সংলাপ ও দৈর্ঘ্য। কেবল শিল্প বা তার দর্শন নয়, একই সঙ্গে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকেও ধরতে চান পরিচালক। তাতেই বক্তব্যের ভার বাড়ে। সেই বোঝা রুদ্ধ করে ছবির নিজস্ব ভাষা, গতি। দর্শকের সঙ্গে যেন ছবির দূরত্ব তৈরি হয়। কেবল অতীতের ভাবনা নয়, আজকের শিল্পীদের জীবনের দ্বন্দ্ব কেমন, তাঁরা তা মোকাবিলা করেন কী ভাবে তা বিশদে জানার চাহিদা থেকে যায়।
অভিনয়ে ধৃতিমান অসাধারণ। কেবল সংলাপ বলার ভঙ্গিই নয়, তাঁর শরীরী ভাষা প্রতিটি দৃশ্যে ছবিকে প্রাণবন্ত করেছে। যোগ্য সঙ্গত করেছেন অর্পিতা। কখনও উদ্ধত, কখনও অসহায়, কখনও ক্লান্ত, কখনও উৎসুক একটি চরিত্রে সাবলীল তিনি। বাকি সব চরিত্রেই দেবদূত ঘোষ, শুভ্রজিৎ দত্ত-সহ অন্য অভিনেতারা যথাযথ। অশোক দাশগুপ্তের চিত্রগ্রহণ ও সুমিত ঘোষের সম্পাদনা চমৎকার। এই দুইয়ের গুণেই ছবি অনেকটা ভারহীন লাগে। ছবির পালে হাওয়া দিয়ে তাকে এগিয়ে নিয়ে চলে পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের সংগীত, যা এই ছবির প্রাপ্তি।
আর প্রাপ্তি পরিচালকের, প্রযোজকের এমন বিষয়ে ছবি করার সিদ্ধান্তটি। যে সব জীবনের গল্প বড় পরদায় আমরা দেখি, তার মধ্যে শিল্পীদের জীবনের গল্প বড়ই কম। বাংলা তো বটেই, গোটা দেশেই। সেখানে শিল্পীদের জীবন, চিন্তাকে ধরার এই প্রয়াসটি প্রশংসার্হ বটেই।