আবছায়া: ‘ভবিষ্যতের ভূত’এর সেট। তপন শেঠের তৈরি। নিজস্ব চিত্র
প্রশ্ন: আপনার ছেলেবেলার কথা বলুন। বাড়ি কোথায় ছিল?
উত্তর: আমার বাড়ি ছিল হলদিয়ার বিশ্বনাথ দত্ত চক। বাবা জীবনকৃষ্ণ শেঠ। মা প্রমীলা শেঠ। আমার জন্মের তিন মাস পর বাবা মারা যান। মা ছিলেন একটি স্কুলের অশিক্ষক কর্মী। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। আত্মীয়েরা প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন। পথে বসলাম।
প্রশ্ন: এইটুকু বয়সে পিতৃ-মাতৃ হীন! লড়াই তো সাংঘাতিক করতে হয়েছে?
উত্তর: আক্ষরিক অর্থেই তো রাস্তায় নামতে হল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মহা সমস্যায় পড়লাম। থাকার কোনও জায়গা ছিল না। দিনে স্কুল করতাম আর সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম। আমার বন্ধু প্রদীপ পাল, বিশ্বজিৎ মণ্ডল, দীপক পণ্ডা, সদানন্দ সাহু খুব সাহায্য করেছিল। এদের কেউ কেউ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল।
প্রশ্ন: খুব কঠিন সময়।
উত্তর: আমার এরকম অবস্থা দেখে হলদিয়া বন্দরের এক কর্মী আমাকে তাঁর বাড়ির বারান্দায় নিয়ে গিয়ে রাখলেন। বিনিময়ে তাঁর বাড়ির মেয়েদের পড়াতে হত।
প্রশ্ন: এ ভাবে কি পড়াশোনা চলে?
উত্তর: দুঃসময়ে এগিয়ে এলেন আমার স্কুলের শিক্ষক–শিক্ষিকারা। শিখা দে বিশ্বাস, রত্না আলেকজান্দার, নীলাভ দাশগুপ্ত স্যার মিলে আমার জন্য টাকা তুলে দিলেন। শুধু তাই নয়, স্কুলের ফি মকুব করার উদ্যোগও নিলেন। আরও কয়েকজন শিক্ষক সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু সারাদিনের ভাত জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হল। বসতি এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিলাম ৫০ টাকা দিয়ে। আঁকা শিখতে লাগলাম। নাম হল। আঁকার স্যরের কাজ করে পড়াশোনা চালাতাম।
প্রশ্ন: রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফ্ট নিয়ে পড়েছেন। সমস্যা হয়নি?
উত্তর: হলদিয়া রিফাইনারির এক চিকিৎসকের বাড়িতে আঁকা শেখাতে যেতাম। তিনি পড়ার জন্য দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, টাকাটা যেন আমি উচ্চশিক্ষার জন্য কাজে লাগাই। প্রথম কলকাতায় গিয়েছিলাম নীলাভ স্যারের হাত ধরেই। তিনিই আমাকে প্রথম রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় দেখিয়েছিলেন। মনে জেদ ছিল, আমাকে এখানে পড়তেই হবে। সেই স্বপ্ন কোনও দিনই পূরণ করতে পারতাম না যদি স্যার না থাকতেন।
প্রশ্ন: কলকাতা সফরের কথা একটু বলুন?
উত্তর: আড়াই বছর খুব কষ্টে কেটেছে। কলকাতায় থাকার জায়গা ছিল না। রোজ যাতায়াত করতাম। ট্রেনে যাওয়ার মতো টাকা থাকত না। বহুবার ট্রেনে বিনা টিকিটে ধরা পড়েছি। আমাকে আটকে রাখত। পরে চেকারদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়। ওঁরা আমার জীবনের গল্প জেনে দয়া করেন। বিনা টিকিটে যাতায়াতের আসল কারণ জেনে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। আমার আঁকা দেখতেন। হাওড়া স্টেশনে আমি লাইভ স্টাডি করতাম। চেকারদের প্রশ্রয় পেয়েছিলাম। তবে এই পর্বে বহুদিন খাওয়া জুটত না।
প্রশ্ন: অবস্থা বদলাল?
উত্তর: রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্ট নিয়ে পড়াশোনা শেষে গ্রামে ফিরলাম। ফিরে আসার পর তো বিভিন্ন জায়গায় চাকরি পাই। আঁকার স্যারের চাকরি। সেই সময় চুটিয়ে আঁকার টিউশন করতে থাকি। একটি বিএড কলেজ, জনশিক্ষণ-সহ একাধিক চাকরি পাই। বাড়ি করি। গাড়ি হয়। অবস্থা বদলে যাতে থাকে।
প্রশ্ন: তা হলে হলদিয়া ছাড়লেন কেন?
উত্তর: ক্ষমতা বদলের সময় রাজনৈতিক অস্থিরতায় হলদিয়া ছাড়তে হয়। বাড়িঘর বিক্রি করে দিতে হয়েছিল জলের দরে। গাড়ি বিক্রি হল। কিন্তু টাকা পেলাম না। কলকাতায় এসে আবার সেই পথে বসার উপক্রম। বাড়ি বিক্রির টাকায় ধার দেনা শোধ হল। ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। দোকানে দোকানে ফুলের কাজ করি, তত্ত্ব সাজাই, বেলুনের গেট করি। টিউশন করি। সংসার চলে না। মেয়ের পড়া বন্ধ হয়ে গেল দু’বছর।
প্রশ্ন: আবার লড়াই শুরু হল?
উত্তর: অটো চালানো শিখলাম। চৌরাস্তা থেকে টালিগঞ্জ অটো চালাব বলে অটো কিনব বলে একজনের সঙ্গে কথা হল। আড়াই লক্ষ টাকা লাগবে। কিন্তু নানা কারণে সেটাও হল না।
প্রশ্ন: যাকে চলতি ভাষায় বলে সিনেমা লাইন, মানে টলি পাড়ায় যোগাযোগ কী ভাবে?
উত্তর: আমার আঁকার এক ছাত্রীর দূর সম্পর্কের আত্মীয় টালিগঞ্জে কাজ করতেন। ওঁরাই আমাকে বললেন, স্যার ফিল্ম লাইনে কাজ করবেন। রাজি হয়ে গেলাম। ওঁদের রেফারেন্স নিয়ে গেলাম নাট্যকার চন্দন সেনের কাছে। তিনি যোগাযোগ করিয়ে দিলেন এক আর্ট ডিরেক্টরের সঙ্গে। কাজ করতে গেলাম ফাইফরমাশ খাটার। ‘বেহুলা’ সিরিয়ালের সেটেই তিন মাস কাজ করলাম। কিন্তু পণ্ডশ্রম হল। যেহেতু আমি গিল্ডের সদস্যপত্র পাইনি তাই টাকা পেলাম না। সেই সময় এক ডিরেক্টর সনৎ দত্ত গিল্ডের কাজের ব্যবস্থা করেদিলেন। নিয়ম অনুযায়ী ৭৫০০ টাকা দিয়ে সদস্যপদ নিলাম। গিল্ডের সম্পাদক শতদল মিত্র আমাকে সাহায্য করলেন। তাঁর চেষ্টাতেই টলি পাড়ায় কাজ পেলাম। অল্প কিছু টাকাও পেতে শুরু করলাম। এরপর যোগাযোগ হল বাংলা সিনেমার নামী আর্ট ডিরেক্টর তন্ময় চক্রবর্তীর সঙ্গে। ওঁর সহকারী হিসেবে কাজে যোগ দিলাম। অনেক কিছু শিখলাম। সিনেমা জগতের ফ্লোর ছিল এক অচেনা জগত। সেই জগতেরই একজন হয়ে যাব তা ভাবতে পারিনি।
প্রশ্ন: কতগুলো সিনেমায় শিল্প নির্দেশকের কাজ করেছেন?
উত্তর: অল্প সময়ের মধ্যেই কিন্তু অনেকগুলো ছবিতে কাজ করা হয়ে গেল। শুধুমাত্র শিল্প নির্দেশক হিসেবেই ৪৯টি সিনেমা এবং ২২টি বড় মাপের বিজ্ঞাপনে কাজ করলাম।
প্রশ্ন: উল্লেখযোগ্য কোন কোন সিনেমায় শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন?
উত্তর: ‘বোস ডেড/অ্যালাইভ’ ওয়েবসিরিজে শিল্প নির্দেশনার কাজ করেছি। রাজকুমার রাও অভিনয় করেছেন। স্বাধীনতার আগের পরিবেশ তৈরি করতে খুব খাটতে হয়েছে। সব হয়ে যাওয়ার পর মনে হচ্ছিল, সত্যি আমি বোধহয় ফিরে গিয়েছিলাম ৪৭ সালের আগে। গায়ে কাঁটা দিত। ভারত–বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় রেশমি মিত্রর ‘হঠাৎ দেখা’য় শিল্প নির্দেশনা করেছি। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘ভিঞ্চিদা’ সিনেমায় শিল্প নির্দেশনা দিয়েছি। ইন্দ্রাশিস আচার্যের ‘পিউপা’ ছবিটি ২০১৮ সালে বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের বিচারে সেরা সিনেমা. আমার শিল্প নির্দেশনা।
প্রশ্ন: অস্কারে গিয়েছিল কোন সিনেমা?
উত্তর: ‘রক্তকরবী’। এই সিনেমায় আমার শিল্প নির্দেশনা প্রশংসিত হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার পর প্রথম কোনও বাংলা সিনেমা অস্কারের দৌড়ে ছিল। এ ছাড়া ‘অন্তর কাহিনী’ ২০১৮ সালে ‘কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে’ দেখানো হয়। এতেও আমার শিল্প নির্দেশনা রয়েছে।
প্রশ্ন: সাম্প্রতিক কোনও কাজের কথা যদি বলেন?
উত্তর: মৈনাক ভৌমিকের ‘বর্ণপরিচয়’ সিনেমায় আমার কাজ রয়েছে। এছাড়া ‘তৃতীয় অধ্যায়’ ও ‘ভবিষ্যতের ভূতের’ আর্ট ডিরেক্টর আমি।
প্রশ্ন: ‘ভবিষ্যতের ভূত’এর অভিজ্ঞতা?
উত্তর: ভূত নিয়ে সিনেমাটি দারুণ। আগামী দিনের ভূত কেমন হবে তা নিয়েই ছবি। খুব মজার। প্রথমেই বুঝেছিলাম সিনেমাটা দারুণ হবে। রানিকুঠির কাছে মধুবন সিনেমা হলে সেট ফেলা হয়েছিল। ১৮টি ম্যাটাডর ভরে আসবাবপত্র আনা হয়েছিল। পুরনো দিনের আসবাব। তিনদিন ধরে বানালাম। সেট বিভিন্ন জোনে ভাগ করা হয়েছিল। একটি অংশে ভূতেদের অনলাইন প্রোগ্রামের জোন করা হয়েছিল। হাড়, খুলি দিয়ে বানানো। পুরনো দিনের বারের সেট বানিয়েছিলাম। ৩০০ জন নানা পেশার লোক আমার কাছে কাজ করছেন। সেট তৈরি করা, ডিজাইন করা খুব চাপের। কিন্তু এই কাজটি আমি উপভোগ করছি। পরিচালক অনীক দত্ত সেট দেখে খুশি। পরিচালক বলেছিলেন, যদি সিনেমা চলে তুমি পুরস্কার পেতে পারো।
প্রশ্ন: আরেকটু অভিজ্ঞতা?
উত্তর: আগে সিনেমার প্রচারে হাতে আঁকা ছবি ব্যবহার হত। পরিচালক প্রথমে বলেছিলেন, পোস্টারে যেন পোট্রেট না মেলে। আমার দলের শিল্পীরা সেই ভাবেই মুখ আঁকলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে উনি চাইলেন পোস্টারে মুখ মিলুক। উনি সেদিন শ্যুটিং বন্ধ করে দিতে চাইলেন। আমি বললাম, আপনি তখন বলেছিলেন মুখ যাতে না মেলে। আধঘণ্টা সময় চেয়েছিলাম। নিজে তুলি ধরে ছবি এঁকে দিই। পরিচালক অবাক হয়েছিলেন। উনি জানতেন না আমি ছবি আঁকি। আমার ছবির প্রদর্শনী হয়। আমি একটি শটও দিই।
প্রশ্ন: ভূতেদের ভবিষ্যৎ তো ভাল নয়?
উত্তর: হ্যাঁ। সিনেমাটি বন্ধ হয়ে গেল। সেন্সরের ছাড়পত্র পাওয়ার পর বন্ধ হয়ে যাওয়া দুর্ভাগ্যের।
প্রশ্ন: হিন্দি সিনেমায় কাজ?
উত্তর: হিন্দিতেও একাধিক সিনেমায় শিল্প নির্দেশনা দিয়েছি। এর মধ্যে সোনাক্ষী সিংহ এবং রণবীর সিংহ অভিনীত ‘লুটেরা’ সিনেমায় আমি সহ-শিল্প নির্দেশকের কাজ করেছি।
প্রশ্ন: হলদিয়ার স্মৃতি বেদনা দেয়?
উত্তর: হলদি নদীকে খুব মিস করি। দু’টি পোষা কুকুর ছিল। একটি ডালমেশিয়ান ও অন্যটি ল্যাব্রাডর। হলদিয়া ছাড়ার সময় একটি মারা যায়। আর একটি আমার পশু চিকিৎসককে দিয়ে চলে আসি। চলে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই সে-ও মারা যায়। থাকার জায়গা ছিল না তাই ওদের আনতে পারিনি। আর কুকুর পোষা হয়নি।
প্রশ্ন: সৌরভের পাড়ায় ফ্ল্যাট, টালিগঞ্জে অফিস, গাড়ি। সফল?
উত্তর: জানি না। তবে আমি পরিতৃপ্ত। হলদিয়া থেকে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে জার্নিটাই তো স্বপ্নের মতো। পথে বসা মানুষের কাছে এটাই তো পুরস্কার।