সময় দেওয়া হল রাত আটটা! সে দিনই বিকেলে হঠাৎ উড়ে আসা এসএমএস যে আইএসটি রাত আটটাতে নাকি আনন্দplus-কে লং ডিসট্যান্স ফোন ইন্টারভিউয়ের জন্য টাইম দিয়েছেন বরিস বেকার।
মেসেজটা বিশ্বাস করা যাচ্ছিল না, যেহেতু গত সাড়ে সাত মাস একই মাধ্যমে অ্যাপয়েন্টমেন্টটার পিছনে মরীচিকার মতো ছুটে দৌড়টা থামিয়ে দিই। কোনও প্রশ্নপত্র তৈরি ছিল না। যে জিনিসটা ঘটবেই না, তার জন্য আর তোড়জোড় করে লাভ কী! বেকারের ভারতীয় ব্যবসায়িক সহযোগী এ বার ফোনে। জানালেন সময় বরাদ্দ মিনিটকুড়ি। এর চেয়ে বেশি বাড়ানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। পেশাদার শর্ত মেনে এই সাক্ষাৎকার হচ্ছে না। বলতে গেলে নিছক চ্যারিটি করছেন বেকার। কাজেই অনেক কিছু প্রশ্ন যে করা যাবে না, তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।
আর ফোনটা নাকি বেকার নিজেই করবেন। ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রিটিরা অবশ্য এই টেকনিক নিয়মিত ব্যবহার করে থাকেন। প্রাইভেট নম্বর এঁরা সাংবাদিকের সঙ্গে শেয়ার করতে চান না। তাই এঁদের বৈশিষ্ট্য হল নিজেরা বা কোনও সহযোগীর নম্বর থেকে ফোন করে নেওয়া। যেখানে সাংবাদিকের ফোনের ওপর ভাসে ‘প্রাইভেট নম্বর’। ফোন ইন্টারভিউ শেষ তো সাংবাদিকের সঙ্গে সম্পর্কও শেষ। কারণ তার তো আর মহাতারকার নম্বর জেনে ভবিষ্যতে এসএমএস পাঠানোরও সুযোগ থাকছে না।
বেকার মানেই চিরাচরিতভাবে ব্যতিক্রম আর নাটক। তাঁর সহযোগী আচমকা ওঁর ব্যক্তিগত নম্বরটা পাঠিয়ে দিলেন। উনি নাকি নিজের ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল নম্বরটা দিতে রাজি হয়েছেন। বলা হল, ঠিক আটটায় প্রথমে টেক্সট করে উত্তর পাওয়ার পর ফোন করবেন।
সাড়ে সাত মাস ধরে ওয়েট করেছি। মনে এখনও ভাসছে পঁচাশির উইম্বলডন ফাইনালে উড়ে গিয়ে সব অ্যাক্রোব্যাটিক রিটার্ন আর ভলি। মনে হল এসএমএস চুলোয় দিয়ে স্ট্রেট ফোনই করা যাক। প্রথমবার না ধরলে না হয় টেক্সট করা যাবে।
‘‘ইয়েস, দিস ইজ বরিস বেকার,’’ দু’টো রিং বাজতেই টেলিভিশনে বহুবার শোনা সেই গলা।
মিস্টার বেকার, শুরুতেই একটা কথা বলি, আমাদের এখানে এমন এক উপদ্রব হয়েছে যা আপনার সার্ভ আর ভলির চেয়েও মারাত্মক।
‘‘বুঝলাম না।’’
এর নাম হচ্ছে কল ড্রপস। ইন্ডিয়াতে কিছুতেই টানা ফোনে কথা বলা যাচ্ছে না। আমাদের ইন্টারভিউয়ের মধ্যেও যদি বারবার লাইন কেটে যায়, আমাকে তিন-চারবার আপনাকে ফোন করতে হতে পারে। কিছু মনে করবেন না।
‘‘অ্যাবসোলিউটলি নো প্রবলেম।’’
ডাঙ্কেশিয়ান। ধন্যবাদ।
‘‘বিটেশিয়ান। স্বাগত।’’
আর একটা কথা বলি। আপনার ৬ গ্র্যান্ড স্লাম। ৪৯ সিঙ্গলস খেতাব। ১৫ ডাবলস টাইটেল। আর বিশ্বজোড়া খ্যাতির পরেও আপনাকে মিস্টার বেকার বলাটা প্রবলেম হচ্ছে। পঁচাশির উইম্বলডন ফাইনাল যারা টিভিতে দেখেছে তাদের মধ্যে সতেরো বছরের সেই টিন এজারের ইমপ্রিন্ট আজও এত গভীর, যে তাদের মনে ছেলেটা আর পরবর্তী কালে বড় হয়নি।
‘‘ওহ্, শিওর। কল মি বরিস (হাসি)।’’
সাধারণত আমরা সাংবাদিকেরা যখন পুরনো কোনও চ্যাম্পিয়নকে ইন্টারভিউ করতে যাই, ভিডিয়ো বা ইউটিউবে তাঁর খেলা অনিবার্যভাবে এক ঝলক দেখে নিই। কিন্তু আমায় সেটা করতে হয়নি। আপনার ১৯৮৫র স্মৃতি এখনও এতই ফ্রেশ।
‘‘রিয়েলি!’’
ভিয়া মোয়েগান জি জেয়া গার্ন— আমরা আপনাকে খুব পছন্দ করি।
‘‘ওহ্, থ্যাঙ্কস, থ্যাঙ্কস। ইন্টারভিউটা কি ডয়েশে হবে নাকি,’’ বেশ বিস্মিত শোনাচ্ছে বেকারের গলা।
আরে না না, এই দু’টো শব্দই শিখে এসেছিলাম...
শুনেছি উইম্বলডনের খুব কাছে আপনার বাড়ি। যেখানে সাতবার আপনি ফাইনাল খেলেছেন। এমন লোকেশনে নিশ্চয়ই মায়াবী মুহূর্তগুলো আরও বেশি করে ভিড় করে আসে?
আমি সাধারণভাবে পিছনে ফিরে দেখার মানুষ নই। কিন্তু প্রতিদিন যখন গাড়ি চালিয়ে অফিসে আসি, সেন্টার কোর্টের পাশ দিয়েই আসি। কোনও উপায় নেই স্মৃতিগুলোকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করার। এমনিতে আমি নস্টালজিয়ার ফাঁদে পা দিতে চাই না। আমি বাঁচি এখনকার মুহূর্তে। পুরনো ভিডিয়ো টিডিয়ো চালিয়ে দেখি না। তা বলে বাইরের প্রভাব তো থেকেই যায়। এই যে নোভাককে (জকোভিচ) নিয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে যাই, একটু বয়স্করা সেই মনে করিয়েই দেন। আমি দেখেছি কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও ঠিক ঘাপটি মেরে থাকে, আর বলে, মনে আছে তো আপনার অমুক ম্যাচটা? অবশ্য এটা অস্বীকার করারও মানে হয় না, আমি আজ যা, তা আমার (গৌরবময়) অতীতের জন্যই। আই মাস্ট অ্যাডমিট দ্যাট মাই পাস্ট হ্যাজ ডিফাইন্ড মি।
আর আপনার ছেলেমেয়েরা?
ওদের নিজস্ব বন্ধুবান্ধব আছে, মাঝেমধ্যে সেখানে ওরা গর্ব করে বলে, জানো তো আমার বাবা কে? আমার বাবা হল বরিস বেকার। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া তো আছেই। কেউ না কেউ সেখানে কিছু পোস্ট করছে। কমেন্ট করে দিচ্ছে পুরনো সব ম্যাচের। স্ট্যাটস দিচ্ছে। তখন বাচ্চারা এসে মাঝে মাঝে বলে, বাবা তুমি এত জিতেছ বুঝি! জানতাম না তো।
কোর্টে আপনার উপস্থিতি ছিল অনেকটা মিনি লাস ভেগাসের মতো। সব সময় জমকালো। নাটকীয়। আর চোখ ধাঁধানো সব মুহূর্তে ভরা। এমনকী আপনার স্ট্রোকগুলোরও নামকরণ হয়ে গিয়েছিল। ‘বুমবুম সার্ভ’, ‘বেকার ব্লকার’, ‘বেকার শাফল’ এই সব।
আমাকে অনেকে বলেছে যে, আমার খেলা থেকে লোকে টেনিস আর বিনোদন দু’টোই পেত। কিন্তু যখন খেলতাম, এ সব বুঝিনি। আসলে কোর্টের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে বোঝার সুযোগ থাকে না, বাইরে থেকে আপনাকে কেমন লাগছে। আমি জানি যে আমার কোর্টে বিভিন্ন স্ট্রোকগুলোকে নিয়ে এক একটা নিক নেম তৈরি হয়েছিল। আজও সেগুলো নিয়ে কথা হয়। আমি এর জন্য আপ্লুত, কৃতজ্ঞ এবং অভিভূত। তা বলে এ সব প্রশংসাকে মাথায় ঢোকাতে চাই না। ঢোকানোটা বিপজ্জনক। মাথায় চড়ে যেতে পারে।
পেলে অনেক দিন আগের সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ফিল্মে নিজের খেলা দেখে তিনি নিজেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন। আশ্চর্য হয়েছেন খেলার ওই তীব্র গতির মধ্যে তাঁর ব্রেন যে প্রতিবার সঠিক সিদ্ধান্ত নিত, সেটা দেখে। তাঁর অবাক লেগেছিল, এই রকম একটা কম্পিউটারাইজড ব্রেনের অধিকারী আমি অবচেতনে কী করে হয়েছিলাম।
ইন্সটিংক্ট একটা ভাল ব্যাখ্যা। ফুটবল বলুন বা টেনিস বলুন, এগুলো এত দ্রুতগামী খেলা যে আপনি ভাবলেন আর তারপর রিঅ্যাক্ট করলেন, সেটা হতে পারে না। যা কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে তা ওই মুহূর্তের মধ্যেই। না ভেবে। ওই মিলিসেকেন্ডে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোই পরবর্তী কালে আপনার হার আর জিতের মধ্যে তফাত হয়ে দাঁড়ায়। পরে যখন আপনি বিশ্লেষণ করতে বসেন, তখন অবাক হয়ে আবিষ্কার করেন মুহূর্তগুলো আপনারই অবচেতনে ঘটে গিয়েছিল। সাফ সত্যি কথা হল, আপনি ভেবে করেননি, জাস্ট হয়ে গিয়েছে।
বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মান টিমের তিনজন ফুটবলারের কথা বলছি। মারাকানায় আগের বিশ্বকাপ ফাইনাল কভার করতে গিয়ে মনে হয়েছিল, এই তিনজনের মধ্যে আপনি কিছুটা করে আছেন। মানে আপনার অসম্ভব সংগ্রামী মানসিকতা আছে।
তাই! যেমন?
সোয়াইনস্টাইগার, থমাস মুলার আর ম্যানুয়েল ন্যুয়ের। প্রশ্ন হল, এই তিনজনের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি বরিস?
এটা তুলনা হিসেবে ভাল। কারণ তিনজনের মধ্যেই কোনও না কোনও ভাবে আমি লুকিয়ে রয়েছি। এদের সবারই জার্মানিকে ওয়ার্ল্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন করার পিছনে খুব ভাইটাল রোল ছিল। সোয়াইনস্টাইগার আর মুলারের দৃঢ়চেতা মনোভাবটা আমার খুব ভাল লাগে। ওরা মরবে, তবু কিছুতেই ছাড়বে না। এই সংকল্পটা অভিভূত করার মতো। কিন্তু মাইন্ডসেটে আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী হল ন্যুয়ের।
কেন ন্যুয়ের?
কারণ ওর কোয়ালিটি। ফাইনালে ও যে ভাবে টিমকে ডিফেন্ড করিয়ে নিয়ে গেছে সেটা অনবদ্য। ন্যুয়েরের ওই ডিফেন্সিভ টেকনিক না থাকলে মেসি আগেই গোল করে দিত। আর একবার গোল খেলে মনে হয় না ম্যাচে আমরা ফিরতে পারতাম বলে।
আপনি বায়ার্ন মিউনিখের বোর্ডে আছেন। ফুটবলে খুব উৎসাহী। আপনার মতে বিশ্বের গ্রেটেস্ট ফুটবলার কে? মেসি না রোনাল্ডো?
আমি এটা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত যে কাকে বলা উচিত। আমার বক্তব্য হল, যে বিশ্বসেরা তাকে দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিতে দেখাতে হবে। পেলে তাঁর সময়ে সেটা করে দেখিয়েছেন। তারপর বেকেনবাউয়ার করেছেন। মারাদোনা করেছেন। নব্বইতে জার্মানি বিশ্বকাপ জিতেছিল। তখন লোথার ম্যাথেউস ছিল বিশ্বের এক নম্বর ফুটবলার। বিশ্বকাপ জিতে সেটা প্রমাণ করেছিল। মেসি যদি আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারত, তা হলে ওকেই সেরা বলতাম। বাস্তব হল, ও পারেনি। একটা কথা জানবেন বিশ্বমানের স্পোর্টস খুব নিষ্ঠুর এবং একই সঙ্গে সৎ। আয়না যে ছবিটা দেখাচ্ছে সেটা যত কর্কশই হোক, তর্ক না করে আপনাকে মেনে নিতে হবে।
ভারতীয় ক্রিকেট মহলে কারও কারও মুখে শোনা কপিল দেবকে নাকি আপনি ভাল চেনেন?
ভাল চিনি না। কপিল হল বন্ধু। আমরা দু’জন দু’জনকে ফ্রেন্ড বলে ডাকি। লরিয়াস অ্যাওয়ার্ডসের জন্য আমরা অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটিয়েছি। আর তা থেকে একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে। ও লন্ডনে এলে আমার কাছে আসে। আমি দিল্লি গেলে কপিলের কাছে যাই।
আপনি সচিন তেন্ডুলকর বলে কারও নাম শুনেছেন?
আরে, নাম শুনেছি কী! এই তো সপ্তাহ চারেক আগে ওর সঙ্গে আলাপ হল। উইম্বলডনের একটা ইতালিয়ান রেস্তোরাঁয় আমাদের দেখা।
হঠাৎ করে দেখা?
একদম হঠাৎ করে দেখা। আমি বসে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি কিছু দূরে সচিন। আই কনট্যাক্ট হতেই আমরা দু’জনে উঠে পড়লাম। আলাপ করলাম। দু’জনে দু’জনের খুব তারিফ করলাম। তারপর বসে গেলাম একসঙ্গে। একটা ওয়াইন শেয়ার করে যে যার সিটে ফেরত গেলাম।
আপনি সচিনকে চিনলেন কী করে? জার্মানরা তো ক্রিকেট দেখে না!
আমি টিপিক্যাল জার্মান নই। আমি কয়েকবার ইন্ডিয়াতে এসেছি। সচিনের কেরিয়ারও ফলো করেছি। আমি আসলে সচিনের ফ্যান। ওর কিছু ইনিংস আমি টেলিভিশনেও দেখেছি।
বরিস, ইন্ডিয়ান ক্রিকেটে আর একজন খুব বিখ্যাত ক্যাপ্টেন আছেন। যাঁকে বলা হয় গেম চেঞ্জিং লিডার। আমাদের এই বিশেষ সংখ্যায় অতিথি হিসেবে উনি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চান। ওঁর নাম সৌরভ গাঙ্গুলি।
হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন না কী প্রশ্ন?
প্রশ্নটা হল, আপনি নিজে একজন গ্র্যান্ডস্লাম চ্যাম্পিয়ন। আবার অধুনা একজন গ্র্যান্ডস্লাম চ্যাম্পিয়নের কোচও। এই যে দু’টো আলাদা সময়ে আপনার দু’টো ভিন্ন অবস্থান— প্লেয়ার আর কোচ হিসেবে। তাতে মানসিকতার কি কোনও তফাত হয়?
হিউজ তফাত হয়। প্লেয়ার হিসেবে আপনি শুধু নিজের কথাই ভাববেন। আর কোচ হিসেবে আপনাকে শুধুই ভাবতে হবে প্লেয়ারের কথা।
মানে কোচকে হতে হবে পুরোপুরি সেল্ফলেস?
একদম তাই। প্লেয়ার আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে। হবেই। কোচের সেটা হলে চলবে না। কোচের নিজস্ব ইগো থাকলে চলবে না। তাকে নিজের খ্যাতির ছায়া থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে রূপান্তরিত হতে হবে ঠান্ডা, বিনয়ী এবং অনেক বেশি প্রাজ্ঞ এক মানুষে। আমি এখন ভাবি, দশ বছর আগে হলে, নোভাকের সঙ্গে এই সাফল্য কিছুতেই পেতাম না। কোচের মাইন্ড সেটটাই আমার ছিল না। আমি যদিও ওই সময়ের মধ্যে কিছু কোচিং ক্লিনিক করিয়েছি। জার্মান ডেভিস কাপ টিমকে কোচ করেছি। কিন্তু সেগুলো— আর সুপারস্টার প্লেয়ারকে ওয়ান টু ওয়ান কোচিং! দু’টোর মধ্যে কী তফাত জানেন? কালো আর সাদাতে যা তফাত।
আপনার প্রাক্তন কোচ গুন্টার বশ-এর বই পড়েছি যেখানে আপনাকে ট্রেন করাতে গিয়ে বিশাল সমস্যার কথা বলেছেন। লিখেছেন, বরিস এতই একগুঁয়ে ছিল যে ওকে যদি বলতাম আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে, তা হলে আগুনে হাত দিয়ে দেখত হাত সত্যিই পুড়ল কি না? যদি বলতাম লেন্ডলের ফোরহ্যান্ডে খেলো না, ওটাই ওর স্ট্রং জায়গা। তা হলে ও অবধারিত ফোরহ্যান্ডেই খেলত। আর কোর্ট থেকে বেরিয়ে বলত, এটাই তো মস্তানি যে অপোনেন্টের স্ট্রং পয়েন্টে খেলেও জিতলাম।
হা হা হা।
কোচ বরিস যদি এই অবাধ্য বরিসকে কোচ করতেন, তবে কী হত?
ইন্টারেস্টিং হত, এটুকু বলতে পারি।
আচ্ছা আপনার কোচিং পেলে লেন্ডল উইম্বলডন জিততেন বলে মনে হয়?
অ্যাবসোলিউটলি।
আপনাকে খুব কনফিডেন্ট শোনাচ্ছে।
তার কারণ হল কোচ হিসেবে আমি ওকে এমন কিছু অফার করতে পারতাম যা ওর অস্ত্রাগারে ছিল না। আমি আর লেন্ডল একসঙ্গে হলে সেই কম্বিনেশনটা হত পিকচার পারফেক্ট। একটা নিখুঁত ছবি।
কী কী জিনিস আপনি আনতেন যা লেন্ডলের ছিল না?
আমি আনতাম ইন্সটিংক্ট।
আমি আনতাম স্বতঃস্ফূর্ততা।
আমি আনতাম আবেগের সঙ্গে খেলা। যে আবেগ ওর খেলাকে আরও সমৃদ্ধ করত।
আপনিও তো খুব আবেগপ্রবণ ছিলেন। কোর্টে সেটা প্রকাশ করতেন। কখনও নিজেকে র্যাকেট দিয়ে মারতেন। ম্যাকেনরোর সঙ্গে তফাতের মধ্যে, গালাগাল করতেন নিজেকে। আম্পায়ার বা বিপক্ষকে নয়।
হ্যাঁ, ইমোশন প্রথম জীবনে আমার খেলার কিছু ক্ষতিও করেছে। তারপর ওটাকে ম্যানেজ করতে আমি শিখে গিয়েছিলাম। কেরিয়ারের সেকেন্ড হাফে আমি ইমোশন দিয়ে নিজের খেলাকে আরও ইম্প্রুভ করেছি। এটাই লেন্ডলকে শেখানো যেত।
লেন্ডলকে আপনি অনেকবার হারিয়েছেন। আর জকোভিচকে এত কাছ থেকে দেখছেন। দু’জনের কি অনেক মিল?
লেন্ডল আমার মতে টেনিস সার্কিটে প্রথম রিয়েল পেশাদার। প্রথম প্লেয়ার যে নিয়মিত জিমে যেত। নিজের ডায়েট কনট্রোল করত। র্যাকেট টেকনোলজি নিয়ে মাথা ঘামাত। ঠিক কী ধরনের জুতো পরবে তা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভাবত। আর নিজের চারপাশে রাখত সেরা সব সাহায্যকারী পেশাদারদের। যাতে নিজে সেরা প্রোডাক্ট হয়ে বার হতে পারে। লেন্ডল অবিশ্বাস্য! নোভাকও তাই! ও হয়তো ফেডেরার মতো ট্যালেন্টেড নয়। নোভাকের হয়তো ক্লে কোর্টে নাদালের মতো জন্মগত প্রতিভা নেই। কিন্তু নোভাক বেশিরভাগ জিনিসই কারেক্টলি করে। ওর খাওয়াদাওয়া, ওর স্ট্র্যাটেজি, ওর র্যাকেট বাছা— সব কিছু পারফেকশনের সীমায় পৌঁছে। গোটা লাইফস্টাইলটাই এমনভাবে তৈরি যাতে সব ক’টা জিনিস মিলেটিলে ওকে বিশ্বের এক নম্বর প্লেয়ার করে। যাতে কোনও ঘরে কোথাও সামান্যতম ফাঁক না থাকে। নোভাক সিম্পলি দুর্দান্ত।
একটা সত্যি কথা বলবেন। নিছক জকোভিচের কোচ হিসেবে নয়।
আরে শিওর। বলুন না।
ফেডেরারের এখনও খেলে যাওয়া আপনি সমর্থন করেন? আপনার সত্যি মনে হয় ফেডেরার এখনও গ্র্যান্ড স্লাম জিততে পারবেন?
প্রথমে আপনাকে বলি, আমি রজার ফেডেরারকে জাস্ট অ্যাডমায়ার করি। জীবিত বা মৃত আর কোনও টেনিস প্লেয়ারকে আমি রজারের মতো রেসপেক্ট করি না। ও টেনিস ইতিহাসে সর্বকালের সফলতম প্লেয়ার। ওর ট্যালেন্ট অতিমানবীয়। এ বছরও রজার দু’টো গ্র্যান্ড স্লাম প্রায় জিতে ফেলেছিল। কাজেই আপনার প্রশ্নের উত্তর হল, রজার যত দিন খেলবে তত দিনই ওর গ্র্যান্ড স্লাম জেতার চান্স আছে। অন্তত বরিস বেকার জীবনে কখনও রজার ফেডেরারের বিরুদ্ধে বেট করবে না।
ঠিক আছে একটু পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ১৯৮৫। সেন্টার কোর্ট। ফাইনালে এক দিকে ফেডেরার। অন্য দিকে সতেরো বছরের সোনালি চুলের জার্মান ছেলেটা। যার নাম বরিস। কী হবে?
রজার দেখবেন সেই সব প্লেয়ারের সঙ্গে বেশি স্বচ্ছন্দ যারা পিছন থেকে খেলে। যারা বেস লাইন থেকে কনট্রোল নেয়। যারা আক্রমণাত্মক খেলে বারবার নেটের কাছে দৌড়ে আসে, তাদের ও তুলনামূলক ভাবে অপছন্দ করে। আর আমার স্টাইলটা ঠিক তাই ছিল। তাই জিততাম কি না জানি না, কিন্তু আমি রজারের জীবন কয়লা করে দিতাম।
ফেডেরারই কি সর্বকালের সেরা?
বিভিন্ন আমলের মধ্যে তুলনা করা খুব ডিফিকাল্ট। বাট আমি যা দেখেছি রজার ইজ সামওয়ান ভেরি ভেরি স্পেশাল। জাস্ট ভেবে দেখুন আজকের সময়েও নোভাকের মতো প্লেয়ারের কঠিনতম প্রতিদ্বন্দ্বী হল রজার। বয়সে ছ’বছরের বড় হয়েও সমানে লড়াই করে যাচ্ছে। আমি কোচিংয়ে ফেরার পর নিয়মিত বড় সব টুর্নামেন্টের লকার রুমে ঢুকি। খুব কাছ থেকে ওকে দেখার সুযোগ পাই। আর লকার রুমের দেখায় আমি যেন আরও বেশি ফেডেরারে মুগ্ধ হয়ে গেছি। যেভাবে ও নিজেকে তৈরি করে। যে সব শট খেলে। যেমন ইন্সটিংক্ট দেখায়। জাস্ট এই গ্রহের মনে হয় না। বরঞ্চ মনে হয় চৌত্রিশ বছরেই এই, তা হলে চব্বিশে এ কী ছিল!
মেয়েদের মধ্যে সর্বকালের সেরা কাকে বলবেন? সেরেনা? স্টেফি? মার্টিনা? কে?
মেয়েদের মধ্যে বাছাটা আরও কঠিন। প্রত্যেকে নিজের জেনারেশনে রাজত্ব করেছে। তবে আমি বলব মনিকা সেলেসের কোর্টে ছুরি খাওয়াটা টেনিসের একটা সর্বকালীন ট্র্যাজেডি।
(বেকারের গলা এ বারে একটু অধৈর্য শোনাচ্ছে। মিনিট কুড়ি কথা হয়ে গিয়েছে। বললেন একটা বিজনেস মিটিংয়ে বসব, এ বার কি শেষ করা যায়? বললাম, জাস্ট দু’টো প্রশ্ন। বেকার: ওকে।)
আচ্ছা নিছকই কৌতূহল। আপনি কথা বলছেন কি সেন্টার কোর্টের ধারের ওই বাড়ি থেকে?
না, না, আমি এখন সেন্ট্রাল লন্ডনে। আমার মে ফেয়ারের অফিসে বসে।
আর একটা কৌতূহল। আপনি ইন্টারভিউতে যে সব শব্দ অনাবিলভাবে ব্যবহার করলেন কোনও জার্মানকে তা করতে দেখিনি। বললেন, ‘মাই পাস্ট হ্যাজ ডিফাইন্ড মি’। ব্যবহার করলেন ‘এক্সিউবারেন্স’ শব্দটা।
ধন্যবাদ। কিন্তু আমি টিপিকাল জার্মান নই। বিদেশে থাকি। অনেক ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মিশি।
স্টেফি আর আপনি দু’জনেই গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনালে যে নার্ভ দেখিয়েছেন, অবিশ্বাস্য। চাপ যত বাড়ত আপনাদের খেলা যেন তত খুলত। কী আছে জার্মান রক্তে যে এই ব্যাপারটা বারবার সম্ভব হয়? কী টেনিস, কী ফুটবল!
জার্মান রক্তের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। তার ভাল দিক আছে। খারাপ দিকও আছে। গড়পড়তা জার্মান হল এমন একজন মানুষ যে, তাকে যদি একটা দরজা খুলতে হয়, যার চাবি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তা হলে সে ঠিক দরজা ভেঙে ঢুকে যাবে। কোনও না কোনও ভাবে লক্ষ্যে পৌঁছবেই। কিন্তু এই মানসিকতাটা এক দিক থেকে খারাপও।
কিন্তু স্পোর্টসে এটা খুব সাহায্য করে।
অবশ্যই করে। জার্মান স্পোর্টসম্যানদের সবথেকে বড় কোয়ালিটি হচ্ছে, ওদের দৃঢ় সংকল্প। আর জিততে চাওয়ার ক্ষমতা। জার্মান টপ প্লেয়ার যে সব সময় সৌন্দর্যময় জিতবে তা নয়। কিন্তু ভেঙেচুরে ঠিক জেতার একটা রাস্তা বার করে নেবে। এটাই জার্মান ব্লাড।
এ বার বলি পূর্ব ভারতের টেনিসপ্রেমী কিছু মানুষের আপনার সম্পর্কে একটা কমপ্লেন আছে।
কমপ্লেন! কেন?
আমাদের প্রজন্মের প্রতিটি টেনিস প্লেয়ার স্টেফিকে নিয়ে ডগমগ ছিল। গ্রেট উম্যান, গ্রেট বডি, সেক্সি।
সবসময় যে জিতছে। লকাররুমে প্রচণ্ড বলাবলি হত, উফ মেয়েটা কী হট
কমপ্লেনটা হল, সবাই ভেবেছিল জিমি কোনর্স আর ক্রিস এভার্টের মতো আপনাদেরও একটা ‘লাভ ডাবল’ হিসেবে দেখা যাবে। ১৯৮৯তে আপনারা দু’জনে উইম্বলডনও জিতলেন। অথচ কোনও প্রেমের কাহিনি শোনা গেল না।
আর তার চেয়েও খারাপ, ওই আন্দ্রে আগাসি নিয়ে গেল স্টেফি গ্রাফকে! আপনি কোনও তৎপরতা দেখালেন না।
হা হা হা। আই মাস্ট সে, আই হার্ড ইট আ কাপল অব টাইমস। আমায় বেশ কিছু লোক একই কথা বলেছে। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, স্টেফি আর আগাসির বিয়েটা যেন মেড ইন হেভেন অ্যারেঞ্জমেন্ট। একজন সম্ভবত মেয়েদের টেনিসে সর্বকালের সেরা। আরেকজন পুরুষদের ইতিহাসে গ্রেট চ্যাম্পিয়ন। ওদের মিলনটা রূপকথার মতো।
দু’টো বাচ্চা নিয়ে ওদের বিয়েটাও খুব স্ট্রং। খুব হ্যাপি কাপল। ওরা যেন এ ভাবেই থাকে।