শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় এবং কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। টলিউডে কারও অপু, কারও অপুদা। আমার একাধিক ছবির মুখ্য অভিনেতা। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘গুডনাইট সিটি’, ‘অনুসন্ধান’, ‘উড়ো চিঠি’-র মতো ছবি জুড়ে অপুদার অনায়াস বিচরণ। শক্ত চরিত্র হোক বা আদ্যন্ত প্রেমিক, শাশ্বত অনবদ্য। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে আমার আর অপুদার ‘অনুসন্ধান’। অনুপম রায়ের একটি গান ‘আমি অনেক দূরের মানুষ’ ইতিমধ্যেই ভাল সাড়া ফেলেছে। গানটিতে অপুদার সঙ্গে পায়েল সরকারের রসায়ন ক্যামেরাবন্দি করেছি। ৫০ ছোঁয়া শাশ্বত তাতেও কাঁপিয়ে দিয়েছেন! অনেকেই বলেছেন, ধারাবাহিক ‘এক আকাশের নীচে’-র সেই শাশ্বত নাকি বড় পর্দায় ফিরে এসেছেন। এখনও প্রেমের দৃশ্যে কী সাবলীল, চূড়ান্ত রোম্যান্টিক!
আমি যদিও শুনে অবাক হইনি। কারণ, শাশ্বত আন্তর্জাতিক মানের অভিনেতা। এই ধরনের অভিনেতারা শারীরিক ভঙ্গি থেকে বাচনভঙ্গি- সবেতেই সেরা হন। ছোট চরিত্র দিলেও মেরে বেরিয়ে যাবেন। শক্ত চরিত্রকেও জলবৎ তরলং করে উপস্থাপিত করবেন দর্শকদের সামনে। আর এক বার যদি চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যান, তা হলে তো কথাই নেই। নিজেই আস্ত চরিত্র হয়ে ওঠেন। এবং চরিত্র হয়ে উঠতে গিয়ে কখনও শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় নিজেকে জাহির করে ফেলেন না। এটাই তাঁর মস্ত গুণ। পাশাপাশি, চিত্রনাট্যের পিছনেও প্রচুর সময় দেন। খুঁটিয়ে জানেন, পড়েন নিজের চরিত্রকে। তার পরে ক্যামেরার মুখোমুখি হন।
ফলে, শাশ্বত সহ-অভিনেতার কাছে যতটাই আরামদায়ক, পরিচালকের কাছে ততটাই চমকের। আমি কত সময়ে ওঁর আচমকা কিছু বলার ভঙ্গি বা ‘ম্যানারিজম’ দেখে চমকে গিয়েছি, শিখেছিও। আবার এটা করতে গিয়ে কিন্তু ‘দৃশ্য’ খেয়েও নেন না। বাকি অভিনেতাদেরও ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন না। সব মিলিয়ে ভীষণ নিখুঁত। তাই বাংলা ছবির পাশাপাশি, হিন্দি ছবির দুনিয়াতেও তিনি অনায়াস। সুজয় ঘোষের 'কহানি' ছবির ছোট্টতম চরিত্র বব বিশ্বাস আজ তাঁর অভিনয়ের জোরে একটা ছবির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে! অপুদার ক্ষমতা এটাই। বাকিদের মতো আমিও ‘বব বিশ্বাস’ ছবিতে তাঁকেই আশা করেছিলাম। কেন তাঁর জায়গায় অভিষেক বচ্চন, তিনি চরিত্রের সঙ্গে মানানসই কি না- এ সব তর্কেই যাব না। তবে, আর পাঁচ জন বাঙালির মতো এই এক জায়গায় আমিও অন্ধ! আমার চোখে ‘বব বিশ্বাস’ মানেই শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়।
অভিনয়ে যেমন সব সময় সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেন, মানুষ হিসেবেও বড্ড দরদী শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। সেটে সকলের সঙ্গে নিমেষে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। খুব সরল, সাদাসিধে, প্রাণবন্ত। অবসরে সকলকে নিয়ে আড্ডা মারেন। বলিউড ফেরৎ অভিনেতাদের মধ্যে যে সব উপসর্গ দেখা দেয়, আজও ওঁর মধ্যে তার একটিও নেই। সারাক্ষণ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখিনি কোনও দিন। নিজের পাশাপাশি, ইউনিটের সকলের দিকে সমান নজর। ফলে, তাঁর সঙ্গে কাজ করতে সবাই মুখিয়ে থাকেন।
অপুদার ভক্তদের একটা বড় অংশের নাকি বিরাট আক্ষেপ, অভিনেতাকে ঠিক মতো ব্যবহার করেনি বাংলা ছবির দুনিয়া। হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। সেটা ভাল বলতে পারবেন দর্শক। তবে আমরা পরিচালকেরা কিন্তু হাল ছাড়িনি। যত রকমের নতুন চরিত্র তাঁকে দেওয়া যায়, দেওয়ার চেষ্টা করছি। এই প্রসঙ্গে বলি, পরিচালনার পাশাপাশি আমি কিন্তু ছবি দেখতেও ভালবাসি। তালিকায় অপুদার ছবি তো আছেই। অনেকে জানতে চান, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত কোন চরিত্র আমার বেশি পছন্দের? জানি ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বললে সবাই খুশি হবেন। আমার পছন্দ ‘গুডনাইট সিটি’র ডিসিডিডি শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। খুব শক্ত চরিত্রেও তিনি প্রতিভার জোরে অনায়াস। অনুরাগ বসুর ‘জগ্গা জাসুস’, ‘শবর’, ‘চলো লেটস গো’, ‘বং কানেকশন’। এ গুলো সুযোগ পেলেই বারেবারে দেখার চেষ্টা করি।
এই প্রসঙ্গে একটা মজার কথা ভাগ করে নিই। আমায় প্রায়ই শুনতে হয়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে কি ছাপিয়ে গেলেন অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়? কী উত্তর দিই! কেউ কি কাউকে আক্ষরিক অর্থে ছাপিয়ে যেতে পারে? না বোধহয়। আর শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় আমারও ভীষণ প্রিয়। তবে এটা বলা যেতেই পারে, প্রয়াত অভিনেতা মূলত টলিউডেই আবদ্ধ থেকেছেন। সেখানে অপুদার ব্যাপ্তি জাতীয় স্তরে। তাঁকে ঘিরে চর্চা তো হবেই।
আনন্দবাজার অনলাইন আমায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কলম ধরার সুযোগ করে দিয়েছেন। জন্মদিনে তাই আন্তরিক শুভেচ্ছা, ভালবাসা, সুস্থতা কামনা করার সুযোগটাও পেয়ে গেলাম। পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কিন্তু একটি আর্জি আছে। আজ বলেই ফেলি? ‘ঝিন্দের বন্দি’ ছবিতে আপনাকে রাজা শঙ্কর সিংহের চরিত্রে খুব মানাত। তপন সিংহ পরিচালিত যে চরিত্র কিংবদন্তি উত্তমকুমারের অভিনয় গুণে।
আমি যদি ‘ঝিন্দের বন্দি ২’ বানাই, আপনি রাজি হবেন তো মহানায়কের জুতোয় পা গলাতে?