যিশু, আবীর ও ঋত্বিক
আমি নায়ক হব, মহানায়ক হব... প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ছবির এই গানের কথা যে কোনও উঠতি নায়কের মনে আজও বাজে। হয়তো প্রকাশ্যে বলবেন না। তবে ভক্তের ভগবান হতে কোন শিল্পী না চান? নায়ক-পুজোর এই চল দেশের সব ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে স্বমহিমায় বিরাজমান। তাই নায়ককে আম আদমি হিসেবে মেনে নিতে দর্শকেরও হয়তো বাধো বাধো ঠেকে। যদিও বাংলা বা হিন্দি ছবিতে মধ্যবিত্ত নায়ক যে সাম্প্রতিক আবিষ্কার, তেমনটা কিন্তু নয়।
নায়ক একটা মিথ
বিগত দশ বছরে যে তিন বাঙালি নায়ক দর্শকের মনে ও টলিউডে নিজেদের আসন পাকা করেছেন, তাঁদের ‘অন্য নায়ক’ বললে ভুল হয় না। তাঁরা যিশু সেনগুপ্ত, ঋত্বিক চক্রবর্তী, আবীর চট্টোপাধ্যায়। আসলে নায়কের ধারণা একটা মিথের মতো। নায়ক মানেই সর্বগুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, বিপদে পরিত্রাতা, লার্জার দ্যান লাইফ... এমন কয়েকটা ইমেজ দর্শকের চোখে ভাসে। তাতে ভুল কিছু নেই। যে কোনও মোড়কে নায়কের এই ইমেজ দেখিয়ে পপুলার কালচারও দর্শকের মনে প্রত্যাশা তৈরি করে এসেছে। তবে বদল না এলে যে কোনও বহমান সংস্কৃতির ধারা অবরুদ্ধ হয়ে যায়।
তিন ধরনের জার্নি
তাই শহুরে, কনটেন্ট ভিত্তিক ছবির উত্থানের পাশাপাশি নায়কের ইমেজও বদলেছে। ‘‘ঠিক দশ বছর আগে ২০০৯-এর মে মাসে মুক্তি পেয়েছিল আমার প্রথম ছবি ‘ক্রস কানেকশন’। তখন থেকেই ইন্ডাস্ট্রিতে কনটেন্ট ভিত্তিক ছবির চল শুরু,’’ বলছিলেন আবীর। ‘ক্রস কানেকশন’-এ ছিলেন ঋত্বিক চক্রবর্তীও। যিশু-আবীরের চেহারায় যে জৌলুস, তা ঋত্বিকের একেবারে নেই। তবে সাদামাঠা চেহারাতেই তিনি যে ভাবে প্রাণবন্ত চরিত্র হয়ে ওঠেন, সেই চরিত্রই তাঁর গ্ল্যামার। অন্য দিকে যিশুর জার্নি বিপরীত মেরুর। অভিজ্ঞতার নিরিখে এই ত্রয়ীর মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র তিনি। নাচ-গানে ভরা চেনা ধাঁচের বাণিজ্যিক ছবির নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। একই সময়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ, গৌতম ঘোষের অন্য ধারার ছবিতেও মুখ্য চরিত্র করেছেন যিশু। যদিও তখনকার বাণিজ্যিক ছবিতে তিনি ঈর্ষণীয় সাফল্য পাননি।
সহায় ব্যোমকেশ
যিশু-আবীরের কেরিয়ারে ব্যোমকেশ বক্সীর অবদান অনস্বীকার্য। বাঙালির আইকনিক গোয়েন্দা চরিত্রে যিশু ও আবীরের অভিনয় তাঁদের ফ্যানবেস গড়ে তুলতে ভীষণ ভাবে সাহায্য করেছে। অন্য দিকে ঋত্বিককে দেখা
গিয়েছে ব্যোমকেশের সহকারী অজিতের চরিত্রে।
নেগেটিভে ‘না’ নয়
এই তিন জনই নায়ক বলে নেগেটিভ চরিত্র করতে অরাজি হননি। বরং ‘রাজকাহিনী’তে যিশুর নেগেটিভ চরিত্র তাঁর কেরিয়ারে অন্যতম মাইলফলক। ‘এ বার শবর’, ‘ভিঞ্চিদা’য় অপরাধীর চরিত্র করেছেন ঋত্বিক। ‘বহ্নিশিখা’ ধারাবাহিকে নেগেটিভ চরিত্রে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন আবীর।
বড় পর্দায় ‘কানামাছি’তেও খলচরিত্র করেন তিনি।
নতুন এন্ট্রি
যিশু-আবীর-ঋত্বিকের লিগে নতুন এন্ট্রি অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ‘ধনঞ্জয়’, ‘এক যে ছিল রাজা’, ‘ভিঞ্চিদা’... যে কোনও জঁরের ছবিতে অনির্বাণের অভিনয় প্রশংসিত।
পরিচালকের চোখে
সিনেমা আদতে পরিচালকের মিডিয়াম। তিনি যে চোখ দিয়ে নায়ককে দেখবেন, পর্দার অভিনেতাও সেই ধাঁচেই নিজেকে গড়ে তুলবেন। তাই অন্য নায়কের মূল কান্ডারি এই প্রজন্মের পরিচালকরা। ‘‘অনেক দিন আগে ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ করেছিলাম। যেখানে বাসচালক, ইনশিয়োরেন্স এজেন্টের গল্প দেখানো হয়েছে। ‘মুক্তধারা’য় ছিল সংশোধনাগারের এক আবাসিকের বদলে যাওয়ার গল্প। ‘রামধনু’তে বলেছিলাম মধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের গল্প। সাধারণ চরিত্রদের মতো করে আলোর দিকে এগোনোর অনুপ্রেরণা আর কেউ জোগাতে পারে না,’’ বলছিলেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
তাঁর ছবিতে যে শুধু নায়কের সংজ্ঞা বদলেছে, তা-ই নয়। বরং তিনিও অন্য নায়কের দলে শামিল হয়েছেন। ‘‘বিভূতি চক্রবর্তীর চরিত্র (কণ্ঠ) করতে গিয়ে বুঝেছি, অভিনেতা হিসেবে আমাকে মনে রাখার জন্য এই চরিত্রটা যথেষ্ট। কারণ বিভূতিবাবু যে কাজ ৩০ বছর ধরে করে আসছেন, সেটা লার্জার দ্যান লাইফের চেয়ে কম নয়। অথচ উনিও তো সাধারণ মানুষ! আসলে সাধারণদের গল্পই আজীবন থেকে যায়। তাই ‘কোনি’, ‘গণশত্রু’ বা ‘আতঙ্ক’-এর সেই মাস্টারমশাই মনে থেকে গিয়েছেন,’’ মত তাঁর।
অন্য দিকে রাজ চক্রবর্তী বললেন, ‘‘আমি হিরোইজ়মকে দু’ভাবে দেখি। ‘চ্যালেঞ্জ’ বা ‘শক্র’র হিরোইজ়ম যেমন দর্শকের প্রশংসা পেয়েছে, তেমনই ‘বোঝে না সে বোঝে না’য় সোহমের সাদামাঠা চরিত্রও দর্শক মনে রেখেছেন। নায়ককে অন্য ভাবে তুলে ধরাটা নতুন নয়। মানুষকে ছুঁতে পারাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’’
এখনও পথ বাকি
অতিরঞ্জনের খোলস ছেড়ে পর্দার নায়ক বাস্তবের কাছাকাছি এসেছে। দর্শকের মনে জায়গা করতে পেরেছে। তবে গন্তব্য এখনও অনেক দূর। ‘‘ফেলুদা-ব্যোমকেশ বাদ দিলে এখনকার বেশির ভাগ বাংলা ছবিতে যে ভাবে নায়ককে দেখানো হচ্ছে, তাতে চরিত্রায়নে বদল আনার আরও সুযোগ রয়েছে। শুধু নায়ক নয়, পৌরুষের ধারণা বদলেছে। বদলাচ্ছে মাচো হওয়ার সংজ্ঞাও,’’ মত আবীরের।