স্বত্বের লড়াইয়ে এ বার কাঠগড়ায় কাকাবাবু

আন্দামানে জারোয়াদের দ্বীপে চলে গিয়েছেন নির্ভয়ে। মাসাইমারার জঙ্গলে গিয়ে পড়েছেন নরখাদকদের তল্লাটে। কিন্তু আদালতে কোনও দিন যেতে হয়নি কাকাবাবুকে। সেটাই ঘটল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর আড়াই বছরের মধ্যেই! কাকাবাবুকে আদালতে টেনে নিয়ে গিয়েছে স্বত্বের লড়াই। কলকাতা হাইকোর্টে মামলা ঠুকেছে শ্রীভেঙ্কটেশ ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেড।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৫ ০২:২১
Share:

আন্দামানে জারোয়াদের দ্বীপে চলে গিয়েছেন নির্ভয়ে। মাসাইমারার জঙ্গলে গিয়ে পড়েছেন নরখাদকদের তল্লাটে। কিন্তু আদালতে কোনও দিন যেতে হয়নি কাকাবাবুকে। সেটাই ঘটল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর আড়াই বছরের মধ্যেই!

Advertisement

কাকাবাবুকে আদালতে টেনে নিয়ে গিয়েছে স্বত্বের লড়াই। কলকাতা হাইকোর্টে মামলা ঠুকেছে শ্রীভেঙ্কটেশ ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেড। ওই সংস্থা এর আগে কাকাবাবুর কাহিনি অবলম্বনে ‘মিশর রহস্য’ প্রযোজনা করেছিল। কাকাবাবুর ভূমিকায় সেখানে অভিনয় করেন প্রসেনজিৎ। পরিচালক ছিলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়।

ইতিমধ্যে আরপি টেকভিশন নামে অন্য একটি প্রযোজক সংস্থা চিরঞ্জিতকে কাকাবাবু করে ‘জঙ্গলগড়ের চাবি’ অবলম্বনে ছবি তৈরির কাজে হাত দিয়েছিল মাস দুয়েক আগে। ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনি নিয়ে অঞ্জন দত্তের পরিচালনায় দু’টি ছবি করেছে যারা, সেই সংস্থা কাকাবাবুকে নিয়েও ছবি করছে বলে খবর পেয়েই ভেঙ্কটেশের অন্যতম কর্ণধার মহেন্দ্র সোনি মামলা ঠুকে দেন। তাঁর দাবি, ২০১২-র জানুয়ারিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ভেঙ্কটেশ ছাড়া অন্য কেউ কাকাবাবু নিয়ে ছবি বা টেলি-সিরিয়াল করতে পারবে না। । আদালতে ভেঙ্কটেশের দাবি, ২০১২-র ২৫ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত ওই চুক্তিতে সুনীল তাঁর ‘কাকাবাবু সিরিজ’ নিয়ে ছবি ও টেলি-সিরিয়াল করার একমাত্র স্বত্ব সাত বছরের জন্য কেবল তাদেরই দিয়ে গিয়েছেন। ২০১২-র অক্টোবরে সুনীল প্রয়াত হন। জানুয়ারির চুক্তিতে ভেঙ্কটেশ জানিয়েছিল, তারা আপাতত ‘মিশর রহস্য’-সহ তিনটি কাহিনি অবলম্বনে ছবি করার কথা ভেবেছে এবং সেই বাবদ তিন লক্ষ টাকা লেখককে দেওয়া হয়। চুক্তিতে বলা ছিল, এর পরের সাত বছরে ফের কাকাবাবুর গল্প নিয়ে ছবি বা টেলি-সিরিয়াল করলে কাহিনি পিছু লেখক বা তাঁর আইনি উত্তরাধিকারীদের এক লক্ষ টাকা দেবে ভেঙ্কটেশ। সাত বছরের জন্য এই রকম স্বত্ব লেখক আর কাউকে দিচ্ছেন না বলেও চুক্তিপত্রে উল্লেখ রয়েছে। প্রসেনজিৎকে কাকাবাবু করেই ভেঙ্কটেশ এর পরে ‘পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক’ ছবি করার প্রস্তুতিও নিয়েছে।

Advertisement

কিন্তু এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সুনীলের স্ত্রী-পুত্র স্বাতী ও শৌভিক গঙ্গোপাধ্যায় আরপি টেকভিশনের কর্ণধার কৌস্তুভ রায়ের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। সেখানে এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে ‘জঙ্গলগড়ের চাবি’ নিয়ে ছবি করার স্বত্ব পায় সংস্থাটি।

ওই মাসেই আদালতে ভেঙ্কটেশ আবেদন করে বলে— ‘জঙ্গলগড়ের চাবি’র উপরে স্থগিতাদেশ জারি করা হোক। কারণ ‘কাকাবাবু সিরিজে’র স্বত্ব একমাত্র ভেঙ্কটেশেরই। উত্তরে আরপি-র তরফে সওয়াল করা হয়, চুক্তিতে উল্লিখিত ‘কাকাবাবু সিরিজ’ মানে ঠিক ক’টি গল্প আর কোন কোন গল্প, তা স্পষ্ট নয়। ভেঙ্কটেশ প্রাথমিক ভাবে তিনটি ছবি করার কথাই বলেছে। আরপি-র কর্ণধার কৌস্তুভ রায় পরে দাবি করেন, ‘‘কাকাবাবুকে নিয়ে সুনীল মোট ৩৭টি কাহিনি রচনা করেছেন। সেগুলোর নাম চুক্তিপত্রে উল্লেখ নেই। শুধু কাকাবাবু সিরিজ বলা আছে। চুক্তি এ কথা বলছে না যে, কাকাবাবুর সমস্ত কাহিনি নিয়ে ছবি ও টেলি-সিরিয়াল করার একমাত্র স্বত্ব ভেঙ্কটেশের আছে। আমরা সেটাই আদালতে জানিয়েছি।’’

তাঁর বক্তব্য ১৯৫৭ সালের কপিরাইট আইন অনুযায়ী যে রচনার স্বত্ব নেওয়া হচ্ছে, তার নাম স্পষ্ট করে উল্লেখ থাকা দরকার।

এ ব্যাপারে ভেঙ্কটেশ কী বলছে? ভেঙ্কটেশের আইনজীবী সঞ্জয় বসু দাবি করছেন, কাকাবাবু সিরিজ বললে কাকাবাবুকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা সব গল্পই বোঝায়। তাঁরা আদালতকে সেটাই বলেছেন।

আপাতত গত ৩০ মার্চ হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমেন সেন আরপি টেকভিশন-কে ‘জঙ্গলগড়ের চাবি’ শ্যুটিংয়ের অনুমতি দিয়েছেন। তবে ওই নির্দেশে বলা হয়েছে, আদালতের ছাড়পত্র ছাড়া প্রযো়জক সংস্থাটি
সেন্সর বোর্ড-এর কাছে প্রয়োজনীয় শংসাপত্র নিতে পারবে না এবং আদালতের অনুমতি ছাড়া ছবিটি মুক্তিও পাবে না। সেই সঙ্গে কাকাবাবুর কাহিনি নিয়ে ছবি বা টেলি সিরিয়াল তৈরির স্বত্বের বিষয়টি ফয়সালা করার জন্য মামলায় জড়িত সব পক্ষকে হলফনামা পেশ করতে নির্দেশ
দিয়েছে আদালত।

এই নির্দেশকে অবশ্য দু’টি প্রযোজক সংস্থাই নিজেদের জয় বলে দাবি করছে। কৌস্তুভ খুশি, কারণ তিনি শ্যুটিং করার অনুমতি পেয়েছেন। অন্য দিকে সঞ্জয়বাবুর দাবি, কোর্টের নির্দেশ তাঁদের পক্ষেই গিয়েছে। কারণ, কোর্ট না চাইলে ছবির শংসাপত্র জুটবে না, ছবি মুক্তিও পাবে না।

সুনীল-জায়া স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় কী চান? তাঁর বক্তব্য, ‘‘আদালতের রায়ই সবাইকে মেনে নিতে হবে।
তবে আমার মনে হয়, সুনীলের ভালমানুষির সুযোগ নিয়ে ওঁকে দিয়ে ওই চুক্তিপত্রে সই করানো হয়েছিল। আমি চাই, কাকাবাবু এই নাগপাশ থেকে মুক্ত হোন!’’

আশির দশকের গোড়ায় আনন্দমেলায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘জঙ্গলগড়ের চাবি’। ওই কাহিনিতেই প্রথম বার কাকাবাবুর জীবনসংশয় হয়েছিল। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েক দিন সংজ্ঞাহীন ছিলেন। কাকতালীয় ভাবে সেই কাহিনিই কাকাবাবুকে টেনে নিয়ে গেল আদালতে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement