শ্রীকান্ত ও দেব
আধিপত্যে ফাটল
বলতে গেলে, গত দু’দশক ধরে টলিউডে মৌরসিপাট্টা চালিয়েছে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস। এই দশকের শুরুর দিকেও সেই দাপট বজায় ছিল। এসভিএফ প্রথম বার টাল খেল যখন (২০১৭ সালে) তাদের দীর্ঘ দিনের জুড়িদার সুরিন্দর ফিল্মস আলাদা হয়ে নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা খুলল। তার আগেই হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে এক সময়ের তুরুপের তাস দেব। এর পরেও সংস্থা নিজের মতো বাজার দখলের খেলা চালিয়ে যাচ্ছিল। মোক্ষম আঘাত আসে এই বছর জানুয়ারি মাসে। রোজভ্যালির টাকা গরমিলের অভিযোগে সিবিআই গ্রেফতার করে সংস্থার কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতাকে।
এই ধাক্কা সামলাতে টলিউডের অতি বড় সংস্থাকেও বেগ পেতে হয়েছে। ছবি তৈরির সংখ্যা কমে গিয়েছে। তবে এরা ভাঙে কিন্তু মচকায় না। তাই পরিস্থিতি বুঝে চুক্তিবদ্ধ অভিনেতাদের আর ধরে রাখেনি সংস্থা। আবীর চট্টোপাধ্যায়, যিশু সেনগুপ্ত, অঙ্কুশ, যশরা অন্যত্র কাজ করছেন। এই টালমাটাল পরিস্থিতিতেও বাণিজ্যিক সাফল্য এসেছে। ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’, ‘ভিঞ্চিদা’, ‘গুমনামী’ এ বছর ভাল ব্যবসা করেছে।
এত ভাঙা-গড়ার মাঝেও এই দশকের শেষে টলিউডের ভরকেন্দ্রে এসভিএফ রয়েছে। যদিও ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়ের সংস্থা উইন্ডোজ় এবং সুরিন্দর ফিল্মস।
নন্দিতা-শিবপ্রসাদ
স্টারডমের সংজ্ঞা বদল
এই বদল গোটা দেশ জুড়েই। বাণিজ্যিক ছবির সংজ্ঞা বদলের সঙ্গে স্টারডমের ধারণাও বদলে গিয়েছে। এই দশকের মাঝামাঝি থেকেই বাণিজ্যিক মশালা জঁরের ছবি বক্স অফিসে ব্যর্থ হতে থাকে। সেই সঙ্গে দেব-জিতের মতো নায়কেরাও কোণঠাসা হতে শুরু করেন। দশকের মাঝে যে পালাবদল ঘটতে শুরু করেছিল, তার ফল দশকের শেষে স্পষ্ট। দেব নিজের ঘরানা বদলে অন্য ধারার ছবিতে অভিনয় করছেন, বিনিয়োগ করছেন। দেরিতে হলেও জিৎ তাঁর ছবির বাছাইয়ে বদল এনেছেন।
কমার্শিয়াল ছবির তারকারা যেমন অন্য ধারার ছবিতে আগ্রহী হয়েছেন, তেমনই আবীর, যিশু বা ঋত্বিক চক্রবর্তীর মতো অভিনেতারা নিজেদের পরিধি বিস্তার করেছেন। উঠে এসেছেন ঋদ্ধি সেন, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়েরা। কনটেন্ট এবং অভিনয় এই দুইয়ের গুরুত্ব বাড়ার ফলে টলিউডের মূলস্রোতের মুখ এখন এঁরাই। ২০১৮ সালে ‘নগরকীর্তন’ ছবির জন্য সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন ঋদ্ধি।
যিশু-আবীর ছবি: দেবর্ষি সরকার
পরিচালকই কান্ডারি
বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে বরাবরই পরিচালকদের আলাদা লেগাসি রয়েছে। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের নামে দর্শক সিনেমা হলে যেতেন। নব্বইয়ের দশকে সেই প্র্যাকটিস প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ব্যতিক্রম ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেন। বর্তমান দশকের গোড়ায় দর্শক আবার হলমুখী হন সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়ের হাত ধরে। ‘অটোগ্রাফ’, ‘শব্দ’ বদলে দিয়েছিল বাংলা ছবির ভাষা। শিবপ্রসাদ-নন্দিতা দেখিয়ে দেন, কেমন করে বাঙালির ঘরের গল্প বলতে হয়। উঠে আসেন অরিন্দম শীল, অতনু ঘোষ, অনীক দত্ত, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়রা। ছকভাঙা গল্প বলতে এগিয়ে এসেছেন আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত, প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য, ইন্দ্রাশিস আচার্য, সৌকর্য ঘোষালেরা।
গোয়েন্দাগিরি
বাঙালির গোয়েন্দাপ্রীতি যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা এই দশকের বক্স অফিস বলে দিচ্ছে। একাধিক পরিচালক, একাধিক অভিনেতাকে নিয়ে ব্যোমকেশ বক্সী করেছেন। সব ছবিই কম-বেশি সফল। এই ট্রেন্ডের অন্যতম কারিগর অরিন্দম শীল। যদিও অনেকের মতে, গোয়েন্দা ছবির ওভারডোজ় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ কথা তো দর্শকই বলবেন।
দশকের শেষে টিপিক্যাল গোয়েন্দা জ়ঁরের বদলে অ্যাডভেঞ্চার ঘরানা গুরুত্ব পাচ্ছে। এর সফলতম কারিগর ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়। মৌলিক কাহিনি অবলম্বনে সোনাদা সিরিজ় নিয়ে এসেছেন তিনি। সায়ন্তন ঘোষালও অ্যাডভেঞ্চার জ়ঁরের ছবি বানিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন। সুতরাং আগামী দশকে গোয়েন্দা কাহিনির সংখ্যা কমে রহস্য-অ্যাডভেঞ্চারের তালিকা দীর্ঘ হতেই পারে।
ডিজিটাল উত্থান
সব কিছুরই ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক থাকে। অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিস বদলে দিয়েছে সিনেমার পরিভাষা। মোবাইলে সিনেমা দেখার অভ্যেস চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে সিনেমা হলকে। সেই মতো নির্মাতারা তাঁদের স্ট্র্যাটেজি বদলেছেন। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলায় সিনেমা, সিরিজ় তৈরি হচ্ছে। অনলাইনের প্রতিপত্তি বাড়ার সঙ্গে কমে গিয়েছে টেলিভিশনের স্বত্বের অঙ্ক। ফলে প্রযোজকেরা বাজি ধরছেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের রাইটসের উপরে। তবে বাংলার বাজার এখনও এতটা পোক্ত হয়নি যে, স্বত্ব বিক্রির জোরে মুনাফা করবে অনলাইন।
অনুপম কথা
হারিয়ে যাওয়া শ্রোতারা ফিরে এসেছেন, পাশাপাশি নতুন শ্রোতা তৈরি করেছেন অনুপম রায়। বলা হয়, নব্বইয়ের দশকে বাংলা গানের মান পড়ে যায়। তার পর ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাণিজ্যিক ছবিতে এক ধরনের গান শোনা যেত। সৃজিতের ‘অটোগ্রাফ’-এর হাত ধরে অন্য ধরনের লিরিক্স, সুরের অভ্যেস তৈরি হয় আম বাঙালির। নেপথ্যে অনুপম রায়। ক্রমশ বাকি পরিচালকেরাও অনুপমকে দিয়ে কাজ করাতে থাকেন। গোটা দশক ধরে প্রায় একচেটিয়া দাপট বজায় রেখেছেন অনুপম। এই দশকের ট্রেন্ডসেটারের তালিকায় তিনি থাকবেনই।
এই দশক অনেক হিসেবনিকেশ উল্টে দিয়েছে। যাঁরা বদলের সঙ্গী হতে পেরেছেন, তাঁরা টিকে গিয়েছেন। আগামী দিনেও ট্রেন্ড বদলাবে। সেই বদলের শরিক কারা হবেন, সেটাই দেখার।