অঞ্জন দাস
চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে তখন তিনি ভর্তি। খবর পেয়ে ফোন করাতে অনেকক্ষণ বেজে গিয়ে তার পর লাইনটা কেটে গেল। দুপুর নাগাদ একটা কল এল তাঁর ফোন থেকে। ‘অঞ্জন দাস কলিং’। গলার আওয়াজে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। ধীরে ধীরে বললেন শারীরিক অসুস্থতার কথা। জন্ডিস ধরা পড়েছে। বিলিরুবিন খুব বেশি। কথা বলতে গিয়ে দু’মিনিট অন্তর অন্তর হেঁচকি তুলতে থাকেন। কিন্তু নিজে একবারের জন্য বলেন না তাতে অসুবিধে হচ্ছে। বরং পরের ছবিটা কোন চলচ্চিত্র উত্সবে যাবে তা নিয়েই কথপোকথন হল।
তবে বেশিক্ষণ নয়। হেঁচকির দমক বাড়তে থাকে। নিজে যতই বলুন যে কষ্ট হচ্ছে না সেটা তখন বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয়। ওষুধ, ওষুধের কাজ করবে কিন্তু মনের জোর হারাবেন না এই বলেই ফোন রেখে দেওয়া।
পরে খবর আসে সে রাতেই তিনি চেতনা হারান। জ্ঞান ফিরেছিল ঠিকই। সবাই ভেবেছিল মিরাকেলও তো হয়। কিন্তু আফশোস এই ক্ষেত্রে কোনও মিরাকেল ঘটার আগেই অঞ্জন চলে গেলেন। সোমবার ভোরে যখন তাঁর মৃত্যুর খবরটা এল তখন মনে হল যেন এক ‘অজানা বাতাস’ এসে তাঁকে নিয়ে চলে গেল। রেখে গেলেন পরের ছবিটা লন্ডনে শ্যুটিং করার অপূর্ণ ইচ্ছা। আর দায়িত্ব দিয়ে গেলেন যাতে ‘অজানা বাতাস’ ছাড়াও ‘স্বর্গের নীচে মানুষ’ ছবিটাও কোনও দিন মুক্তি পায়।
মৃত্যু। নিয়তি। এ তো কারও হাতে নেই। চৌষট্টিতে চলে গেলেন। গত দু’ বছর ধরে উনি অসুস্থ ছিলেন। ‘সাঁঝবাতির রূপকথারা’, ‘বেদেনি’, ‘ইতি শ্রীকান্ত’, ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ ও ‘বাঁশিওয়ালা’ নিয়ে কত কথা বলেছেন। ইফি-তে ‘অজানা বাতাস’ দেখানো নিয়েও উত্সাহ কম ছিল না এই জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালকের। সিনেমা নিয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু কাউকে তাঁর অসুস্থতার কথা জানাননি। আর যখন কোলন ক্যানসার ধরা পড়ে তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কে ঔদাসীন্যের উদাহরণ সেলিব্রিটি মহলে কম নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো প্রায় দশ বছর ধরে বাড়ির কাউকে জানাননি যে তাঁর ক্যানসার হয়েছে। ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন ডায়াবেটিক। তাও শরীর নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছেন।
নাইট রাইডার্স ট্রফি জেতার পর শাহরুখ খানকে ডিগবাজি খেতে দেখে তাঁর ফ্যানরা তো খুশি। কিন্তু অনেকেরই প্রশ্ন তাঁর ডাক্তার তাঁকে সে ভাবে দেখে কি ততটাই খুশি ছিলেন? কারণ শাহরুখের কাঁধের চোট আর বাঁ হাঁটুর প্যাটেলার সমস্যা। তবে শাহরুখের ঘনিষ্ঠেরা বলছেন তিনি এখন সম্পূর্ণ ফিট। তাই ডিগবাজি খেতে অসুবিধাই নেই। তবে অন্যান্য সেলিব্রিটিদের ক্ষেত্রে এই ক্লিনচিটটা দেওয়া যায় না বলে মনে করছেন অনেকেই। কেন এই উদাসীনতা?
জানিয়ে কী হবে
সুনীল-পুত্র শৌভিক স্বীকার করেছেন যে তাঁর বাবা নিজের শারীরিক অসুবিধের কথা চেপেই যেতেন। “বাবার একটা সার্জারির কথা তো আমরা জানতামই না!” বলছেন শৌভিক। সম্প্রতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী স্বাতীর হাঁটু রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি হয়েছে। অপারেশন ভাল ভাবেই হয়েছে। শৌভিক বলছিলেন, “অনেকে নিজেদের রোগ নিয়ে অনেক কথা বলতে ভালবাসেন। কিন্তু আমার বাবা-মাকে কোনও দিন তা করতে দেখিনি। দু’জনেই খানিকটা চাপা গোছের। আমেরিকাতে থাকাকালীন ডাক্তার দেখাতে গেলে আমাকে জিজ্ঞেস করা হত যে, ফ্যামিলি হিস্ট্রিতে কোনও ক্যানসার রুগি আছেন কি না। বহু দিন পর্যন্ত আমি সেখানে ‘না’ লিখে এসেছি। জানার পর অবশ্য আমি আর সেটা লিখিনি।”
চাইলেও ছাড়া যায় না যে
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
চোদ্দো বছর আগে অভিনয় করতে গিয়ে সিগারেট খাওয়া শিখতে হয় রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে। বহুবার ভেবেছেন এ বার ছেড়ে দেবেন। কিন্তু পারেননি। এমনটা নয় যে, তিনি সিগারেটের কুপ্রভাব সম্বন্ধে সচেতন নন। এটাও নয় যে তিনি মনে করেন, অন্যের ক্ষতি হলেও তাঁর নিজের কিছু হবে না। তবু ছাড়তে পারেন না। কারণ, নিজের জীবনে স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রাথমিক দাবি তাঁর কাছে খুব কম। “মায়ের ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে সেটা কোনও দিন ভুলি না। কিন্তু নিজের চোখ দেখানোর অ্যাপয়েন্টমেন্টটা হয়তো পনেরো বার ভুলে যাব!” স্বীকার করছেন রূপা। মদ্যপানের নেশা নেই। আজকে যদি ঠিক করেন, আগামী ছ’মাস মদ খাবেন না, তা হলে সেটা সহজেই করতে পারবেন। ৪৯ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে মাত্র দু’টো ঘটনা মনে করতে পারেন যেখানে মদ খেয়ে শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছে তাঁর। সিগারেট ছাড়ার কথা ভেবেছেন বারবার। কিন্তু হয়ে ওঠেনি।
“বিদেশের তুলনায় আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসচেতনতা অনেক কম। আগের তুলনায় আজকে হয়তো মদ্যপানের প্রবণতা কমেছে, কিন্তু একদম যে নেই তা বলব না। সিগারেট খাওয়াটা কখন অ্যাডিকশন হয়ে গিয়েছে তা অনেকে বুঝতেই পারেন না। রিহ্যাবের সম্পর্কে সচেতনতাটা আমাদের দেশে অনেকটাই কম,” বলছেন পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। পেশায় চিকিত্সক হওয়া সত্ত্বেও কমলেশ্বর আজ পর্যন্ত স্মোকিং ছাড়তে পারেননি।
ডেডলাইনের মৃত্যু
ঋতুপর্ণ ঘোষ
কানের কাছে কেউ এসে বারবার বলবে যে, লাইফস্টাইলের বদল প্রয়োজন, এটা বোধহয় অনেক সেলেব্রিটি পছন্দ করেন না। এক সময় সঙ্গীত পরিচালক জিত্ গঙ্গোপাধ্যায়ের শুভানুধ্যায়ীরা অনেক বারই তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। চা, সিগারেট, মদ কোনওটাই জিত্ খেতেন না। কিন্তু মুম্বই-কলকাতা ছুটোছুটি করতে গিয়ে নিজের এমন শিডিউল তৈরি করেছিলেন যে, সেখানে ঘুমের জন্য প্রতিদিন বরাদ্দ থাকত মাত্র ২ ঘণ্টা। মাঝেমধ্যে সেটাও হত না। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল ঠিক সময়ে না-খাওয়া।
মিউজিকের সিটিংয়ের সময় কচুরি থেকে মাংস-ভাত জিত্ দারুণ এনজয় করতেন। কিন্তু সব কিছু পাল্টে গেল ২০১২-য়। অসুস্থ হয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি হলেন তিনি। ১২ দিন টানা হাসপাতালে। সেই সময় প্রথমবার বুঝতে পারলেন লাইফস্টাইল পাল্টাতে হবে। স্ত্রী চন্দ্রাণী তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন যে, ডেডলাইনের চাপ নিয়ে সারাক্ষণ টেনশন করতে গিয়ে তিনি ভুলেই যাচ্ছেন যে, কোনও দিন ‘লাইনটাই ডেড হয়ে যেতে পারে!’ জিত্ এখন অনেক বেশি স্বাস্থ্য-সচেতন। বলিউড-টলিউড মিলিয়ে আগের থেকে কাজের ব্যস্ততা অনেক বাড়লেও এমনভাবে নিজের শিডিউলটা তৈরি করেন যাতে ঘুমের ঘাটতি না-হয়। “তেলেভাজার লোভ ছাড়তে পারেনি ঠিকই। তবে রেড মিট আর ছুঁয়ে দেখেনি জিত্,” বলছেন চন্দ্রাণী।
কথা না শোনা
মারাত্মক কিছু হওয়ার আগেই জিত্ নিজেকে সামলে নিয়েছেন। কিন্তু অনেকেই আছেন যাঁরা কারও কথায় কান দেন না। সোশ্যাল ড্রিঙ্কিং একরকম। কিন্তু রোজ সন্ধেবেলায় চার-পাঁচ পেগ মদ খেয়ে আড্ডা না-মারলে তাঁদের রাতের ভাত হজম হয় না। এই থেকেই জন্মায় আসক্তি। কিন্তু কারও সাধ্য নেই ভুল করেও তাঁদের রিহ্যাবে যেতে বলবেন। অনেকে আবার সব কিছু জেনে বুঝে ছাড়তেও চান না। পরিচালক শেখর দাশ বলছেন, “আমি একা থাকি। দিনে দু’টো সিগারেট খাই। রোজ রাত সাড়ে ন’টার পরে যখন একটা বই নিয়ে বসি বা একটা ভাল সিনেমা দেখি তখন আমার দু’আড়াই পেগ মদ খেতে দারুণ লাগে। এটা আমি কিছুতেই ছাড়তে চাই না।” তার সঙ্গে জানাচ্ছেন যে, এমন অনেকে আছেন যাঁরা আবার রোজ একসঙ্গে ড্রিঙ্ক করতে পছন্দ করেন। “আমার ধারণা তাঁরা আমার থেকে বেশি খান। আসলে ওই সময় আড্ডা দিতে দিতে এমন সব আলোচনা হয়, তখন ড্রিঙ্কের মতো একটা ইম্পেটাস দরকার হয়। এ ছাড়াও বলব, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একটা সেল্ফ ডেস্ট্রাকশনের কালচারও আছে,” বলছেন তিনি। তবে তার সঙ্গে যোগ করছেন যে তিনি স্বাস্থ্য নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক। শ্যুটিংয়ের আগে সব টেস্ট করিয়ে দেখে নেন, পুরো সুস্থ আছেন কি না। শেষ টেস্টের সময় দেখেছেন লিভারটা ঠিক আছে।
ফালতু জ্ঞান দিও না
ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির শ্যুটিংয়ের ঝক্কি এক রকম। শিল্পীদের দুনিয়ায় অনিয়ম কম থাকে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাভেল করতে হয় শোয়ের জন্য। অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে মধ্যরাত। তারপর পার্টি। সেখানে খানাপিনা। সাম্প্রতিক কালে এক পাওয়ার যোগা ইন্সট্রাকটরকে বাড়িতে ডেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন উস্তাদ রাশিদ খান। তার সঙ্গে জিমেও ভর্তি হয়েছেন। “তবে একদিন জিম করার পরের দিন কনসার্ট আছে বলে গেলই না। ওকে মোটিভেট করতে গিয়ে আমি নিজেও ওয়ার্কআউট শুরু করেছি। রান্না করতে ভালবাসে কিন্তু নিজে মাসে দু’বারের বেশি মাংস খায় না। ভোরবেলা কনসার্ট থেকে ফিরলে আমি চেষ্টা করি যাতে সকালটা ও ঘুমাতে পারে। ফোন বন্ধ করে দিই। লাঞ্চের বদলে তখন ব্রাঞ্চ দিই,” বলছিলেন শিল্পীর সহধর্মিণী সোমা খান।
শো থাকলে একদম নিরামিষ খান সঙ্গীতশিল্পী। আর ড্রিঙ্কস্? সেটা কী ভাবে কনট্রোল করেন উনি? “আমার আড়ালে গিয়ে কোনও দিন রাশিদ হার্ড ড্রিঙ্ক করবে না। সেটুকু আমি জানি। তবে নাম না করেই আমি বলতে পারি যে, এমন অনেক শিল্পী আছেন, যাঁরা একদম স্বাস্থ্য-সচেতন নন। মনে করেন, এ সব ফালতু জ্ঞান,” বলছেন তিনি।
স্তাবকদের বিড়ম্বনা
তবে যেটা অনেক সময় ঝামেলা করে তা হল স্তাবকতা। বলিউডে এক সময় অনেক তারকা ছিলেন, যাঁরা রোজ সন্ধেবেলা নিজেদের সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে আড্ডা দিতে বসতেন। তাঁদের সঙ্গে যাঁরা উল্লাসে মাততেন তাঁরা নিজেদের তাগিদে একবারও সেই তারকাকে মনে করিয়ে দিতেন না যে, রোজ রোজ এমনটা করলে শরীরের ক্ষতি হবে। কারণ? বিনা পয়সায় ফুর্তি করতে পারার জোগানদারদের ভাল চাওয়াটা তো কোনও দিনই তাঁদের মূল লক্ষ্য নয়। বরং ফ্রি-তে উল্লাস করতে পারার লোভটাই প্রাধান্য পেয়েছে। আর সেটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নেশামুক্তি নিয়ে কাজ করছেন বেশ কয়েক বছর অভিনেতা ববি চক্রবর্তী। মে মাসে তিনি ফেসবুকে রজতাভ দত্তকে নিয়ে একটা লেখা পোস্ট করেন এই বলে যে, ‘রজতাভ ইজ কমপ্লিটলি স্মোক ফ্রি, অ্যাডিকশন ফ্রি’। “রনিদা ছিল চেন স্মোকার। প্রথম প্রথম যখন ছাড়লেন তখনও সেটা কাউকে জানতে দেননি। কারণ রনিদা বলেছিলেন সম্পূর্ণ ভাবে না ছাড়তে পারলে সেটা বলার মানে হয় না। মে মাসে বললেন একদম ছেড়ে দিয়েছেন,” ববি বলছেন। টলিউডের সবাই যে ফিট থাকা নিয়ে সচেতন নন সেটা বলতে আপত্তি নেই ববির। বললেন, “এঁদের সঙ্গে কিছু নেশাসক্ত স্বার্থপর লোক থাকেন যাঁরা চান না যে এঁরা নেশামুক্ত হন।”
সেই একই কথা বলছেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। “ছোট ইনসুলার গণ্ডির মধ্যে এঁরা থাকেন। সারাক্ষণ স্তাবক পরিবেষ্টিত। তাঁরাই কৃত্রিম আশ্বাস দিয়ে যান,” বলছেন পরিচালক।
বাঁচতে গেলে নিজস্ব ‘পয়জন’ দরকার
ছ’ মাস আগে সিগারেট ছেড়েছিলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। তবে তার বদলে খাওয়াদাওয়া বেড়েছে। শুধু বেড়েছে বললে কম বলা হয়। সম্প্রতি ঢাকায় গিয়ে যে ছবিটা আপলোড করলেন তাতে চার রকমের মাংসের পদ। কচ্চি বিরিয়ানি, মুর্গির রোস্ট, বিফ-ভুনা, জালি-কাবাব। তা এত মাংস খেলে শরীরের ক্ষতি হচ্ছে না? “আপাতত হয় না। আমার এত রেডমিট খাওয়া আসলে বারণ। কিন্তু ওই যে এভরিবডি নিডস হিজ অর হার ওন পয়জন টু লিভ,” বললেন সৃজিত। তা এত খাবারের ছবি দেখে ডাক্তার কী বলছেন তাঁকে? নাকি ডাক্তারকে ফেসবুক থেকে ব্লক করে দিয়েছেন? উত্তরে হেসে বললেন, “মা (পেশায় ডাক্তার) ফেসবুকে নেই।” আর এক্সারসাইজ? তা নাকি শুধু গ্রে সেলসের হয়। আর ক্রিকেট খেলা-শ্যুটিংয়ের সময় নিজের পেশির! তবে জিম জয়েন করবেন বলে ভাবছেন। যেখানে ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত আর পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় যান। “ওখানে ভাল আড্ডা হয়। আর কোনও কারণ নেই,” হেসে জানান তিনি।
বোহেমিয়ান হওয়াতেই যেন সুখ
কিছু মানুষ এমন আছেন যাঁদের কাছে বোহেমিয়ান জীবনটাই বেশি প্রিয়। অসুখ থাকবে অসুখের মতো। তার জন্য ডাক্তার বদ্যি আছেন। কিন্তু তাই বলে নিজের জীবনযাত্রাটা পাল্টাতে হবে নাকি? তাঁদের বক্তব্য, নেশা যদি ছেড়েই দেওয়া যায় তা হলে বাঁচার আনন্দ থাকবে কোথায়? প্রসঙ্গত সুনীল-পুত্র শৌভিক জানান, “বাবার ক্ষেত্রে দেখেছি উনি কোয়ানটিটি অফ লাইফের থেকে অনেক বেশি প্রাধান্য দিতেন কোয়ালিটি অফ লাইফকে।”
তবে সবাই যে সুনীল-শক্তি-ঋত্বিক নন, তা অনেকেই বোঝেন না। গৌতমের মতে একটা সময় বোহেমিয়ান জীবনটাই অনেক শিল্পীকে আকর্ষণ করেছে। “আমাদের আগের জেনারেশনে সেটা খুব হত। মননের দিক থেকে একটা বিদ্রোহ ঘোষণা করার প্রবণতা ছিল। কিন্তু এখন সেটা কমেছে। তবে যেটা বেড়েছে তা হল আর্থিক অনিশ্চয়তা। আর একটা কৃত্রিম ভাবমূর্তি ধরে রাখার চেষ্টা। লাইফস্টাইল বজায় রাখতে হবে বলে চাপে ভুগতে থাকেন তাঁরা সারাক্ষণ,” বলছেন গৌতম।
পরিচালক নিজে আর সিগারেট কিনছেন না। রোজ ব্যায়াম করেন। “আমার বাড়িতে কোনও ‘বার’ নেই। খাওয়াদাওয়া সম্পর্কে আমি সচেতন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার চেহারাটা কেন পাল্টায়নি। উত্তরে বলেছিলাম, বাজারে আমার কোনও ধার নেই। ইএমআই দেওয়ার চাপ নেই,” হেসে বলছেন গৌতম। অঞ্জনের সঙ্গে তাঁর তিরিশ বছরের বন্ধুত্ব। হাসপাতালে গিয়েও ওঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। “মনে হয় না ও ঠিক বুঝতে পেরেছিল যে ওর কী হয়েছে। ও তো শুধু জন্ডিস নিয়ে কথা বলছিল। ‘অজানা বাতাস’য়ের রিলিজ নিয়ে চিন্তা ছিল খুব। এর পর কী ছবি করতে চায় সেই কথাও বলছিল,” ভারাক্রান্ত গৌতম জানান।
আশা রাখি
বলিউডের একটা সময় ছিল যখন তারকারা খুব বেপরোয়া জীবন যাপন করতেন। বহু পরিচালক জোর দিয়ে বলতেন যেহেতু তাঁদেরকে ক্যামেরার সামনে আসতে হবে না তাই ফিট থাকার প্রয়োজন নেই। কিন্তু কর্ণ জোহর থেকে অয়ন মুখোপাধ্যায়, ফারহান আখতার থেকে আশুতোষ গোয়ারিকর সবাই আজকাল শরীর সম্পর্কে সচেতন। তবে টলিউডে সেই সচেতনতা আসেনি। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী বলছেন, উনি স্বাস্থ্য সচেতন নন, মন সচেতন। বাড়িতে যোগা শিক্ষক আসার আগে অনিরুদ্ধ ভরপেট খেয়ে নেন। “আরে, আমি খেতে ভালবাসি। এই যা। আগে মন দিয়ে যোগা করতাম। এখন শুধু ‘বেবি ফ্যাট’ আছে। তার জন্য স্ট্রেচিং আর মাসাজ নিই,” হেসে বলছেন অনিরুদ্ধ।
রূপা অবশ্য সিগারেট ছাড়ার চেষ্টা করেছেন। “ছাড়ার পর যখন ধরতে গিয়েছি তখন দেখছি আরও বেশি সংখ্যায় সিগারেট খেয়ে ফেলছি। আমি খুব নিঃসঙ্গ। লোকে আমায় ভুল বোঝে। সিগারেট ছেড়ে খুব খিটখিটে আর ইরিটেটেড হয়ে থাকি। উইথড্রল সিম্পটমটা মারাত্মক হয়ে পড়ে। এই দুনিয়ায় মাত্র দু’জন মানুষ আছেন যাঁরা আমার উইথড্রল সিম্পটম হলেও সহ্য করে যাবে। ছোটবেলার বন্ধু মৌসুমী আর বোন সোনা। সিগারেট ছেড়ে দিলে কাউকে পাশে না পাওয়ার ভয়টা আমায় গ্রাস করে,” বলছেন রূপা। এমনটাও বলছেন সুখটানের ওপর হয়তো নির্ভরতা এসে গিয়েছে। হয়তো বা ভাবেন যে, অন্যরা ভুল বুঝলেও সিগারেট তাঁকে কোনও দিন ভুল বুঝবে না। তবে শেষ পর্যন্ত আশাবাদী রূপা বলছেন, “আমি সত্যি সিগারেট ছাড়তে চাই। একটা অপরাধবোধ কাজ করে। যাঁরা ছাড়তে পেরেছেন তাঁদের আমার হিংসে হয়। এখনও স্বপ্ন দেখি কোনও এক সকালে উঠে দেখব আর আমার সিগারেট লাগছে না।”
আমরা অপেক্ষায় রইলাম।
ধুত্, ও কিছু না
স্টিভ জোবস
“অক্টোবর ২০০৩-এ প্রথম প্যানক্রিয়াসে ক্যানসার ধরা পড়ে স্টিভ জোবসের। প্রায় এক বছর এ ব্যাপারে কোনও রকম উদ্যোগী হননি তিনি। এমনকী অপারেশনের পর কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপিও নেন না। মনে করেন চিকিত্সার বদলে নিরামিষ ডায়েটই তাঁকে সারিয়ে তুলবে। প্রকৃত চিকিত্সা শুরু হয় ছ’বছর পর, ২০০৯-এ। ৫ অক্টোবর ২০১১য় মৃত্যু হয় স্টিভ জোবসের”
বব মার্লে
“জুলাই ১৯৭৭। ফুটবল খেলছিলেন বব মার্লে। চোট পান পায়ের আঙুলে। সে থেকে ক্যানসার। ডাক্তারের অনেক বলা সত্ত্বেও অপারেশনে রাজি হননি তিনি। পরের তিন বছর বেশ কয়েকটা লাইভ শোতে পারফর্মও করেন। ১৯৮০তে পিটস্বুর্গে শেষ কনসার্ট করেন তিনি। কিন্তু তত দিনে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরে। ১১ মে ১৯৮১তে মারা যান তিনি”
চিকিত্সকরা যা বলছেন
“নেশা-নির্ভরতা সেলিব্রিটিদের মানসিক ব্যাপার। ওঁদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যাঁরা মানা করলেও শুনতে চান না। এটা এক ধরনের বেপরোয়া বোহেমিয়ানিজম। বিদ্বজ্জনেরা অনেকেই মনে করেন, তাঁরা মননশীল, ক্রিয়েটিভ। এমন কিছু কাজ করতে পারেন বা ভাবতে পারেন যা সাধারণে পারবে না। তাই নেশাটা তাঁরা করতেই পারেন। নিজেদের সৃজনশীল ভেবে এমন একটা পরিতৃপ্তি কাজ করে যে জীবনের ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটতে পারে এটা মাথায় আসে না”
ডা. রাজীব শীল
“কসমেটিক সার্জারির ক্ষেত্রে আমি বলব না সেলিব্রিটিরা সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা। অল্পবয়েসি সেলিব্রিটিরা খুব স্বাস্থ্য সচেতন। অসুবিধা হয় তিরিশ বা পঁয়ত্রিশের কোঠা পেরোলে। চেহারাটা ঠিক রাখতে ওঁরা উদগ্রীব হয়ে যান। না হলে সিনেমা থেকে বাদ। আর্থিক অসুবিধা। কিছু সেলিব্রিটি কম সময়ে একাধিক সার্জারি করতে চেয়েছেন। আর একটা সমস্যা হল সারাক্ষণ চিকিত্সাতেই আসক্তি। তবে এটা শুধু সেলিব্রিটিদেরই সমস্যা নয়”
ডা. মণীশ মুকুল ঘোষ