১৪ অগস্ট, রাত সওয়া দশটা। তিন ঘণ্টা আগে তাঁর পরের ছবি ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’য়ের ট্রেলর লঞ্চ করেছেন।
লঞ্চের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের টপ ফাইভ টুইটার ট্রেন্ডিংয়েই তিনি। ইউটিউবে লক্ষ লক্ষ ভিজিট। ফেসবুকে লাইকসের ছড়াছড়ি।
মুম্বই মিডিয়ার সঙ্গে প্রেস কনফারেন্স শেষ করে তখন তিনি এসে বসেছেন সাহারা স্টার হোটেলের তিন তলার কনফারেন্স রুমে।
এর পরেও ভিন্প্রদেশ থেকে আসা জনা কুড়ি সাংবাদিকের সঙ্গে আরও এক খেপ প্রেস কনফারেন্স শেষ করে এই মুহূর্তে তিনি দুবাইয়ের কাগজগুলোর সঙ্গে ওয়েবচ্যাট করছেন।
এর মাঝেই তাঁর সেক্রেটারি করুণা বদওয়াল জানালেন, সে দিন সকাল সাতটায় নাকি উনি ঘুমোতে গিয়ে উঠেছেন সকাল দশটায়। কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই তাঁর কোনও ক্লান্তি আছে বলে। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে তাঁর পাবলিসিস্ট মাণ্ডভি শর্মা জানালেন মিডিয়া ইন্ট্যার্যাকশনের জন্য এক্সট্রা এক ঘণ্টা দেবেন, এটা নাকি সকালেই জানিয়ে দিয়েছিলেন কিং খান।
“ওঁর মতো মিডিয়াটা তো কেউ বোঝেন না। ভারতের সব বড় কাগজ ওঁর টেবিলে রাখতে হয় সকালবেলা। আজকাল আঞ্চলিক মিডিয়া যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা সব সময় আমাদের বলেন তিনি,” বলেন মাণ্ডভি।
ওয়েবচ্যাট করার সময় দেখলাম পাশে রাখা লাল রঙের ক্ল্যাসিক সিগারেটের প্যাকেট হুহু করে শেষ হওয়ার আগেই তাঁর ‘বয়’ নতুন সিগারেটের প্যাকেট রেখে যাচ্ছে ‘সাব’য়ের জন্য। সঙ্গে রয়েছে বেগুনি রঙের লাইটার। যা ভারতের যে কোনও সিগারেটের দোকানে পাওয়া যায়।
এর মধ্যেই বাথরুমে যাওয়ার সময় কলকাতার সাংবাদিককে দেখে দাঁড়ালেন। বললেন, “ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে যাক। তার পরে বসব আপনার সঙ্গে। বিশেষ কথা আছে আমার।”
এত দিন কিং খানের ইন্টারভিউ করার পর এটা বুঝেছি, শাহরুখ যখন ফিসফিস করে কিছু ‘বিশেষ কথা আছে’ বলেন, ফিল্ম জার্নালিস্ট নিশ্চিত হতে পারেন, কপির হেডলাইন কী হবে সেটা নিয়ে আর ভাবতে হবে না।
রাত ততক্ষণে পৌনে এগারোটা। ঘর খালি। গোটা পাঁচেক ‘রেড চিলিজ’য়ের ছেলেমেয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে তাঁদের বস সম্বন্ধে কী লেখা হচ্ছে তার ডেটাব্যাঙ্ক বানাচ্ছেন।
এর মধ্যেই জামার ওপরের দুটো বোতাম খুলে সামনে বসলেন শাহরুখ।
শুরুই করলেন শাহরুখ স্টেপ আউট করে।
এর আগে জওয়ানদের সঙ্গেও নেচেছি
“আচ্ছা কলকাতায় কী হচ্ছে বলুন তো?” বেশ বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
বোঝা গেল কেন ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর কথা বলতে চাইছিলেন তিনি। উত্তর জেনেও পাল্টা প্রশ্ন করলাম, আপনি কি পুলিশের ফাংশনে আপনার নাচ নিয়ে কনট্রোভার্সির কথা বলছেন?
সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে শাহরুখ বলেন, “অফ কোর্স। কীসের এত কনট্রোভার্সি? শুনুন এটা লিখবেন, যা করেছি বেশ করেছি। বেশ করেছি নেচেছি,” বলে থামালেন শাহরুখ।
পরের প্রশ্ন করার আগেই বললেন, “এটা কেন হচ্ছে জানেন? ওই পুলিশকর্মী মহিলা বলে। আরে, দু’জন পুরুষ পুলিশ অফিসার যে আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারল সেটা তো কেউ দেখল না। মানে ইউনিফর্ম পরে ইয়ার্কি মারা যায়, নাচা যায় না? আরে, এর আগে আমি বর্ডারের জওয়ানদের সঙ্গে নেচেছি। সারা পৃথিবীতে পারফর্মারেরা আর্মড ফোর্স বা পুলিশদের এন্টারটেন করে। এটা সেই স্পিরিটেই নেওয়া উচিত। আর প্লিজ এটা লিখবেন আমি বেঙ্গলে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নেচেছি। ওঁর সঙ্গে যদি নাচতে পারি বাংলার যে কোনও নারীর সঙ্গে নাচতে পারি। তাঁর ইউনিফর্ম থাকুক কি না থাকুক,” রেগেই বলেন শাহরুখ।
প্রোজেক্টরটা কিনে নিলাম
এত দিন ইন্টারভিউ করার পর এটা বুঝতে পারি, ইন্টারভিউই যদি এতটা স্টেপ আউট করে, তা হলে ইন্টারভিউয়ারের এক রান নিয়ে নিয়েই খেলা উচিত।
তাই ‘জয় হো’ নিয়ে বক্তব্য শেষ হওয়ার পরে ফিরলাম ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ প্রসঙ্গে। যা আয়োজন দেখছিলাম দুপুর থেকে, মনে হল শুধু ট্রেলর লঞ্চেই অন্তত তিন থেকে চার কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছেন তিনি।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রত্যেক বার নিজেকে এতটা স্ট্রেচ করেন কেন? একটা ছোট ছবিও তো বানাতে পারেন?’ প্রশ্ন শেষ না-হতেই উত্তর দেন কিং খান: “বানিয়েছি তো ছোট ছবি। ‘চক্ দে’ ছোট ছবি ছিল, ‘পহেলি’ ছোট ছিল। কিন্তু আমার এই বড় রিস্কগুলো নিতে ভাল লাগে। কেন? কারণ, আমি শাহরুখ খান। আমি নেব না তো কে নেবে? আর এত দিন কাজ করে বুঝেছি যদি ছোট ছোট জিনিসগুলো ঠিক করা যায়, কোনও কিছুই বড় মনে হয় না। আর আমি ‘অ্যাটেনশন টু ডিটেল্স’য়ের ফিলোজফিতে খুব বিশ্বাস করি। আজকের কথাই বলছি। কালকে রাতে, আই লস্ট ইট। হঠাৎ করে রাতে প্রোজেকশনটা দেখে আমার মনে হল এটা ঠিক নেই। সঙ্গে সঙ্গে পিভিআর-কে ফোন করলাম। ওদের সবচেয়ে বড় প্রোজেক্টরটা চাইলাম। কিন্তু ওরা কারও সঙ্গে সেটা শেয়ার করে না। তাই কিনেই ফেললাম প্রোজেক্টরটা। আপনারা দেখলে বুঝতেও পারতেন না তফাতটা। কিন্তু আমি করলাম কারণ আমার কাছে দর্শকেরা হল বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে আসা অতিথি। আমি যেন তাদের বেস্ট খাবারটা দিতে পারি। আজকে আমি প্রোডিউসর হিসেবে ফিল্মটা সে ভাবেই বানাই,” বললেন গৌরী খানের বেটার হাফ।
আমরা ‘টেকিং ইট ইজি’ বলি, ‘গিভিং ইট ইজি’ নয়
কিন্তু এতে তো চাপও নিতে হয়। একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছেন। এত চাপ দিনের পর দিন ভাল লাগে আপনার?
“ধুর্, প্রেশার না-থাকলে মজা কোথায়!” হেসে বলেন ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’য়ের ‘চার্লি’।
ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিতে দিতে আবার শুরু করেন কথাবার্তা। “এই যে ফারহা খান আমার উপর ভরসা করে, আদিত্য চোপড়া ভরসা করে, কর্ণ জোহর ওর সব ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে আমার ইমেজ তৈরি করে, সেই মানুষগুলোকে রিটার্ন দিতে পারার মজাটাই আলাদা। এটা প্রেশার না, চ্যালেঞ্জ। আর এত দিন পর এটা বুঝেছি, দেওয়ার মতো ভাল জিনিস নেই পৃথিবীতে। সেটা তোমার ভালবাসা হোক, তোমার হার্ড ওয়ার্ক হোক। শুধু দাও। আজকে আমি এই স্টেট-অব-মাইন্ডে চলে গিয়েছি। এবং এটাও জানবেন, দেওয়া অনেক কঠিন। তাই বোধহয় আমরা ‘টেকিং ইট ইজি’ বলি, ‘গিভিং ইট ইজি’ নয়,” বলেন বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।
আমার মতো ভুল কেউ করেনি জীবনে
বুঝতে পারি আজকাল শাহরুখের সঙ্গে কথা বলার পর মুম্বইয়ের সাংবাদিককুল কেন তাঁকে ‘ফিলোজফার’ শাহরুখ বলেন।
সেই ‘ফিলোজফিকাল’ শাহরুখকে একটা প্রশ্ন করতে তাই ইচ্ছে হয়।
ট্রেলরে দেখছিলাম এই ছবিতে শাহরুখের চরিত্র নাকি জীবনে পরাজিত এক ‘লুজার’য়ের।
সেই প্রসঙ্গ টেনেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভারতে কেউ তো শাহরুখকে লুজার বলে মনে করে না। শাহরুখ মানেই জিত। তা জীবনের কোনও ঘটনা এমন আছে, যেখানে শাহরুখ খান নিজেকে হেরো মনে করেছেন?’
“আছে আছে। অনেক ঘটনা আছে, যে দিন রাতে বাবা চলে গেলেন, সে দিন নিজেকে লুজার মনে হয়েছিল। যে দিন মা চলে গিয়েছিলেন, সে দিন সারারাত কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে লুজার মনে হয়েছিল। কেকেআর যখন জিতছিল না, তখন নিজেকে অসম্ভব বড় লুজার মনে হত। যখন ‘চক্ দে’ করলাম, তখন লোকে বলল ছবিটা হিট হয়েছে ফ্লুকে, সে দিন লুজার মনে হয়েছিল। আরে, জীবনে ৫০টা ছবির মধ্যে ৩৫টা ফ্লপ দিয়েছি। আমি জানি লুজারের ফিলিংটা। আমার মতো এত ভুল কেউ করেনি জীবনে। কিন্তু আমি পালিয়ে যাইনি বক্সিং রিং থেকে। সে জন্যই আমি উইনার। তার জন্যই কেকেআর শুধু একবার নয়, দু’-দু’বার জিতেছে আইপিএল। তাই ৩৫টা ফ্লপ দিয়েও আমার সিভিতে ‘বাজিগর’, ‘ডর’, ‘দিলওয়ালে...’, ‘কুছ কুছ...’, ‘দেবদাস’, ‘স্বদেশ’, ‘ওম শান্তি ওম’য়ের মতো ছবি রয়েছে। হ্যাঁ, বাবা-মাকে ফেরাতে পারিনি, কিন্তু রোজ রাতে তাঁদের কথা ভাবি। তাই আমি উইনার,” বলেন শাহরুখ খান।
আমার জায়গা থেকে দেখলে পৃথিবীটা অন্য রকম
এর মধ্যেই দেখলাম একটার পর একটা ফোন আসছে। সবাই ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’য়ের ট্রেলর দেখে প্রশংসা করছেন। আর শাহরুখ সবাইকে ‘থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে জবাব দিচ্ছেন। দু’-একজনকে বাড়িতে উইকএন্ডে নেমন্তন্নও করলেন।
ফোন শেষ হওয়ার পর জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই যে এত খ্যাতি, এত নাম। নিজের দিল্লির পুরনো বন্ধুদের মিস করেন না? মুম্বইতে প্রথম দিককার পরিচিত মানুষদের কথা মনে হয় না?
মন দিয়ে প্রশ্নটা শুনলেন শাহরুখ। এই প্রথম মনে হল একটু যেন ভাবুক তিনি। চটজলদি যেমন উত্তর দেন, সেই ভঙ্গিতে না-দিয়ে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন।
“মনে তো পড়েই। ভীষণ ভাবেই পড়ে। তারা তো আজকে আমাকে অ্যারোগ্যান্ট বলে। আজকে নিজেদের মধ্যে আমাকে গালাগালি দেয়। বলে আমি বদলে গিয়েছি। কিন্তু তারা এটা বুঝতে চায় না যে, আমার জায়গা থেকে দেখলে পৃথিবীটা কিন্তু ভীষণ অন্য রকম। আমি দিনে কুড়ি ঘণ্টা কাজ করি। বছরে ৩৬৫ দিন। আমি সকালে উঠে তিন কাপ কফি খাই। তার পর আমি পাবলিকের। আমার নিজের জন্যই সময় থাকে না। ভীষণ একলা লাগলে বাথরুমে চলে যাই। চুপচাপ বসে থাকি। এটাই আমার লাইফ। সারা দিন হাজার ফ্ল্যাশবাল্বের সামনেও অসম্ভব লোনলি একটা জীবন। এবং আশ্চর্যের এটাই যে, আমার এই জীবনটাই ভাল লাগে। সেটা হয়তো আমার পুরনো বন্ধুরা বুঝতে পারে না। তাদের বোঝার উপায়ও নেই আমার লাইফটা কী ডিম্যান্ডিং। দুঃখ হয়। কিন্তু আমার জীবনটা তো আমার নিজেরও কনট্রোলে নেই,” একটানা বললেন শাহরুখ।
বুঝতে পারি সুপারস্টারের জীবনও কতটা লোনলি হতে পারে। একটা পোস্টারের কথা মনে করাই শাহরুখকে। সেই পোস্টারে একটা সিংহের পাশে লেখা ছিল, ‘দ্য প্রবলেম উইথ বিইং স্ট্রং ইজ নোবডি আস্কস্ হাউ ইউ আর’।
শাহরুখ কি নিজেকে পোস্টারটার সঙ্গে মেলাতে পারেন?
“আর ভাবি না। একা তো লাগেই। তখন স্পিরিচুয়ালিটি আমার লাস্ট রিসর্ট। রাতে লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ি। মা-বাবাকে মনে করি। তাঁদের মেমরিকে সেলিব্রেট করি। আর ভাবি, ঘর থেকে বেরোলেই তো আমাকে এক ঝলক দেখে মানুষ কত খুশি হবে। সেই ভালবাসাটার কাছে নিজেকে সারেন্ডার করি। ভাবি, ভগবান আমাকে হয়তো মানুষকে খুশি করানোর জন্যই পাঠিয়েছেন। ওটাই আমার জীবনের ধর্ম,” বলেন কিং খান।
কেউ দেখার আগে ‘পিকে’র পোস্টার আমি দেখেছিলাম
ভাল ফিল্মে যেমন ফার্স্ট হাফে বড় পাঞ্চলাইনওয়ালা সিন থাকে, সেটা তো এই ইন্টারভিউতে ‘জয় হো’র ব্যাপারে পেয়ে গিয়েছি। কিন্তু ছবি হিট তখনই হয়, যখন সেকেন্ড হাফেও পাঞ্চলাইন থাকে।
সেই মতো প্রশ্ন সাজাই মনে। জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি নিজে তো মাস কমিউনিকেশনের ছাত্র ছিলেন। ফিল্মস্টার না-হলে হয়তো কোনও কাগজের বা চ্যানেলের এডিটর হতেন। তখন রিপোর্টার যদি শাহরুখকে আমিরের ‘পিকে’র পোস্টার নিয়ে প্রশ্ন না করত, তা হলে কি ‘এডিটর’ শাহরুখ রেগে যেতেন?
“না, রাগতাম না। রিপোর্টারকে বলতাম প্রশ্নটা না করতে। কারণ, তাতে ‘পিকে’র পোস্টার আর শাহরুখ খানকে ছোট করা হয়,” বলেন শাহরুখ।
কিন্তু কেন ছোট করা হবে?
“ছোট করা হবে কারণ, আমির কী সলমন কী শাহরুখ কিন্তু ২৫ বছর পাগলের মতো কাজ করছে। তাদের ফিল্ম মেকিং নিয়ে তো কেউ প্রশ্ন করছে না। তারা যে ইনসাইট দিতে পারবে, সেটা তো কেউ দিতে পারবে না ভারতে। সেটা কেউ করে না। শুধু, ‘আপনার ট্রেলর ভাল কিন্তু ‘পিকে’র পোস্টার কেন আপনার থেকে বেশি লাইক পেল?’— এটা কোনও প্রশ্ন হল? আরে, তুমি ফিল্ম জার্নালিস্ট। তুমি যদি আমাকে এ রকম ‘চিপ’ প্রশ্ন করো, সাংবাদিক হিসেবে তুমি ততটাই ছোট হয়ে থাকবে। আমায় ফিল্ম নিয়ে প্রশ্ন করো, জিজ্ঞেস করো এত বাজে ছবি কেন করেছি আমি? ওটা তোমার সঠিক প্রশ্ন। আর আমার ডিউটি তোমাকে উত্তর দেওয়া,” বেশ রাগের মাথায় বললেন শাহরুখ।
প্রশ্ন করি, ‘মিডিয়া সম্পর্কে কি আপনি আজকে একটু বীতশ্রদ্ধ?’
“একেবারেই না। মিডিয়া নিজের কাজ করছে। কিন্তু মিডিয়া বোঝে না, আমিরের সঙ্গে আমার রেগুলার কথা হয়। রাজু হিরানি আমার সঙ্গে সব ডিসকাস করে। আমি জানি ‘পিকে’ ছবির গল্প। আমি জানি কেন পোস্টারটা এমন করা হয়েছে। ভারতের কেউ যখন দেখেনি, আমি দেখেছিলাম পোস্টারটা। এগুলো মিডিয়া জানেও না, বোঝেও না। খালি ১০০ কোটি হবে, না ২০০ কোটি— তা নিয়ে নিউজপ্রিন্ট আর এয়ারটাইম খরচ করে। ফিল্ম সাংবাদিকদের একটাই কথা বলব, আপনারা যদি সেন্সিবল প্রশ্ন না করেন ফিল্ম নিয়ে, তা হলে লোকে জানবে কী করে যে আমরা আমাদের ফিল্ম নিয়ে কতটা সিরিয়াস। আমি তো অ্যাক্টর। আমি মজার মজার উত্তর দিয়ে ইন্টারভিউ হিট করিয়ে দেব। কিন্তু তাতে কি আমার কোনও লাভ হবে? হবে না। আমার লাভ তখনই হবে, যখন কোনও সাংবাদিক আমাকে এমন প্রশ্ন করবে যা নিয়ে আমি রাতে বাড়ি গিয়েও ভাবব। হ্যাঁ, আমি হয়তো ‘অ্যাক্সিডেন্টাল সাকসেস স্টোরি’, কিন্তু আমারও তো কিছু বলার আছে। তা না করে বাজে তুলনা আমার আর আমির বা সলমনকে নিয়ে।”
পলিটিশিয়ানরা ফ্যামিলি মেম্বার কেউ বিশ্বাস করে না
ঘড়িতে তখন এগারোটা পাঁচ। বুঝতে পারছি ইন্টারভিউ শেষ হওয়ার মুখে। যেতে যেতে প্রশ্ন করলাম, ‘কলকাতায় কি কোনও স্পেশাল শো করবেন ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’য়ের?’
“আমার ইচ্ছে আছে কেকেআর টিম আর মমতাদির জন্য একটা স্পেশাল স্ক্রিনিং করব। দিদি ইজ লাইক ফ্যামিলি। ভারতে অবশ্য কেউ বিশ্বাস করে না পলিটিশিয়ানরাও ফ্যামিলি মেম্বার হতে পারেন। রাহুল, প্রিয়ঙ্কা, সোনিয়াজিকে নিয়েও কথা বলত লোকজন। আজকে দিদির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা নিয়েও কথা বলে। কেউ বুঝতে চায় না, আমি জেনুইনলি দিদিকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করি,” খোশমেজাজে বলেন শাহরুখ।
ততক্ষণে তাঁর অফিসের সব স্টাফ একে একে বসকে বলে বেরিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছেন। অ্যাশট্রেতে ১৫টার বেশি সিগারেটের ছাই আর শেষ হওয়া ফিল্টার। ইন্টারভিউয়ের জন্য শাহরুখকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, “একটু দাঁড়ান। এত রাতে যাচ্ছেন। আমার অফিস গাড়ির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।”
পরের দিন সকালে তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েক জনকে ফোন করেছিলাম। শুনলাম, সে দিন সারা রাত ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’য়ের ট্রেলরের রিঅ্যাকশন নিয়ে একা একা প্রেজেন্টেশন বানিয়েছেন সকাল ৬টা অবধি। তার পর ফারহা খানকে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নাকি ফোন করেছিলেন এটা বলতে, সেকেন্ড হাফের এডিটটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে। ঘুম থেকে উঠে দুপুর দু’টো থেকে টিভি চ্যানেলের ইন্টারভিউ দিয়েছেন রাত একটা অবধি।
ক’ কাপ কফি, কতগুলো সিগারেট শেষ হয়েছে এর মধ্যে, তার হিসেব অবশ্য কেউ দিতে পারলেন না।
কিন্তু এটা বুঝলাম, শাহরুখের সঙ্গে তাল রাখা যায় না।
হয়তো সে জন্যই তিনি সুপারস্টার।
খুব নিঃসঙ্গ একজন সুপারস্টার।