মুম্বইয়ের কাপড়কলের কর্মীর ছেলে। সেখান থেকে তারকার পরিচিতিতে উত্তরণ। প্রাসাদোপম বাড়ির পাশাপাশি সপ্তাহে সাতদিনের জন্য সাতটি গাড়ি। কিন্তু সবই একদিন চলে গিয়েছিল। অতীতের নায়ক-প্রযোজক-পরিচালক ভগবান দাদা জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নেন কপর্দকহীন অবস্থায়।
মহারাষ্ট্রের অমরাবতী শহরে তাঁর জন্ম ১৯১৩ সালে। বাবার মতো ভগবানও কাপড়কলের কাজে যোগ দেন। কিন্তু তাঁর একমাত্র স্বপ্ন ছিল টিনসেল টাউনের রুপোলি ইন্ডাস্ট্রি।
হিন্দি সিনেমা দেখা ছিল নেশা। কাপড়কলের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরে যে টুকু সময় পেতেন, পড়ে থাকতেন স্টুডিয়ো পাড়ায়। শুধু ছবি দেখে দেখেই শিখে গেলেন নানারকম নাচের খুঁটিনাটি।
একদিন এসে গেলে কাজের সুযোগও। ১৯৩১ সালে প্রথম অভিনয় করলেন নির্বাক ছবি ‘বেওয়াফা আশিক’-ছবিতে। সাত বছর পরে ১৯৩৮-এ প্রথম সহ পরিচালনা করলেন ছবি। যা উপার্জন করতেন, তার বেশিরভাগ টাকা জমিয়ে তিনি ছবি বানাতেন।
কম বাজেটের সেই সব ছবির মূল দর্শক ছিলেন কলকারখানার খেটে খাওয়া মানুষ। তাঁদের মনোরঞ্জনের কথা ভেবেই সহজ সরল চিত্রনাট্যের ছবি তৈরি করতেন তিনি। সেখানে অভিনয়ও করতেন।
১৯৩৮ থেকে ১৯৪৯ অবধি বেশ কিছু কম বাজেটের ছবি বানান ভগবান দাদা। এই পর্বের উল্লেখযোগ্য ছবি ছিল ‘বন মোহিনী’। ১৯৪১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তামিল নায়ক এম কে রাধাকৃষ্ণণ এবং সিংহলি নায়িকা থাভমণি দেবী।
১৯৪২ সালে ‘জাগৃতি পিকচারস’ প্রতিষ্ঠা করে পুরোদস্তুর প্রযোজক হয়ে ওঠেন ভগবান দাদা। পাঁচ বছর পরে চেম্বুরে শুরু হয় জাগৃতি স্টুডিয়ো। ধীরে ধীরে অভিনেতা-প্রযোজক হিসেবে বলিউডের পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন ভগবান দাদা। কিন্তু তার মাঝেই বিপত্তি। ‘জং-এ-আজাদি’ ছবির একটি দৃশ্যের শুটিং-য়ে ভগবান আচমকাই জোরে চড় মেরে বসেন ললিতা পওয়ারকে। তিন মাস চিকিৎসার পরে স্বাভাবিক হয় ললিতার দৃষ্টিশক্তি। কিন্তু রয়ে যায় চিরস্থায়ী ক্ষতচিহ্ন।
রাজ কপূরের পরামর্শে ভগবান দাদা পরিচালনা ও প্রযোজনা করেন ‘আলবেলা’। ১৯৫১ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবির নায়কও ছিলেন তিনি। বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন গীতা বালি।
‘আলবেলা’-র সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ভগবান দাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সি রামচন্দ্র। বক্সঅফিসে সুপারডুপার হিট হয় এই ছবি। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে চিরসবুজ গানও ‘আলবেলা’-র মূল্যবান সম্পদ।
এই ছবি ভগবান দাদাকে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম সারির মুখ করে তোলে। পরিচালক, প্রযোজক, নায়ক হিসেবে তিনি ক্রমশ জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছন। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ভাগম ভাগ’ ছবিতেও তিনি ছিলেন পরিচালক এবং নায়ক। এই ছবিও দর্শকমহলে প্রশংসিত হয়েছিল।
পাশাপাশি, পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে তাঁর ফিল্মোগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য হল ‘রাজা গোপীচাঁদ’, ‘বদলা’, ‘বাহাদুর’, ‘দোস্তি’, ‘নার্গিস’, ‘মতলবি’, ‘বাবুজি’, ‘ঝনক ঝনক পায়েল বাজে’, ‘চোরি চোরি’ ‘হম দিওয়ানে’-এর মতো ছবি।
ভগবান দাদার অভিনয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল নাচ। তাঁর দৌলতেই হিন্দি ছবিতে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের নাচ। শাম্মি কপূর থেকে অমিতাভ বচ্চন, পরবর্তী নায়কদের নাটের স্টেপে ভগবান দাদার গভীর প্রভাব ছিল।
১৯৩১ থেকে ১৯৯৬—এই দীর্ঘ সময় ধরে ভগবান দাদা যুক্ত ছিলেন হিন্দি ছবির সঙ্গে। কিন্তু শেষের দিকে তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছিল কেরিয়ারের শুরুর দিকে। ছোটখাটো যা রোল পেয়েছেন, নিতে বাধ্য হয়েছেন।
তাঁর কেরিয়ারে দুঃসময় এসেছিল বড় তাড়াতাড়ি। বহু পরিশ্রমে একটু একটু করে তৈরি করা তারকার জীবন চুরমার হয়ে গিয়েছিল তাসের ঘরের মতো। সুরকার সি রামচন্দ্র, অভিনেতা ওম প্রকাশ এবং গীতিকার রাজিন্দর কৃষণ ছাড়া বাকি সব সুসময়ের বন্ধু তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সে সময়ে।
যা ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন, সেই সিনেমার নেশা-ই ভগবান দাদাকে নিয়ে যায় শেষের দিকে। একটা সময়ের পর তাঁর ছবি ক্রমাগত ব্যর্থ হতে থাকে।
‘আলবেলা’-র পরের অংশ হিসেবে অনেক আশা করে বানিয়েছিলেন ‘ঝামেলা’ এবং ‘লাবেলা’। দুটি ছবিই বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে।
তিনি চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন ‘হসতে রহেনা’ ছবির সময়। স্ত্রীর অর্থ, নিজের সঞ্চিত আমানত, সব বাজি রেখে তিনি প্রযোজনা করেছিলেন এই ছবির। কিন্তু মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় ছবির কাজ। এই আর্থিক ক্ষতি তিনি আর সামলে উঠতে পারেননি।
বাধ্য হয়ে ছেড়ে দেন ছবি পরিচালনা এবং প্রযোজনা। কিন্তু ততদিনে নায়ক হিসেবেও তাঁর কাজের সুযোগ কমে গিয়েছিল। ছোটখাটো ভূমিকায়, যেখানে যা অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন, আঁকড়ে ধরেছেন খড়কুটোর মতো।
পরিস্থিতির চাপে বিক্রি করে দিতে হয়েছিল জুহুতে পঁচিশটি ঘরের বাংলো। সপ্তাহে সাত দিনের জন্য নির্ধারিত ছিল সাতটি আলাদা গাড়ি। দেনার দায়ে একে একে বিক্রি করে দিয়েছিলেন সেগুলিও।
শেষ জীবনে পরিবার নিয়ে চলে গিয়েছিলেন দাদার এলাকায়। ঠাঁই হয়েছিল ঘিঞ্জি নিম্নবিত্ত এলাকায় এক চিলতে আশ্রয়ে। ২০০২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সেখানেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন ৮৯ বছর বয়সি ভগবান দাদা। তার আগে বহুবার-ই চোখের সামনে নিজের স্বপ্নের মৃত্যু দেখেতে হয়েছিল আজীবনের এই স্বপ্নসন্ধানীকে।