ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়
২০১৯-এর ভাস্বর চট্টোপাধ্যায় আর ২০২১-এর ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। ২০১৯-এর ভাস্বরকে যাঁরা খুব কাছে থেকে দেখেছেন তাঁরা জানেন, তখন আমার ভয়ানক অবস্থা। সারা দিন যদিও বা কাটত, বাড়ি ফেরার পরেই অন্ধকার ঘরে আমি একদম একা। তত দিনে আমার দ্বিতীয় সংসার ভেঙেছে। কিছু না জেনে অনেকে দায়ীও করছেন। সে সব স্মৃতি বাড়িতে পা দিলেই ছেঁকে ধরত। আমি সেই অন্ধকারে একটু একটু করে ডুবতে শুরু করেছিলাম।
সাল ২০২০। কিছুটা ধাতস্থ আমি। ১৯ জুন প্রথম আনন্দবাজার অনলাইনের হয়ে কলম ধরলাম। অনুঘটকের কাজ করেছিল অবসন্ন সুশান্ত সিংহ রাজপুতের অপমৃত্যু। বলিউডের স্বজনপোষণ নিয়ে তরজা। আমার সেই লেখা, নেটমাধ্যমে ভাগ করে নেওয়া পোস্ট পড়ে সে সময় বহু মানুষ অনুরোধ করেছিলেন অবসাদ নিয়ে মুখ খুলতে। তখন কথা রাখতে পারিনি। কারণ, তখনও আমি সম্পূর্ণ অবসাদমুক্ত নই। এখন আমি সেই সমস্যার বাইরে বেরোতে পেরেছি। তাই আবারও নেটমাধ্যমে, আনন্দবাজার অনলাইনেই কলম ধরলাম।
তারকা বা জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বই শুধু নয়, আমি-আপনি সবাই অবসাদে ভুগতে পারি। অতিমারি, মৃত্যুমিছিল, অর্থকষ্ট, জীবনযন্ত্রণা, কাজ হারানো, সামাজিক দূরত্বের ফলে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া-- মনখারাপের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু অনেকেই মনখারাপ আর অবসাদের মধ্যে গুলিয়ে ফেলেন। মনখারাপ একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত থাকে। অবসাদ মানব সত্তাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেয়। যেমন আমার হয়েছিল। বাড়িতে বাবা আর আমি। নবমিতা আর আমি যে ঘরে থাকতাম, সে ঘরে পা রাখলেই শূন্যতা ঘিরে ধরত। আমি ওই ঘরেই নিজেকে বন্দি করে ফেললাম। কাউকে মনের কথা বলার নেই। কী ভীষণ একা!
আস্তে আস্তে লোকের সঙ্গে কথা বলা, মানুষের সঙ্গে মেলামেশার ইচ্ছেটাই যেন চলে যেতে আরম্ভ করল। কাউকে দেখলেই বিরক্তি। প্রায়ই ভাবতাম, ১৪ তলা থেকে ঝাঁপ দিলে কেমন হয়? এ ভাবে ন’মাস কাটার পর একদিন মনে হল, এত সহজে হেরে যাব! এ ভাবেও জীবন শেষ করে ফেলা ঠিক নয়। তার পরেই মনোবিদের কাছে যাই। জানি, এই যাওয়াটাও সবার পক্ষে সহজ নয়। কারণ এখনও বেশির ভাগের ধারণা, মনোবিদের কাছে যেতে হয় উন্মাদদের। অনেকেই জানেন না, নামী খেলোয়াড়েরও মনোবিদের সাহায্যের প্রযোজন হয়। তাঁদের উপর তৈরি হওয়া চাপ, প্রত্যাশার পাহাড় সামলানোর জন্য। পাশাপাশি এটাও বুঝতে হবে, মনোবিদ আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দেবেন বড় জোর। পথ চলতে হবে কিন্তু আমাকে। তিনি আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। বোঝার দায়িত্ব আমার। সেই জায়গা থেকেই জন্ম নিয়েছে নতুন ‘আমি’।
সবার মতো আমারও খুব ইচ্ছে ছিল, ঘর-সংসার হবে। দু’বার চেষ্টা করেছি। দু’বার-ই ঘর ভেঙেছে। যত বার ভেঙেছে, আমি হাহাকার করেছি। আর সংবাদমাধ্যমে আমায় নিয়ে কাটাছেঁড়া চলেছে। কার দোষে বার বার ভাস্বরের নীড় নষ্ট? প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার আমি। কেউ সে দিন বোঝেননি, আমারও এগুলো নিয়ে বলতে, শুনতে কষ্ট হয়। এ সব সরিয়ে এক সময় নিজেকে নতুন করে ভালবাসতে আরম্ভ করলাম। দেখলাম, তাতে ষোলআনা লাভ। নিজেকে ভালবাসা মানে জীবনকে ভালবাসা। জীবনবিমুখ ভাস্বর আবারও জীবনমুখী হল। অভিনয় ছাড়াও সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকি। একটার পর একটা ভাষা শিখছি। ছোট ছবি পরিচালনা করলাম সদ্য। মায়ের নামে তৈরি অপর্ণা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।
জীবনে পূর্ণতা পেতে আর কী চাই? সত্যিই আমি ভাল আছি। সংসারহীন ভাস্বরেরও এখন বিরাট ঘর-সংসার...!