Aparna Sen Birthday

গাড়ি চালাতে পারি না, সাঁতারও জানি না! ছবিতে অভিনয় করব বলে রিনাদিকে মিথ্যা বললাম

শুক্রবার তোমার জন্মদিন। আমি মুম্বইয়ে ব্যস্ত। তুমি কলকাতায়। কিন্তু এক ফাঁকে কথা বলার চেষ্টা করব।

Advertisement

অঞ্জন দত্ত

মুম্বই শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:০৪
Share:

‘এই রাত তোমার আমার’ ছবিতে অপর্ণা সেন এবং অঞ্জন দত্তের লুক। — ফাইল চিত্র।

অপর্ণা সেন আমার থেকে বয়সে বড়। তাই আমি তাঁকে রিনাদি বলেই ডাকি। ওঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের পরিচিতি। অনেক সুখস্মৃতি। আমরা একে অপরের খুব ভাল বন্ধু। তাই রিনাদির জন্মদিনে অনেক কিছুই লিখতে ইচ্ছে করছে। এই মুহূর্তে আমি মুম্বইয়ে পরিচালক সুধীর মিশ্রের ওয়েব সিরিজ়ের শুটিংয়ে ব্যস্ত। কিন্তু রিনাদির জন্য একটু সময় বার করেই নেওয়া যায়।

Advertisement

সময়টা মনে পড়ছে, তখন ‘খারিজ’-এ অভিনয় করে ফেলেছি। জার্মানি থেকে সদ্য কলকাতায় ফিরেছি। অভিনয়ের চেষ্টা করছি। রাজা দাশগুপ্তের সঙ্গে রিনাদির বাড়িতে একটা চিত্রনাট্য শুনতে গিয়েছিলাম। তখনকার দিনে পরিচালকেরা অনেক চিত্রনাট্য পড়তেন এবং অনেকেই শুনতে আসতেন। তখন তিনি ‘হোয়াট দ্য সি সেইড’ নামের একটি ইংরেজি ছবির চিত্রনাট্য শোনান। নাসিরউদ্দিন শাহ এবং শাবানা আজ়মির অভিনয়ের কথা ছিল। কোনও কারণে সেই ছবিটা কিন্তু হল না। তখনও বুঝতে পারিনি, পরবর্তী সময়ে সেটাই বাংলায় যে ‘যুগান্ত’ হবে। বাজেট কম। রিনাদির পরিচালনায় আমি আর রূপা (অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়) অভিনয় করলাম।

এর আগে অবশ্য মৃণালদার (পরিচালক মৃণাল সেন) ‘এক দিন অচানক’ এবং ‘মহাপৃথিবী’ ছবিতে আমরা একসঙ্গে অভিনয় করে ফেলেছি। তারও আগে রিনাদি ইংরেজি ছবি (‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’) করেছেন। সেই সময়ে আমাদের প্রজন্মকে রিনাদি খুবই অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তথাকথিত বাংলা ছবি থেকে বেরিয়ে ভারতীয় ইংরেজি ছবির অনুপ্রেরণা কিন্তু আমার কাছে রিনাদি। কারণ পরবর্তী জীবনে আমি ‘বো ব্যারাকস্‌ ফরএভার’ বা ‘বং কানেকশন’-এর মতো ক্রস ওভার ছবি পরিচালনা করেছি।

Advertisement

‘বো ব্যারাকস্‌ ফরএভার’ ছবির বিশেষ প্রদর্শনে (বাঁ দিক থেকে) কঙ্কণা সেন শর্মা, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেন এবং অঞ্জন দত্ত। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

রিনাদি প্রথম থেকেই আমার অভিনয় পছন্দ করতেন। তাই উর্দু না জানা সত্ত্বেও আমাকে জোর করে তাঁর ‘সারি রাত’ ছবিতে কাস্ট করেছিলেন। আবার তাঁর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে বলেই, ছোট চরিত্র হওয়া সত্ত্বেও ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ ছবিতে অভিনয় করেছিলাম। উল্টো দিকে, আমার পরিচালিত বেশ কিছু ছবিও তাঁর পছন্দ হয়। এখনও আমাদের সময় মতো আড্ডা হয়। মতানৈক্য হয়। বকুনি খাই। কোনও চিত্রনাট্য থাকলে আমাকে ডেকেও পাঠান রিনাদি। সব মিলিয়ে বলতে পারি মৃণালদার পরে আমার সঙ্গে যদি কোনও পরিচালকের সখ্য গড়ে ওঠে, তা হলে তিনি রিনাদি।

কাজের বাইরে আমাদের দু’জনের একটা পার্থক্য— রিনাদি এক জন সমাজকর্মী, আমি নই। কিন্তু তাঁর এই সত্তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। তাঁর অনুরোধে কোনও উদ্যোগে আমি এক কথায় হাজিরও থেকেছি। রিনাদি চিরকাল আমাকে বলেছেন, ‘‘অঞ্জন তুই খুব ভাল অভিনেতা। কিন্তু তোকে দেখতে একদম ভাল নয়।’’ তাই আমাকে ছবিতে নেওয়ার নেপথ্যেও তাঁর ‘ইন্টারেস্টিং’ যুক্তি ছিল। বলতেন, ‘‘তুই শুধু মন দিয়ে অভিনয়টা কর। চেহারা এবং লুক আমি ঠিক করে দেব।’’ তাই ‘যুগান্ত’র সময়ে রূপার মুখে একটু বেশি মেকআপ হলেই রেগে যেতেন। কিন্তু সেখানে আমার মেকআপ করা হত একঘণ্টা ধরে। পরে ছবিতেও কিন্তু আমাকে হ্যান্ডসাম দেখাত।

রিনাদির সঙ্গে শুটিংয়ে প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়েছে। মজার কিছু ঘটনা বলি। ‘যুগান্ত’র প্রস্তাব এল। রিনাদি জানতে চাইলেন আমি গাড়ি চলাতে এবং সাঁতার জানি কি না। দুটোই জানতাম না। কিন্তু মিথ্যা বললাম। কোনও মতে একটা লাইসেন্স জোগাড় করলাম। উড়িষ্যার বারিপদায় শুটিং চলছে। গাড়ি চালাতে গিয়ে মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট হল। দাঁত ভেঙে, ঠোঁট ফুলে যাচ্ছেতাই কাণ্ড! প্রোডাকশনের গাদা খরচ হল। কিন্তু রিনাদি আমার উপর রাগ করেননি। তার পর সমুদ্রে শট দিতে গিয়ে তাঁকে জানালাম যে সাঁতার জানি না। খুব দুশ্চিন্তায় পড়লেন। শট দিতে গিয়ে পরে আমাকে জল থেকে টেনে তোলা হয়েছিল। আমাকে বকেছিলেন। কিন্তু তার পরেও রিনাদি আমার উপর রাগ করেননি। আবার ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’-এর শুটিং চলছে তো চলছেই। আমিও পালাতে পারলে বাঁচি। ফ্লোরে গিয়েই আমার মতো একটা লোক খুঁজতাম। যাতে তাঁকে আমার পরচুলাটা পরিয়ে দূরের শটগুলোয় প্রক্সি দেওয়া যায়। কিন্তু সেই চরিত্রটাই যে পরবর্তী সময়ে ছবিতে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, আমি ভাবিনি। এখনও অনেকেই আমাকে ওই চরিত্রটার কথা বলেন।

অঞ্জনের সঙ্গে পার্ক স্ট্রিটের পানশালায় ডুয়েট গাইছেন অপর্ণা। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

এই লেখায় একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই। আমার সঙ্গীত জীবনেও কিন্তু রিনাদির অবদান অনস্বীকার্য। আমি যখন গান করতে আসি, একটা ছোট্ট কনসার্টের আয়োজন করি। সেখানে বিশিষ্ট কয়েক জনের মধ্যে রিনাদিও ছিলেন। গান শেষের পর একমাত্র রিনাদিই আমাকে বলেছিলেন, ‘‘তুই গান কর। তোর গান খুব ভাল।’’ সব সময় রিনাদি আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আমার শো দেখতে এসেছেন। আবার এ রকমও ঘটেছে যে রিনাদি আমার সঙ্গে মঞ্চে গানও গেয়েছেন! সে বার রিনাদি বললেন, ‘‘অঞ্জন, অনেক দিন তোর ইংরেজি গান শুনি না!’’ পার্ক স্ট্রিটের এক পানশালায় গান করছি। এক কথায় রিনাদি চলে এলেন। অনুষ্ঠানের মাঝে আমিও তাঁকে মঞ্চে ডেকে নিলাম। তার পর দু’জনে মিলে লেনার্ড কোহেনের একটা গান ডুয়েট গেয়ে ফেললাম। ভিড়ের মধ্যে গেয়ে রিনাদি দিব্যি গাড়িতে চেপে চলে গেলেন। আমি জোর গলায় বলছি, অন্য কোনও বড় তারকার এই ক্ষমতা নেই। বা থাকলেও অন্যের জন্য মঞ্চে ওঠার এই সৌজন্য কেউ দেখাবেন না। পরে ‘সুজ়ান’ গানটা এতটাই জনপ্রিয় হল, যে মাঝেমাঝেই আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একসঙ্গে গানটা গেয়েছি।

আমাদের দু’জনের বন্ধুত্ব এতটাই ভাল যে রিনাদিকে নিয়ে ‘বসি’ নামে একটা চিত্রনাট্য লিখেছিলাম। বস্‌ এর স্ত্রীলিঙ্গ ‘বসি’— এই অর্থে। সম্পূর্ণ কমেডি, ফিল্ম উইদ‌ইন আ ফিল্ম— মুখ্য চরিত্রে রিনাদি। খুব পছন্দ করলেন। কিন্তু তার পর বাজেট এবং সময় সব মিলিয়ে ছবিটা আর তৈরিই করতে পারলাম না। এখনও আমার সেটা নিয়ে দুঃখ হয়। আরও একটা বিষয়, অনেকেই হয়তো জানেন না যে অপর্ণা সেনকে আমি খুব ভাল নকল করতে পারি। একাধিক বার তাঁর সামনেই রিনাদির মিমিক্রি করেছি। রিনাদি তো হেসে কুটোপুটি।

পরবর্তী কালে আমি আর রিনাদি যে ‘এই রাত তোমার আমার’-এর মতো একটা গোটা ছবি জুড়ে একসঙ্গে অভিনয় করব, ভাবিনি। তা-ও আমরা স্বামী-স্ত্রীর চরিত্রে! আমার কাছে বিষয়টা খুবই সহজ ছিল। কারণ তাঁর সঙ্গে এত বছর সময় কাটিয়েছি। তাই সমীকরণটা বুঝি। রিনাদির ক্ষেত্রেও তাই। পরমও (ছবিটির পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) আমাদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছে। ছবিটা আশা করি দর্শকের পছন্দ হবে।

রিনাদি এক জন তারকা। উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বা ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। সেই সময়ে বাণিজ্যিক ছবি কী ভাবে তিনি করেছিলেন আমি জানি না। তবে আমার সঙ্গে যখন থেকে আলাপ, আমি কিন্তু অত্যন্ত গুণী এবং সংবেদনশীল অভিনেতা পরিচালককেই রিনাদির মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলাম। বয়সের সঙ্গে আরও পরিণত হয়েছেন।

আমাদের প্রজন্মের অন্যতম সেরা পরিচালক রিনাদি। এমন এক জন পরিচালক, যিনি অভিনেতাদের খুব ভাল বুঝতে পারেন এবং তাঁদের থেকে সেরাটা বার করে আনতে পারেন। যেমন অর্জুন রামপালকে আমার খুব শক্তিশালী অভিনেতা মনে হয় না। কিন্তু রিনাদির ‘রেপিস্ট’ দেখার পর মনে হল, অর্জুন ছাড়া চরিত্রটা আর কেউ করতে পারত না।

এত ক্ষণ যে লিখলাম পাঠকেরা আশা করি পড়েছেন। এ বার সব শেষে রিনাদি, তোমার জন্য কয়েকটা লাইন। শুক্রবার তোমার জন্মদিন। আমি মুম্বইয়ে ব্যস্ত। তুমি কলকাতায়। কিন্তু এক ফাঁকে কথা বলার চেষ্টা করব। আমি চাই তোমার রসবোধটা নিয়েই তুমি আরও কাজ করে যাও। জীবনকে উপভোগ করো। কোন ছবি মুক্তি পাচ্ছে না, কোন ছবি তুমি করতে পারছ না বা মীরা নায়ারের মতো বাজেট হয়তো তুমি পাচ্ছ না— এই সব নিয়ে একদম ভাববে না। শুধু কাজ করে যাও। থেমে যেও না। জেনে রাখো এখনও বাংলা থেকে এই মুহূর্তে সর্বভারতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে কোনও বড় বাজেটের কনটেন্ট তৈরি হলে প্রযোজকেরা কিন্তু তোমাকেই বেছে নেবেন। নিজের সেই পরিচিতি তুমি তৈরি করতে পেরেছ। কলকাতায় ফিরে আশা করি খুব শীঘ্র আমাদের দেখা হবে। কে বলতে পারে, আবার হয়তো একসঙ্গে নতুন কোনও কাজের সলতে পাকানো শুরু করব দু’জনে।

(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement