গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
যখন প্রথম ভোট দিতে গিয়েছিলাম ইন্ডাস্ট্রিতে সদ্যই কাজ শুরু করেছি। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ রমরমিয়ে চলছে ছোট পর্দায়। তখন টালমাটাল পরিস্থিতি, নন্দীগ্রামের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চারিদিক। মোদ্দা কথা, সরকার বদলের হাওয়া। শেষ কুড়ি বছরে সব থেকে চ্যালেঞ্জিং নির্বাচন, বামফ্রন্ট সরকার পড়ে গিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় আসে। রাজনৈতিক উত্তাপ চতুর্দিকে, গণতন্ত্র বনাম ক্ষমতাশালী মানুষ। তবে আমার প্রথম ভোট দিতে গিয়ে উপলব্ধি হয়েছিল, গণতন্ত্রই শেষ কথা। ক্ষমতা জনগণের হাতে, এটা ভুলে গেলে চলবে না।
শুধুমাত্র আমার প্রথম ভোট বলেই মনে গেঁথে রয়েছে তা নয়, সেই নির্বাচনের পরে রাজ্য সরকারের বদল ঘটেছিল। আমি যে পরিবারে বড় হয়েছি সেখানে ভোট দেওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। যে যেখানেই থাকুক না কেন, ভোট দেবেই। যেমন, দিদি অধিকাংশ সময় মুম্বইয়ে থাকে। কিন্তু, ভোটের আগে ঠিক কলকাতা চলে আসবে। মা, দাদু, মামা সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে খাওয়ার টেবিলে বরাবরই রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হত। কোন দল কী কাজ করছে, কে ভাল করছে, কে মন্দ করছে, তা নিয়ে আলোচনা হত। ফলে খুব কম বয়সেই আমাদের পরিবারের ছেলেমেয়েরা রাজনীতি প্রসঙ্গে নিজেদের মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখে। তবে মা বা দাদু, কেউই নিজেদের মতামত আমাদের উপর চাপিয়ে দেননি। কিন্তু আমাদের কোনও সিদ্ধান্তে যদি কারও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকত, সে ক্ষেত্রে বড় হিসাবে তাঁরা সংশোধন করে দিতেন। কিন্তু বাড়িতে কেউ কখনও জিজ্ঞেস করেননি, কাকে ভোট দিলাম।
আমি মনে করি, রাজনৈতিক মতামত ব্যক্তিগত। তবে কেউ যদি গলা ফাটিয়ে নিজের রাজনৈতিক মতামত মানুষের আলোচনার মধ্যে আনতে চান, সে ক্ষেত্রে কোনও ভুল নেই। কিন্তু অনেকে জনসমক্ষে রাজনৈতিক মত প্রকাশ করতে চান না, তা সত্ত্বেও নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার বজায় রেখে দেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচনের জন্য ভোট দিচ্ছেন। নীরব হলেও তাঁর রাজনীতিটাও কিন্তু জোরদার। আমি নিজেও এই মতবাদে বিশ্বাসী। ঠিক এই কারণেই যত বার রাজনৈতিক দল থেকে ডাক এসেছে, বার বার ফিরিয়ে দিয়েছি। কোনও দলের প্রচারের মুখ হতে চাই না আমি।
সক্রিয় রাজনীতি করলে ক্ষমতা আসে, রাজনৈতিক পরিচিতি গড়ে ওঠে ঠিকই। কিন্তু, তার নেপথ্যে অনেক দায়িত্বও থাকে। তাঁদেরকে মানুষ নির্বাচন করছেন, কারণ মানুষের অসুবিধা, কষ্টকে নিজের করে নিয়ে তাঁদের হয়ে লড়াই করতে হবে। এটা গুরুদায়িত্ব। বাজারে সিনেমার যা সংখ্যা, তার থেকে মানুষের সমস্যার সংখ্যা অনেক বেশি। সেগুলো নিয়ে তো লড়তে হবে! আমি রাজনীতির ময়দানে যোগ দিলে রাজনীতি ছাড়া বাকি যা যা কাজ করি, সব কিছুতেই ইতি টানতে হবে। সেটা অভিনয় হোক অথবা আমার স্কুলে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানো হোক। তার মানে, আমার মূল পেশার সঙ্গে আপস করতে হবে! জনপ্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব নিলে আর অন্য কোনও কাজ করা এক কথায় অসম্ভব। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এটা মনে হয় যে, এমন কোনও দল নেই, যারা দুর্নীতি করে না। আবার ভাল কাজ করার চেষ্টা করছে না কেউ, এমনও নয়।
যাঁরা প্রকাশ্যে রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন, তাঁদের অবশ্যই সাহস আছে। খ্যাতনামী না হলে আমিও তা-ই করতাম। কেউ এই দলের সমর্থক, কেউ অন্য দলের সমর্থক। কারও এই দল ভাল লাগে, কারও অমুককে মন্দ লাগে। আমি চাই না, আমি কোন দলের সমর্থক তা বুঝে মানুষ আমার ছবি দেখতে আসুক। অন্য শিল্পীদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটতেই থাকে। আমি কিছুতেই নিজের গায়ে এই রং লাগাতে চাই না। আমার কাজকে আমি ভীষণ ভালবাসি। তাই বলে কি আমি সমাজের জন্য কিছু করি না? আমি আমার মতো করে সামাজিক কাজকর্ম করছি, ভোট দিচ্ছি। সাধারণ মানুষের মতো করে রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছি। সে কারণে নিজেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই আমার। সকলের কাছে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি জানান দিতে যে সামনে এসে চিৎকার করে রাজনৈতিক মতামত দিতেই হবে, তার কোনও মানে নেই।
প্রতি বছরই ভোটের মরসুমে খুব মর্মান্তিক লাগে। এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সমাজ হিসাবে মনে হয় আরও এক ধাপ পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা। চব্বিশের লোকসভা প্রসঙ্গে যদি বলি, রাজনীতিতে আগ্রাসন কিন্তু আগেও ছিল। এখন মুঠোফোন, সমাজমাধ্যমের দৌলতে তৎক্ষণাৎ ঘটনার আভাস পেয়ে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু, আক্রমণাত্মক রাজনীতি আগেও হত। আমার দাদু তো পায়ে গুলিও খেয়েছিলেন। দাদুর কাছেই শুনেছি, কত ধরনের সমস্যা হয়। কত বিষাক্ত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। রাজনীতির মোড়কে নানা যন্ত্রণাদায়ক ঘটনার কথা শুনেছি। এই মুহূর্তে কোন খলনায়ক কম ক্ষতিকারক, সেই নিয়ে লড়াই করতে হবে। কারণ, রাজনীতির ময়দানে আমি অন্তত কোনও নায়ক দেখতে পাচ্ছি না। যাকে দেখে আমার মনে হবে ও বিশাল কাজ করবে, মানুষের ভাল করবে ইত্যাদি। ধরে ধরে প্রার্থীদের কটাক্ষ করা হচ্ছে। কিন্তু সেই প্রার্থীদের ছাপিয়ে আরও ভাল প্রার্থী আসছে না কেন? সেই ক্ষেত্রে তো চারিদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, ঝাপসা! সক্রিয় রাজনীতি করতে গিয়ে আমি আমার জীবনের বাকি সব কিছু ছাড়তে পারব না। রাজনীতির দুনিয়ার চাইতে আমি সিনেমা উপভোগ করি। আর সেটা নিয়েই থাকতে চাই।
কিন্তু, আমাদের প্রজন্ম বা তার আগের প্রজন্মের কাছে আমি একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। আমাদের মধ্যে শিক্ষিত, মেধাবী, রাজনীতি নিয়ে প্রখর জ্ঞান রয়েছে সে রকম লোকজনের অভাব তো দেখি না। তা হলে যখন প্রার্থী বাছাই করা হচ্ছে তখন তাঁদের কথা মাথায় রাখা হচ্ছে না কেন? এমন লোকজনদের ভোটে দাঁড় করানো হয় যাঁদের দেখলে মনে হয়, কিছুই করতে পারেননি, রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দিয়েছেন! মেরুদণ্ড থাকবে না, নীতি বা আদর্শ থাকবে না, অন্যায়ের বিরোধিতা করা যাবে না, নোংরামি মেনে নিতে হবে, তবেই রাজনীতিতে টিকে থাকা যাবে! এই বিষয়টাই মাথায় ঢোকে না আমার। প্রতি বছরই বিস্মিত হই। এই বছরও আমার বিস্ময়ের শেষ নেই। আমার মনে হয়, মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত আমি বিস্মিতই থেকে যাব যে, মানুষ এটাও করল! এই ঘটনাটাও ঘটল!