গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
কেকে-র মৃত্যু দাগ কেটেছে আগামী প্রজন্মের মনেও। মঙ্গলবার আয়োজকদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন শ্রীকান্ত আচার্যের মেয়ে প্রৈতি শীল আচার্য। নেটমাধ্যমে লিখেছেন, ‘কেকে-র মৃত্যু দায়ভার মানুষেরই। পুরোটাই সাংগঠনিক গাফিলতি।’ শিল্পী-কন্যার দাবি, ছোট থেকে বাবা শ্রীকান্তকে নিয়মিত মঞ্চানুষ্ঠান করতে দেখেছেন। সেই জায়গা থেকেই তিনি অনুভব করতে পেরেছেন, বাতানুকূল যন্ত্র বন্ধ থাকায় মঙ্গলবার নজরুল মঞ্চে কতটা কষ্ট করে গান গেয়ে যেতে হয়েছে কৃষ্ণকুমার কুন্নাথকে। তার পরে ছবি তোলার ভিড়। সেই আবদার না মেটালেই শিল্পী দাম্ভিক, অহঙ্কারী! কেকে-র পরিণতি যেন প্রমাণ করল, ‘শিল্পের জন্যই শিল্পী শুধু, এ ছাড়া নেই তো তাঁর অন্য জীবন!’ ওই লেখায় প্রৈতি প্রশ্ন তুলেছেন, কেন নির্দিষ্ট আসন সংখ্যার তিন গুণ দর্শক বাতানুকূল সভাগৃহে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিলেন? কেন বাতানুকূল যন্ত্র বন্ধ ছিল? কার অনুমতি নিয়ে দর্শক সরাতে অগ্নিনির্বাপক গ্যাস ছড়ানো হয়েছিল? শ্রীকান্ত-কন্যার মতোই কি এই অভিযোগ বাকি শিল্পী সন্তানদেরও? বাবা কিংবা মা মঞ্চে থাকলে কি আতঙ্কে থাকেন বা থাকবেন তাঁরাও? জানতে আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করেছিল পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কন্যা কৌশিকী চক্রবর্তী, শিলাজিৎ মজুমদারের ছেলে ধী মজুমদার এবং মনোময় ভট্টাচার্যের ছেলে আকাশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে।
কেকে।
কৌশিকী ছোট থেকে বাবার ছায়াসঙ্গী। খুব কম বয়স থেকে তাঁর সঙ্গে মঞ্চে উঠেছেন। গানে অংশ নিয়েছেন। কাছ থেকে দেখেছেন মঞ্চানুষ্ঠানের পুরো বিষয়। এই মুহূর্তে তিনি দেশের বাইরে। ফোনে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা তাঁর, ‘‘ছোট থেকে বড় অবস্থায় আজ পর্যন্ত আমার সঙ্গে এ রকম কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেনি। আয়োজকদের কোনও রকম গাফিলতিও চোখে পড়েনি। আমার এবং বাবার ক্ষেত্রে দেখেছি, ওঁরা সব সময়ে তৎপর থেকেছেন। আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের খেয়াল সবার আগে রেখেছেন। এবং সেটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই। কারণ, ওঁরাই পুরো অনুষ্ঠানের দায়িত্বে।’’ কৌশিকী তাই আগামী দিনেও আয়োজকদের উপরেই ভরসা করবেন।
নজরুল মঞ্চে ৩ হাজার দর্শকের বদলে ৭ হাজার দর্শকের প্রবেশের দায় তা হলে কার? কেকে-র মৃত্যুতে গায়িকাও শোকস্তব্ধ। তাঁর মতে, এই ঘটনা সত্যিই বাঞ্ছনীয় নয়। পাশাপাশি তিনি এ-ও জানিয়েছেন, তিনি নিজের চোখে কিচ্ছু দেখেননি। কেন এত দর্শক সমাগম, কেন বাতানুকুল যন্ত্র বন্ধ, কেন গ্যাস ছড়ানো হয়েছিল, কেকে আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন কি না— সে বিষয়ে কিছুই জানেন না। তাই এই নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ কৌশিকী।
শিলাজিৎ মজুমদারের ছেলে ধী বাদ্যযন্ত্রী। বাবার সঙ্গে একাধিক বার মঞ্চ ভাগ করে নিয়েছেন। তিনিও খুব কাছ থেকে দেখেছেন আয়োজক আর শিল্পীর এই যুগলবন্দি। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি একটি ভয়াবহ ঘটনা ভাগ করে নিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘এক বার এক অনুষ্ঠানে মূল মঞ্চের সামনে আলাদা একটি লম্বা আয়তকার আলগা মঞ্চ ছিল। যেমন ফ্যাশন মঞ্চে থাকে। মূল মঞ্চের মতোই সাজানো, কার্পেটে মোড়া। দর্শকদের উন্মাদনায় বাবা বিভোর। গাইতে গাইতে ছুটে পৌঁছে যান ওই লম্বা অংশ। সঙ্গে বাবাকে নিয়ে ভেঙে পড়ে গোটাটা! বাবা লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসেন। সবাই ভেবেছিলেন এটাও হয়তো পারফর্মারের চমক। শুধু বাবা আর ব্যান্ডের বাকি সদস্যরা বুঝেছিলেন কত বড় দুর্ঘটনা থেকে সে দিন তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।’’
ধী-এর দাবি, সে দিনের পর থেকে তিনি চেষ্টা করেন শিলাজিতের সঙ্গে থাকতে। কোভিডের পর থেকে তাঁর সেই চেষ্টা আরও বেড়েছে। শিল্পী-পুত্রের অনুযোগ, মঞ্চ বাঁধার পরে অনেক সময়ে সেখানে পড়ে থাকে পেরেক, কাঠের টুকরো। গায়ক এবং বাদ্যযন্ত্রীদের জন্য ন্যূনতম জলের ব্যবস্থাও থাকে না। তখন গায়ক বা তাঁর আপ্ত সহায়ক প্রশ্ন তোলেন। ধী-র মতে, আয়োজকদের পাশাপাশি তাই আপ্ত সহায়ককেও শিল্পীর ভালমন্দ বুঝতে হবে। শিল্পীর অসুস্থতায় যাতে দরকারে তিনি অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে পারেন, সেই ক্ষমতাও তাঁকে দিতে হবে। একই সঙ্গে ধী চাইবেন, আগামী দিনে বাতানুকূল সভাগৃহে অনুষ্ঠান হলে দর্শকসংখ্যা যেন নির্দিষ্ট সংখ্যার থেকে এক জনও বেশি না হয়। বদলে তিনি উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠানের পক্ষপাতী। কারণ, জনজোয়ার যে কোনও শিল্পীকে ভাল পারফর্ম করতে সাহায্য করে। আর খোলা মঞ্চে মঙ্গলবারের মতো পরিস্থিতি তৈরির সুযোগ কম।
কী বলছেন মনোময় ভট্টাচার্যের ছেলে আকাশ? তিনি কি এ বার ভয় পাচ্ছেন বাবাকে অনুষ্ঠান মঞ্চে ছাড়তে? আকাশ নিজের চোখে অনুপম রায়ের অনুষ্ঠানে এমনই অব্যবস্থা দেখেছেন। জাতীয় পুরস্কারজয়ী শিল্পীর গান শুনতে বাইরে থেকে অনুরাগী শ্রোতারা ভিড় জমিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। বন্ধ গেট ভেঙে ফেলার উপক্রম। কলেজ কর্তৃপক্ষের কথা সে দিন কেউ শোনেননি! একই সঙ্গে আকাশ এ-ও জানিয়েছেন, কেকে-র ক্ষেত্রে বাইরে থেকে হাজারে হাজারে লোক গেট ভেঙে ঢুকে পড়েছিল। ফলে, বাতানুকূল যন্ত্র কাজ করেনি। দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে কেকে গাইতে বাধ্য হয়েছিলেন। যেটা একজন শিল্পী-সন্তান হিসেবে তাঁর খুবই খারাপ লেগেছে।
আকাশ উদাহরণ দিয়েছেন অরিজিৎ সিংহ বা বিদেশের অনুষ্ঠানের। তাঁর বক্তব্য, সেখানেও মঞ্চের কাছে দর্শক থাকেন। কিন্তু মাঝে একটা বড় ফাঁক থাকে। সেখানে নিরাপত্তারক্ষীরা থাকেন। ফলে, শিল্পীর কাছাকাছি কেউ পৌঁছতে পারেন না। এতে ভিড় কম হয়। হাওয়া চলাচল করে। শিল্পী আরাম করে গাইতে পারেন। পাশাপাশি, অরিজিতের একটি গান শেষ হলে সাময়িক ভাবে আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। এতে শিল্পী এবং বাদ্যযন্ত্রীরা আলোর তাপ থেকে বাঁচেন। কলকাতায় সে রকম কিছুই হয় না। তাই সবাইকে মঞ্চে দরদরিয়ে ঘামতে দেখা যায়! খুব কষ্ট হয় তখন সবার। মনোময়-পুত্রের দাবি, এগুলো যদি এখানেও মেনে চলা হয় তা হলে কেকের মতো পরিণতি হয়তো আর কোনও শিল্পীর হবে না।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।