আমি আর মৃত্যু নিতে পারি না

বেলা শেষ নয়। বেলা শুরুর এক সকালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়! সামনে আনন্দplus-এর প্রতিনিধি সংযুক্তা বসুবেলা শেষ নয়। বেলা শুরুর এক সকালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়! সামনে আনন্দplus-এর প্রতিনিধি সংযুক্তা বসু।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:১৫
Share:

Advertisement

আশি বছর বয়সে এসে এমন কোনও কাজ করতে ইচ্ছে করে যেগুলো আগে করা হয়ে ওঠেনি....

Advertisement

মূর্তি গড়ার ইচ্ছেটা আমার খুব হয়। গান গাইতে ইচ্ছে করে।

গানের গলা তো ভাল আপনার।

গলা ভাল। কিন্তু গানের জন্য তৈরি গলা তো নয়।

‘বেলাশেষে’ শব্দটার অনেক রকম মানে হয়। শব্দটা আপনার জীবনে কি কোনও দ্যোতনা নিয়ে আসে?

বেলাশেষে মানে তো জীবন ফুরিয়ে এল। আমি কিন্তু বেলাশেষে নিয়ে ভাবি না। জীবন একটা নিরবচ্ছিন্ন স্রোতের মতো। সত্যি কথা বলতে কি একদম শুরু, একদম শেষ কোনওটাই আমাদের জানা নেই। আমার নতুন ছবিতে এক দম্পতি বিয়ের পঞ্চাশ বছর পরে নিজেদের পুনরাবিষ্কার করতে চায়, সেই থেকে ছবির নাম ‘বেলাশেষে’।

আপনি একটা ইন্টারভিউয়ে বলেছিলেন আগামী জীবন বা ভবিষ্যৎটা মোটামুটি জানা হয়ে গিয়েছে। এই জেনে ফেলাটা কোনও অস্বস্তিতে ফেলে?

না, অস্বস্তিতে যে ফেলে তাও নয়। আবার পুরোটা যে উপভোগ করি তাও নয়। এখন শরীর খারাপ হয়, ওষুধ-নির্ভর জীবন—এই ব্যাপারগুলো তো আর উপভোগ করা যায় না। তবে বাই অ্যান্ড লার্জ আমি জীবনটাকে উপভোগ করি কাজের মধ্যে দিয়ে। কর্মহীন থাকলেই ডিপ্রেশন হয়। এই অবসাদের মধ্যে হতাশা থাকে, আশ্বাসহীনতা থাকে। মাসে প্রায় দুটো একটা করে মৃত্যুর খবর জমা হতে থাকে। ভাল লাগে না। এই তো ক’দিন হল আমার এক ভায়রাভাই, খুব বন্ধু ছিল আমার, চলে গেল। আমি আর মৃত্যু নিতে পারি না। মৃতের বাড়িতে যাইও না। মনের জোরে কুলায় না। জীবন-মৃত্যু সাধারণ ঘটনা বুদ্ধিগত ভাবে জানি কিন্তু মনের জোরে গ্রহণ করতে পারি না।

ক্রিকেটার মার্টিন ক্রো-র বছর দেড়েক আগে ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসাও চলছিল। কিন্তু সাড়ে তিন মাস আগে তিনি ঠিক করলেন আর চিকিৎসা নয়। জীবন যেমন ভাবে আসবে সে ভাবেই গ্রহণ করবেন। এই মার্টিন ক্রো-দের জন্য এই বয়সে এসে কষ্ট হয়?

আমি নৈর্ব্যক্তিক এই সব কষ্টের মধ্যে যেতে চাই না। যাকে চিনি না, জানি না তার জন্য কেন কষ্ট হবে? মার্টিন ক্রোয়ের ঘটনাটায় আমার এক মেসোমশাইয়ের কথা মনে পড়ল। তিনি জমিদার মানুষ ছিলেন। খুব সিগারেট খেতেন। যখন লাং ক্যানসার ধরা পড়ল তখনও সিগারেট খাওয়া ছাড়লেন না। বলেছিলেন, ‘‘যে ভাবে বেঁচেছি সে ভাবেই মরব।’’। এগুলো তো ব্যক্তিগত স্ট্যান্ড। যে যে ভাবে জীবনটাকে দেখে।

যত বয়স বাড়ে তত চারপাশের নিকট-বন্ধু কমে যায়। কষ্ট হয়?

আগে হত। এখন আর হয় না। সমস্ত বিচ্ছেদকে অনিবার্য বলে মেনে নিতে শিখেছি। সিনেমা জগতের বাইরের বন্ধুরা এখনও কেউ কেউ বেঁচে আছেন। কিন্তু সিনেমা জগতে অনেকেই নেই। অনুপকমার নেই, রবি ঘোষ নেই। এরা আমার বন্ধু ছিল। নির্মলকুমার আছে। কিন্তু কাজের মধ্যে নেই। আমার সমসাময়িকদের মধ্যে যে এখনও কাজ করে যাচ্ছে সে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। আমার খুব বন্ধু।

সাবিত্রীর সঙ্গে ‘জলনূপুর’ সিরিয়ালে অভিনয় করছেন তো। কেমন লাগছে এত দিন পরে ওঁর সঙ্গে কাজ করে?

ওর সঙ্গে কাজ করতে সব সময়ই ভাল লাগে। তবে সিরিয়াল ব্যাপারটা উপভোগ করি না। আমার মনে হয় খুব খারাপ ছবিও সিরিয়ালের থেকে ভাল হয়।

তা হলে সিরিয়ালে কাজ করছেন কেন?

বন্ধুকৃত্য করছি। সাবিত্রী আমাকে ধরেছিল ‘জলনূপুর’য়ে কাজ করার জন্য। ওকে সারা দেশের মানুষ সম্মান করে। বড় অভিনেত্রী বলে মনে করে। ওর অনুরোধে ‘না’ করতে পারিনি। আমার সব চেয়ে যেটা ভাল লাগে সাবিত্রীর স্বাস্থ্যটা এখনও ভাল আছে। এর জন্য আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই। ঈশ্বর যে মানি তা নয় তবে তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া যায়।

সত্যি ঈশ্বর মানেন না?

প্রাতিষ্ঠানিক ঈশ্বর মানি না। তবে অজানিত, অবাঙমনসগোচর কিছু থাকলেও থাকতে পারে এটা আমি মানি। তা না হলে এত বড় সৃষ্টি কোথা থেকে হল?

সাবিত্রী এমন একজন শিল্পী যাঁকে দেখে উত্তমকুমার বলতেন, ‘‘ওর চোখের দিকে তাকালে অভিনয় ভুলে যাই।’’ আজও কি ওঁর চোখে সেই টান আছে?

শুধু চোখ তো নয়, সারা শরীর দিয়ে মানুষ অভিনয় করে। সাবিত্রীর ডায়লগ ডেলিভারি এত ভাল যে কারও সঙ্গে তুলনাই হয় না।

রূপা গঙ্গোপাধ্যায় আপনার ঘনিষ্ঠ। ওঁর অভিনয়ের ধারা আপনার ভাল লাগে। কিন্তু তিনি যে বিজেপিতে যোগ দিলেন তা নিয়ে আপনার কী মত?

এ নিয়ে আমার কোনও মত নেই। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর রূপার সঙ্গে কোনও কথাবার্তাও হয়নি।

‘ঘরে বাইরে’র অনেক দিন পর ‘বেলাশেষে’তে অভিনয় করলেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের সঙ্গে। নতুন জার্নিটা ঠিক কেমন?

স্বাতীলেখার সঙ্গে এত দিন কেন কাজ করিনি সেটাই আমি ভাবি। আমাদের এখানে বয়স্কা অভিনেত্রীর যখন এত অভাব, পরিচালকেরা কেন স্বাতীলেখাকে নিয়ে কাজ করেনি সেটা আমার কাছে খুব বড় প্রশ্ন। স্বাতীলেখা সম্পর্কে যেটুকু চিন্তা ছিল যে ক্যামেরার সামনে এত দিন পরে দাঁড়াতে পারবে কিনা, শ্যুটিংয়ের দু’ একদিনের মধ্যেই সেই চিন্তাটা দূর হয়ে গেল। প্রথম দু’ এক দিন ও একটু টেনশন করেছিল কিন্তু অভিনয়ে তার ছাপ পড়েনি। তার পর থেকে খুবই ভাল অভিনয় করেছে।

ছবির পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়ের সঙ্গে কাজ করে কেমন লাগল? আপনি আগেও ওঁদের ছবি ‘অলীক সুখ’য়ে অভিনয় করেছিলেন...

শিবু আর নন্দিতার যুগলবন্দিটা খুব ভাল। আমার বেশ ভাল লেগেছে। দু’জনে পরষ্পরকে সাহায্য করে। একজনের চোখে যেটা এড়িয়ে যায় সেটা আর এক জন ডিটেক্ট করতে পারে। নন্দিতা খুব সেনসেটিভ। শিবপ্রসাদও ভাল লেখে। দু’ জনে মিলে যেটা রচনা করে বেশ ভাল হয় সেটা। আর ভাল লেগেছে প্রযোজক অতনু রায় চৌধুরীকে। উনি পেশায় আইনজীবী। কিন্তু ভাল ছবি তৈরি করার আশ্চর্য তাগিদ আছে ওঁর।

‘বেলাশেষে’তে আপনার অভিনীত চরিত্রের নাম বিশ্বনাথ। পঞ্চাশ বছরের বিবাহিত জীবন পেরিয়ে এসে সে ডিভোর্স চায়। স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্কটা ঠিক কেমন ছিল সেটা দূরে গিয়ে পুনরাবিষ্কার করবে বলে। আপনার কি মনে হয় প্রত্যেক
নারী বা পুরুষের মধ্যেই এক জন বিশ্বনাথ থাকে?

অত জেনারেলাইজ করতে চাই না। মানুষ সম্পর্কে তা হলে ভুল এস্টিমেশন হয়। বিশ্বনাথের চাওয়াটাকে একটা অন্য প্রোপোজিশন হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু নিজে কোনও দিন বিশ্বনাথের
মতো এক্সপেরিমেন্টের কথা ভাবতেও পারি না।

বিবাহিত জীবন অভ্যস্ততায় ভরে যায়। সেটা তো মানেন?

হ্যাঁ মানি। কিন্তু বিয়ে প্রতিষ্ঠানটাকে অগ্রাহ্য করতে পারি না। বিয়েতে বোরডম, অভ্যস্ততা এলে আসবে। বিয়ের ভাল দিকটা উপভোগ করব, আর বোরডম আমি নেব না— এটা কী হয়? জীবনে তেতো থাকবে না, শুধু মিষ্টি খাব এটা কখনই হয় না।

আজকের সময়টা তো খুব অস্থির। চারিদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা। আপনার কি এই সময়টার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিতে অসুবিধে হয়?

না, আমার কোনও অসুবিধে নেই। আমি কমপিউটার বুঝি না। জানি না। জানার কোনও আগ্রহও নেই। জীবনের পড়ন্ত বেলায় কী করব ও সব শিখে? আমাদের কনভেনশনাল লেখা আর পড়া, এতেই জীবন কেটে যাবে।

অমিতাভ বচ্চন কিন্তু ফেসবুক-টুইটার সব সময়ই করে যাচ্ছেন। আপনার এই ভাবে মানুষের সঙ্গে সংযোগ রাখতে ইচ্ছে করে না?

এগুলো অমিতাভর নিজস্ব ব্যাপার। আমার ফেসবুক, টুইটারের ওপর কোনও রাগ নেই। আগ্রহও নেই। কিন্তু কমপিউটার যে খুব ইউজফুল একটা জিনিস সেটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু মগ্ন হয়ে সেটা শেখার মানসিকতা আমার নেই।

এই ‘বেলাশেষে’তে এসে আপনি কতটা পূর্ণ?

আমি পাওয়া, না-পাওয়ার অত হিসেবে নিকেশ করি না। তবে এইটুকু বলতে পারি অনেকটাই পূর্ণ। আমার কাজের মূল্যায়ন হিসেবে দেশবাসীর কাছে যা পেয়েছি সেটা অনেক। আমার থেকে অনেক গুণী মানুষ আছেন যাঁরা উপযুক্ত মর্যাদা পাননি। এ দেশে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ছাড়া আরও কত মানুষ আছেন যাঁদের একশো বছর, দেড়শো বছর হচ্ছে কিন্তু তাঁদের আমরা ভুলে আছি। সুতরাং তৃতীয় বিশ্বে জন্মে নিজের পুরোপুরি মূল্যায়ন হবে এটা আশা করাও ভুল। যা হয়েছে তাই যথেষ্ট।

এই আশিতে উপনীত হয়েও আপনি যে রকম ব্যস্ত তা প্রায় তুলনাবিহীন। সহজে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায় না। এই সময়টাকে বেলাশেষে না বলে বেলাশুরু বললেই তো হয়!

বলাই যায়। জীবন প্রত্যেক দিনই নতুন করে শুরু হয়। আর আপনাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা সবাই প্রার্থনা করুন যাতে আমি এই রকম ব্যস্ততার মধ্যে দিয়েই বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পারি।

সবুজ আগন্তুক

শ্রীজাত

তোমার দু’হাতে ছায়াপথ খেলা করে।

দু’পায়ে সাজানো রুপোলি শহরতলি,

অথচ কলম তুলে নাও অবসরে...

একা থেকে গেছে, ভেতরের কোনও গলি?

কে জানে কী ভাবে এখনও সজীব রাখো,

বহু সংলাপ পার করে আসা মুখ...

লুকিয়ে রেখেছ অন্য গ্রহের সাঁকো?

এই পৃথিবীতে? সবুজ আগন্তুক?

আর কোনও চূড়া পেরোনোর নেই আজ।

ঝড়ের মুঠোয় বাঁচিয়ে রেখেছ চারা,

তবু প্রতিদিন নতুন নতুন কাজ...

মাটিতেই থেকো, সবচেয়ে উঁচু তারা!

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement