‘রানা নায়ডু’র পরে এ বার হনসল মেহতার ‘স্কুপ’ সিরিজ়ে দেখা যেতে চলেছে ঈশিতা অরুণকে। ছবি: সংগৃহীত।
প্রখ্যাত বলিউড শিল্পী ইলা অরুণের মেয়ে তিনি। গান ও অভিনয় তাঁর রক্তে। পাশাপাশি, তারকাসন্তান হওয়ার সৌজন্যে ইন্ডাস্ট্রির অন্দরেও খুব একটা অপরিচিত নন তিনি। তার পরেও শুধুমাত্র নিজের যোগ্যতা ও প্রতিভার জোরে এবং নিজের শর্তে ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান ঈশিতা অরুণ। সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছেনও তিনি— বড় পর্দা নয়, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের রাস্তা ধরে। ইতিমধ্যেই মুক্তি পেয়েছে তাঁর অভিনীত ওয়েব সিরিজ় ‘রানা নায়ডু’। এই সিরিজ়ে ঈশিতা কাজ করেছেন দক্ষিণী তারকা রানা দগ্গুবতি, দগ্গুবতি ভেঙ্কটেশের সঙ্গে। সহ-অভিনেত্রীদের মধ্যে পেয়েছেন সুরভিন চাওলা, সুচিত্রা পিল্লাইয়ের মতো পোক্ত শিল্পীদের। ‘রানা নায়ডু’র পরে এ বার বলিউড পরিচালক হনসল মেহতার ‘স্কুপ’-এ অভিনয় করেছেন ঈশিতা। আগামী ২ জুন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেতে চলেছে ‘স্কুপ’। তার আগে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে আড্ডা দিলেন ঈশিতা অরুণ।
প্রশ্ন: ‘রানা নায়ডু’র সাফল্যের জন্য অভিনন্দন। প্রথম সিরিজ়েই বেশ প্রশংসিত হয়েছেন...
ঈশিতা: ধন্যবাদ! দুর্দান্ত একটা চিত্রনাট্য ‘রানা নায়ডু’র। কাজ করে খুব ভাল লেগেছে।
প্রশ্ন: ‘রানা নায়ডু’র পরে এ বার হনসল মেহতার ‘স্কুপ’-এ কাজ করছেন। দক্ষিণী ওয়েব সিরিজ় থেকে সোজা বলিউ়়ডি প্রজেক্টে। পার্থক্য কতটা? মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়নি?
ঈশিতা: আমি আসলে সেই ভাবে আলাদা করে দেখিনি। আমার মনে হয় না, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কেউ দেখেন। যদি কাজ করতে দক্ষিণ ভারতে যেতে হয়, তা হলে আলাদা কথা। এ ক্ষেত্রে দু’টো সিরিজ়ের শুটিংয়ের বেশির ভাগটাই মুম্বইয়ে হয়েছে। ফলে ততটা পার্থক্য বুঝিনি। অবশ্যই দু’টো সিরিজ়ের বিষয় আলাদা, চিত্রনাট্যের গতি আলাদা। এইটুকুই। বরং দু’টো কাজ করতে গিয়ে আমি বেশি মিল খুঁজে পেয়েছি। দুরন্ত চিত্রনাট্য থেকে সহকর্মীদের পেশাদারিত্ব, সবটাই ভীষণ ভাল।
গতে বাঁধা কাজে তেমন উৎসাহ নেই, নিজেকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতেই বেশি ভালবাসেন ঈশিতা। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: ‘স্কুপ’-এ যে চরিত্রে আপনি অভিনয় করছেন, সেটা মুখ্য চরিত্রগুলোর মধ্যে পড়ে না। ততটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। কী ভেবে চরিত্রের জন্য হ্যাঁ বলেছিলেন?
ঈশিতা: ভীষণ বোকা হলে তবেই কেউ হনসল স্যরের (হনসল মেহতা, পরিচালক, ‘স্কুপ’) মতো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হারাবেন। এই কাজে হ্যাঁ বলার জন্য আমাকে মাথা খাটাতে হয়নি। আমি তো সিরিজ়ে ‘একস্ট্রা’ হতেও রাজি ছিলাম! তবে যে হেতু ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এটা আমার দ্বিতীয় কাজ, আমি ভাল একটা সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। তার উপর এ রকম একটা বিষয় নিয়ে কাজ। এত জমজমাট একটা চিত্রনাট্য! আমি জানতাম, এটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কোনও চরিত্র নয়। তবে, আমার জন্য এটাই বড় পাওনা যে, হনসল স্যর আমাকে ওই চরিত্রে ভেবেছিলেন এবং আমি এ রকম একটা প্রজেক্টের অংশ হতে পেরেছি।
প্রশ্ন: ‘রানা নায়ডু’, ‘স্কুপ’-এর পরে চরিত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে কী ভাবছেন?
ঈশিতা: অবশ্যই আমি এর পরে এমন চরিত্রে কাজ করতে চাই, যেখানে আমার স্ক্রিন টাইম এর থেকে বেশি। তবে, আমার মনে হয় এমন কিছু কাজ থাকে, যেটা আপনি মন থেকে করতে চান। যে কাজটা করা শিল্পী হিসাবে আপনার মানসিক চাহিদা ও সন্তুষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সে সব ক্ষেত্রে তো কিছুটা বোঝাপড়া হয়েই থাকে। তবে, ভবিষ্যতে আমি এমন চরিত্রেই অভিনয় করতে চাই, যেটা আমার নিজের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। যেখানে শিল্পী হিসাবে আমি নিজের সেরাটা বার করে আনতে পারব। গতে বাঁধা কাজে আমার খুব একটা মন নেই। কোনও নির্দিষ্ট ছাঁচে আমি পড়তে চাই না।
প্রশ্ন: অভিনয় ছাড়াও আপনি লেখেন, প্রযোজনা করেন। এত কিছু করার সময় বার করেন কী ভাবে!
ঈশিতা: এগুলোর থেকেও যেটা বড় ও আরও গুরুত্বপূর্ণ, আমি দুই মেয়ের মা! সেটা আমার ফুল টাইম জব! তার পাশাপাশি আমি লিখি, প্রযোজনা করি, অভিনয় করি। আমি এক জন ফুল টাইম পারফর্মার! এগুলো সব কটাই ঘুরিয়ে -ফিরিয়ে করতে পারি, কারণ আমি মনে করি, শিল্পের এই দিকগুলো একটা অন্যটার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। খুব যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য এগুলোর মধ্যে, তা নয়। আর দুটো কাজের মাঝের যে সময়টা, আমি সেটাকে কাজে লাগাই। আমি যখন শুট করছি, তখন শুটই করছি। তখন আমি গান লিখছি না। কিন্তু যখন শুট করছি না, তখন হয়তো আমি লিখছি। তার সঙ্গে, সময়ের উপযোগ করার একটা বিষয় তো আছেই!
মা ইলা অরুণের খ্যাতির সৌজন্যে নয়, নিজের মেধার ভিত্তিতে ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জায়গা তৈরি করতে চান ঈশিতা। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: আপনার মা ইলা অরুণ বলিউডের নামজাদা শিল্পী। তাঁর মেয়ে হিসাবে কখনও ‘স্বজনপোষণ’ জাতীয় কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছে?
ঈশিতা: পেশাগত দিক দিয়ে আমি কিন্তু আদ্যোপান্ত বলিউড ইন্ডাস্ট্রির শিল্পী নই। সেই দিক থেকে বিচার করতে গেলে আমি সিনেমা, থিয়েটার আর গান— এই তিন জগতের সঙ্গে যুক্ত। মায়ের কারণে ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে আমার কিছুটা আলাপ-পরিচয় আছে, তবে সেটা তেমন কোনও স্তরের পরিচিতি নয়। সেই দিক থেকে আমি যে তেমন লাভবান হয়েছি, তা নয়। হ্যাঁ, ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে কিছু পরিচিতি থাকলে সুযোগ পেতে সুবিধা হয়। তবে, তাতে যে সাফল্য আসবেই, এটা কিন্তু নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন না। আর যে হেতু শিল্পী হিসাবে আমার মাকে ইন্ডাস্ট্রিতে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করা হয়, তাই আমাকে কখনও কোনও খারাপ আচরণের শিকার হতে হয়নি। তবে এটাও ঠিক, এখানে কাউকেই লাল গালিচা বিছিয়ে দেওয়া হয় না। যদিও কেউ সেটাও পায়, তা হলেও তাকে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। আর সেই সাফল্যের পরিসংখ্যানটা খুবই কম। ওটাই প্রতিষ্ঠিত নিয়ম নয়।
প্রশ্ন: শিল্পী হিসাবে ইলা অরুণের যে সাফল্য, সেই উচ্চতায় পৌঁছনোর জন্য কখনও নিজের উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে?
ঈশিতা: সেটা একমাত্র গানের ক্ষেত্রে হয়েছে। আসলে সেই কারণেই আমি পেশাগত ভাবে গান গাইতে চাইনি। তা-ও সেটা অনেক ছোটবেলায়। তবে আমার মনে হয়, একটু বড় হয়ে নিজেকে নিজে চিনতে পারলে সেই চাপটা আর থাকে না। নিজের প্রতিভা ও গুণাগুণ বিচার করতে পারার মধ্যে একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস লুকিয়ে থাকে। তাই অন্য ক্ষেত্রে, আমার সে রকম কিছু মনে হয়নি। গানের জগতে এমনিই আমার চারপাশে সব কিংবদন্তি শিল্পীরা আছেন। কিন্তু আমি আমার মায়ের মতো গানের প্রতিভা রপ্ত করব কী ভাবে? মা তাঁর গোটা জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ওই উচ্চতায় পৌঁছেছেন। আমি মায়ের অনুকরণ করতে পারি, কিন্তু ইলা অরুণ তো হয়ে উঠতে পারব না! এটা আমি অনেক ছোট বয়সেই উপলব্ধি করেছিলাম।
প্রশ্ন: আপনার স্বামী ধ্রুব ঘানেকরের সঙ্গে অনেক কাজ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবন আর পেশাগত জীবন গুলিয়ে যায় না?
ঈশিতা: আমার পরিবারে আমরা সবাই খুব সহজ ভাবে নিজেদের মধ্যে নানা রকম ভাবনাচিন্তা নিয়ে কথা বলতে থাকি। আমার শ্বশুর গিরীশ ঘানেকর একজন পরিচালক। আমার স্বামী ধ্রুব অভিনেতার পাশাপাশি এক জন সঙ্গীতশিল্পীও। আমরা তো কথা বলা শুরু করলেই নতুন কোনও ভাবনাচিন্তা নিয়ে কথা বলতে থাকি। তবে, এখন আমরা অনেকটা সজাগ হয়েছি এ ক্ষেত্রে। আমরা এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাড়িতে কাজ নিয়ে বেশি কথা বলব না। তবে, এটা ভীষণই কঠিন একটা কাজ। আর যে হেতু আমি আর ধ্রুব একসঙ্গে কাজ করি, আমাদের মধ্যে মতের পার্থক্যও হয়। বাড়ি আসার আগে সেটা মিটিয়ে বাড়িতে পা দেওয়া, এটা করা বেশ কঠিন। তবে, আমাদের দুই মেয়ের জন্য এটা করা কিছুটা সহজ হয়। বাড়িতে এসে ওদের দিকে মন না দিলেই ওরা নালিশ ঠোকে!
সাফল্য পাওয়ার তাড়াহুড়োয় নিজের জীবনযাপন বিসর্জন দিতে নারাজ ঈশিতা। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: শিশুশিল্পী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। কোথাও কি মনে হয়, এত দিনে আপনার আরও অনেকটা সাফল্য অর্জন করে ফেলা উচিত ছিল?
ঈশিতা: আমি আসলে আমার নিজের সাফল্য নিয়ে খুব একটা কাটাছেঁড়া করি না। আমি যে ভাবে আমার কর্মজীবন শুরু করেছিলাম, সেটাই এত দিন ধরে টানা করে গেলে আমি আজ অন্য জায়গায় থাকতাম। তবে, আমি জীবনযাপন করাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। আমি ছোটবেলায় মডেলিং করা শুরু করি। আমার মা-বাবা চাননি আমি সেই ইঁদুরদৌড়ে শামিল হই। হরমোনাল ইঞ্জেকশন নিইনি বলে ছোটবেলায় মডেল হিসাবে অনেক সুযোগ হারিয়েছি। মা-বাবা সব সময় চেয়েছিলেন, আমি আগে নিজের লেখাপড়া শেষ করি। লেখাপড়া শেষ করার কয়েক বছর পরে আমি বিয়ে করেছি। আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিলাম যে, ২৫-এর মধ্যেই আমি বিয়ে করব! তার পরে আমি মা হই। আমি যদি এখন ভাবতে বসি যে, কী হতে পারত, তা হলে সেটা বেশ চাপের। আমার যখন যেটা করার কথা মনে হয়েছে, তখন সেটা করেছি— আমি এটা মনে করেই খুশি। এখন আমার মেয়েরা বড় হচ্ছে। এখন ওরা নিজেদের খেয়াল নিজেরাই রাখতে পারে। তাই আমি এখন নিজের কেরিয়ারের দিকে মন দিচ্ছি। আর সে দিক থেকে দেখতে গেলে, আমার মায়ের কর্মজীবনের বেশির ভাগ মাইলফলক ৪০-এর পরে। সবার নিজস্ব একটা সময় থাকে।
প্রশ্ন: এর পরের পরিকল্পনা কী?
ঈশিতা: এখন তো বেশ কিছু কাজের জন্য অডিশন দিচ্ছি। কিছু কাজের কথা হচ্ছে। সেপ্টেম্বরের পরে একটা কাজ শুরু হতে চলেছে। আমি যে যে কাজের প্রস্তাব এখন পাচ্ছি, সেগুলো নিয়ে আমি নিজেই খুব উত্তেজিত।
প্রশ্ন: অতিমারির পরে তো এখন ওটিটি প্ল্যাটফর্মের রাজত্ব! সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে কি তাতে সুবিধা বেড়েছে?
ঈশিতা: অবশ্যই! সিনেমা হলে যাওয়ার এখন সময় কোথায়! দর্শকও নতুন ধরনের কনটেন্ট, নতুন মুখ দেখতে চাইছেন। পাশাপাশি, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ছুতমার্গটাও অনেক কম। অনেক সততা নিয়ে গল্প বলা যায়।
প্রশ্ন: বড় পর্দা আর ওটিটির মধ্যে কোনটা বাছবেন?
ঈশিতা: ভাল একটা চরিত্র বাছব।
প্রশ্ন: ‘স্কুপ’-এ বাঙালি অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করেছেন। আপনার নিজেরও একটা কলকাতার যোগ রয়েছে।
ঈশিতা: (স্পষ্ট বাংলায়) আমার বাবা খুব ভাল বাংলা বলতে পারে! আমি একটু একটু বলতে পারি! আমার মা বাংলার গান গান! আমি তো ‘ওয়ানাবি বং’!
ধ্রুব আর আমি ভীষণ ভাবে বাঙালি হতে চাই! আমার বাবা, আমার শাশুড়ি স্পষ্ট বাংলায় কথা বলতে পারেন। আমার শাশুড়ির দুই ছেলের নাম ধ্রুব আর জয় (বাংলা উচ্চারণে)। ওরা মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা হয়েও বাঙালি। আমি তো উত্তরপ্রদেশের মেয়ে। বিয়ের পরে আমার হিসাবমতো মঙ্গলসূত্র পরা উচিত। আমি সেটা পরতে পারি না, কারণ আমি শুট করছি। আমি গেরুয়া সিঁদুর পরি না। মহারাষ্ট্রে বিবাহিতারা সবুজ রঙের কাচের চুড়ি পরেন, আমি পরি না। আমি নোয়া পরি! আমি আমার শাশুড়িকে বলেছিলাম আমাকে নোয়া কিনে দিতে। কলকাতারই এক বিখ্যাত দোকান থেকে আমার শাশুড়ি ওটা করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তো পারলে সব বাঙালি রীতি-রেওয়াজ পালন করি! আর আমার মায়ের অনুষ্ঠানে তো বাঙালি শ্রোতারাই সেরা!
প্রশ্ন: কত দিন আগে শেষ কলকাতা এসেছিলেন?
ঈশিতা: বেশ অনেক দিন আগে। অতিমারিরও আগে। যেতে হবে কলকাতায় খুব তাড়াতাড়ি।