পুজোয় মুক্তি পেয়েছে ‘বহুরূপী’, ‘টেক্কা’ এবং ‘শাস্ত্রী’। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
আরজি কর-কাণ্ডের জেরে অগস্ট মাস থেকেই বাংলা ছবির ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। বেশ কিছু ছবি দর্শকের প্রশংসা আদায় করে নিলেও বক্স অফিসে আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারেনি। পরিস্থিতি দেখে অনেকেই ছবিমুক্তি পিছিয়ে দেন। দর্শক পুজোর সময়ে ছবি দেখবেন কি না, তা নিয়েও মতানৈক্য ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু ইতিবাচক দিক, পুজোর আবহে মুক্তিপ্রাপ্ত তিনটি বাংলা ছবিই বক্স অফিসে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে মেতেছে। দর্শক হল ভরিয়ে ছবি দেখছেন। কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে? শোয়ের সংখ্যা কার কত? সর্বোপরি, দর্শকের পছন্দের পাল্লা কার দিকে ভারী? নবমীতে পরিস্থিতি জরিপ করল আনন্দবাজার অনলাইন।
৮ অক্টোবর পঞ্চমীতে মুক্তি পায় পুজোর তিনটি বাংলা ছবি। তালিকায় রয়েছে নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘বহুরূপী’, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘টেক্কা’ এবং পথিকৃৎ বসুর ‘শাস্ত্রী’। ইন্ডাস্ট্রিতে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, তিনটি ছবির মধ্যেই কমবেশি লড়াই চলছে। একাধিক শো হাউসফুল। সময়ের সঙ্গে বাড়ছে শোয়ের সংখ্যাও। তবে দর্শকের পছন্দ এবং টিকিট বিক্রির নিরিখে এগিয়ে রয়েছে ‘বহুরূপী’। তার পরেই রয়েছে ‘টেক্কা’। তুলনায় ‘শাস্ত্রী’ এখনও কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।
অগস্ট মাসে স্বাধীনতা দিবসে মুক্তি পায় সৃজিত পরিচালিত মৃণাল সেনের বায়োপিক ‘পদাতিক’ এবং রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত ছবি ‘বাবলি’। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদল এবং এ রাজ্যে আরজি কর আবহে দু’টি ছবির ব্যবসাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিস্থিতি থেকে সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন প্রয়োজক ও পরিচালকদের একটা বড় অংশ। কিন্তু পুজোর ছবি নিয়ে যাবতীয় আশঙ্কা দূর করে দিয়েছেন বাংলা ছবির দর্শক।
‘বহুরূপী’ ছবির একটি দৃশ্যে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।
নবমীর সকালে অনলাইন টিকিট বিক্রির একটি ওয়েবসাইটের পরিসংখ্যান বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ‘বহুরূপী’র টিকিট বিক্রি ২৩ হাজার অতিক্রম করেছে। সেখানে ‘টেক্কা’র টিকিট বিক্রি হয়েছে প্রায় ১৪ হাজারের কিছু বেশি। ‘বহুরূপী’ ও ‘শাস্ত্রী’ ছবিটির পরিবেশনার দায়িত্বে রয়েছেন বাবলু দামানি। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, ‘‘ইন্ডাস্ট্রির জন্য এটা দারুণ খবর। শুরুতে আমাদের ভয় ছিলই। আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু উৎসব ঘিরে দর্শক যে ছবি দেখছেন, তাতে আমরা খুব খুশি।’’ সপ্তমীর দিন প্রযোজনা সংস্থার তরফে ঘোষণা করা হয়, ‘বহুরূপী’র ১০০টিরও বেশি শো প্রায় হাউসফুল। সেখানে নবমীর সকালেই ৬০টি শো হাউসফুল। শুক্রবার দিনের শেষে সংখ্যাটি ১৩০ অতিক্রম করতে পারে বলে আশাবাদী তারা। অবশ্য বক্স অফিস বা ছবির শো নিয়ে এই মুহূর্তে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ ছবির অন্যতম পরিচালক ও অভিনেতা শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
শুক্রবার সকালেই ‘টেক্কা’ ছবির তিন দিনের ব্যবসার খতিয়ান দিয়েছেন ছবির প্রযোজক দেব। সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করে তিনি জানিয়েছেন, মুক্তির পর প্রথম তিন দিনে ছবিটি বক্স অফিসে ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার বেশি ব্যবসা করেছে। এ রাজ্যে ছবিটি পরিবেশনার দায়িত্বে রয়েছে পিভিআর আইনক্স। সংস্থা সূত্রে খবর, ছবিটি একশোর বেশি শো নিয়ে মুক্তি পায়। কিন্তু, বৃহস্পতিবার সপ্তমী থেকে আরও ২০-২৫টি শো বেড়েছে। ‘বহুরূপী’র তুলনায় শো কম পেলেও, দু'টি ছবিই যে যার ক্ষেত্রে দর্শকের প্রত্যাশা পূরণ করেছে বলেই দাবি করছে তারা। বরং এখনও পর্যন্ত দেব প্রযোজিত ছবির তালিকায় ‘টেক্কা’কেই তারা ‘সেরা’র শিরোপা দিতে চাইছে।
‘টেক্কা’ ছবির একটি দৃশ্যে দেব। — ফাইল চিত্র।
বাকি দুটো ছবির তুলনায় ‘শাস্ত্রী’ কম শো পেয়েছে বলে সম্প্রতি আনন্দবাজার অনলাইনে অভিযোগ করেছিলেন ছবির অন্যতম প্রযোজক সোহম চক্রবর্তী এবং পরিচালক পথিকৃৎ বসু। কিন্তু শো কম পেলেও ‘মিঠুন ম্যাজিক’ যে এখনও বাঙালিকে আকর্ষণ করে, সে কথা জোর গলায় স্বীকার করে নিচ্ছেন ছবির পরিচালক। শুক্রবার আনন্দবাজার অনলাইনকে পথিকৃৎ বললেন, ‘‘আমরা শো কম পেয়েছি, মেনে নিচ্ছি। অনেক জায়গায় প্রাইম টাইমে শো পাইনি। কিন্তু, তার পরেও আমাদের শো পর পর হাইসফুল হয়েছে।’’ পথিকৃতের মতে, ময়দানে সমান জমি পেলেই প্রতিযোগিতার প্রসঙ্গ আসে। জানালেন, শুক্রবারেই শনিবার শহরের একাধিক প্রেক্ষাগৃহে ‘শাস্ত্রী’র শো হাউসফুল হয়ে গিয়েছে। পরিচালকের কথায়, ‘‘বৃহস্পতিবারেও ছবির শো কমানো হয়েছে। আমি কোনও অভিযোগ করছি না। পরিসংখ্যান যে কেউ দেখে নিতে পারেন। মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে ছবি করতে হলে প্রযোজককে একটা নির্দিষ্ট বাজেট রাখতে হয়। কিন্তু, সেই টাকা ফেরত পেতে হলে সমান জায়গা দিতে হবে। আমাদের তো লড়াই করার জায়গাই দেওয়া হল না।’’
‘শাস্ত্রী’ ছবির একটি দৃশ্যে মিঠুন চক্রবর্তী। — ফাইল চিত্র।
বারুইপুর শো হাউসে তিনটি বাংলা ছবিই জায়গা পেয়েছে। কিন্তু কর্ণধার শান্তনু রায়চৌধুরীর মতে, ‘বহুরূপী’ এবং ‘টেক্কা’র মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। মিঠুন অনুরাগীরা আবার ‘শাস্ত্রী’র শো ভরিয়ে দিচ্ছেন। আরজি কর প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘পুজোর ব্যবসা দেখে বলতে পারি, কালো মেঘটা একটু কেটেছে। আমি খুব খুশি। তিনটে ছবিই ভাল ব্যবসা করছে। গত কাল পর্যন্ত ‘বহুরূপী’ এবং ‘টেক্কা’র মধ্যে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই হচ্ছিল। কিন্তু নবমীতে মনে হচ্ছে, ‘বহুরূপী’ একটু এগিয়ে গিয়েছে। আগামী দিনে খেলা ঘুরে যেতে পারে।’’
উত্তর কলকাতার স্টার থিয়েটারে দুটো করে শো পেয়েছে ‘বহুরূপী’ এবং ‘টেক্কা’। ‘শাস্ত্রী’ পেয়েছে একটা শো। প্রেক্ষাগৃহের তরফে জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ, আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদের পাশাপাশি মানুষ সব কাজই করছেন। তাই উৎসবের সময়ে দর্শক পরিবারের সঙ্গে ছবিও দেখছেন। জয়দীপ বললেন, ‘‘‘বহুরূপী’ এবং ‘টেক্কা’ প্রায় সমানে সমানে চলছে। আমার হলে সকাল ১১টায় ‘টেক্কা’ হাউসফুল হচ্ছে। আবার রাত সাড়ে ৯টায় ‘বহুরূপী’র নাইট শো-ও হাউসফুল যাচ্ছে। এটা খুবই ইতিবাচক ঘটনা।’’ প্রত্যেক বছর পুজোর সময়ে একাধিক ছবি মুক্তি পায়। কিন্তু চলতি পুজোর পরিস্থিতি দেখে জয়দীপ বললেন, ‘‘আমার তো মনে হয়, পুজোর সময় দুটোর বেশি বড় ছবি রিলিজ় করাই উচিত নয়! তা হলে মারামারি না করে প্রযোজক এবং হল মালিক— প্রত্যেকেই খুশি থাকবেন।’’
প্রত্যেক বছর পুজোয় বাংলা ছবিকে জায়গা পেতে লড়তে হয় হিন্দি ছবির সঙ্গে। খুশির খবর, এ বছর হিন্দি ছবিকে শোয়ের নিরিখে পিছনে ফেলে দিয়েছে তিনটি বাংলা ছবিই। শুক্রবার মুক্তি পেয়েছে আলিয়া ভট্ট অভিনীত ছবি ‘জিগরা’ এবং রাজকুমার রাও ও তৃপ্তি ডিমরি অভিনীত ছবি ‘ভিকি বিদ্যা কা ওহ্ ওয়ালা ভিডিয়ো’। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি সূত্রে খবর, একাধিক প্রেক্ষাগৃহে ছবি দুটোর পরিবর্তে বাংলা ছবিই অগ্রাধিকার পেয়েছে। একাধিক সিঙ্গল স্ক্রিনে বাংলা ছবির উপরেই ভরসা রেখেছেন হল মালিকেরা। তুলনায় হিন্দি ছবি দু’টি মূলত মাল্টিপ্লেক্সে বেশি শো পেয়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক হল আধিকারিকের কথায়, ‘‘হিন্দি ছবিগুলোর বিক্রিও ভাল। তবে অনেক জায়গাতেই হিন্দি ছবি দুটোর শো কমিয়ে বাংলা ছবি জায়গা পাচ্ছে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে এটা খুবই আশাব্যঞ্জক।’’
পুজোর মরসুম শেষ হতে এখনও কিছু দিন। ইন্ডাস্ট্রির একটা বড় অংশ মনে করছে, নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার তুলনায় বাংলা ছবির প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত হিন্দি ছবির সঙ্গে। দর্শককে কী ভাবে হলমুখী করা সম্ভব, সে দিকে নজর দেওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে আরজি কর-কাণ্ডের পর বাংলা ছবি নিয়ে দর্শকের উৎসাহকে ইতিবাচক আঙ্গিক থেকেই দেখতে চাইছেন তাঁরা। পুজোর পর তিনটি বাংলা ছবির দৌড় কতটা দীর্ঘ হয়, সে দিকে নজর থাকবে।