এ বার আমিরি

নতুন ছবির পোস্টারে প্রায় নগ্ন আমির খান। এ বার তাঁকে নিয়েও কি ছিছিক্কার শুরু? না কি সাহসী প্রশংসা? উত্তর খুঁজছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।মেরিলিন মনরোকে তখন প্রশ্ন করা হয়েছিল নগ্ন দৃশ্যটা শ্যুট করার সময় তিনি কি কিছু পরেছিলেন? ডিড শি হ্যাভ এনিথিং অন? উত্তরে মনরো বলেছিলেন, “ইটস ট্রু আই হ্যাড নাথিং অন। আই হ্যাভ দ্য রেডিয়ো অন!”

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share:

‘পিকে’র পোস্টারে রেডিয়োয় যৌনাঙ্গ ঢেকে আমির।

মেরিলিন মনরোকে তখন প্রশ্ন করা হয়েছিল নগ্ন দৃশ্যটা শ্যুট করার সময় তিনি কি কিছু পরেছিলেন?

Advertisement

ডিড শি হ্যাভ এনিথিং অন? উত্তরে মনরো বলেছিলেন, “ইটস ট্রু আই হ্যাড নাথিং অন। আই হ্যাভ দ্য রেডিয়ো অন!”

সাল ১৯৫২। একটা ক্যালেন্ডারের শ্যুটিং করার সময় মেরিলিনের এই রেডিয়ো নিয়ে নগ্নতা আর চাঞ্চল্যকর মন্তব্য সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বে। এমনকী তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হিট সিঙ্গল গেয়েছিলেন সুইডিশ পপ-ডুয়ো রক্সেট। তার প্রচ্ছদে ছিল এক তরুণীর ছবি। যার বুক ঢাকা রেডিয়ো দিয়ে।

Advertisement

সাল ২০১৪। রিলিজ হল বলিউডে ‘পিকে’ ছবির পোস্টার। নায়ক কে? না, আমির খান। পোস্টারে একটা সুতো নেই তাঁর গায়ে। লজ্জা নিবারণের জন্য শুধু একটা ট্রানজিস্টর!

আমির বরাবরই নতুন কিছু করায় বিশ্বাসী। এবং এত দিন ধরে তাই করে এসেছেন। কিন্তু আমিরের এ রকম একটা পদক্ষেপ অনেককেই চমকে দিয়েছে। কেউ আমিরের সাহসের প্রশংসা করছেন। কেউ তাঁর তুলনা খুঁজছেন সানি লিওনের সঙ্গে। ট্যুইটারে জম্মু আর কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা তো প্রশ্নই তুললেন এই বলে: ‘এখন প্রশ্ন হল আমির খানের ‘পিকে’র পোস্টার দেখে প্রথম সমালোচনা কে করবেন: এমএনএস না শিবসেনা।’

ঠিক তার পর পরই কানপুরের এক আইনজীবী আমিরের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ এনেছেন। এই কেসের শুনানি হতে চলেছে ৭ অগস্ট। এমনকী শাহরুখও আমিরের এই পোস্টার নিয়ে টিপ্পনী কাটতে ছাড়েননি। এ দিকে ট্যুইটারে পোস্টার নিয়ে জোকস ছড়িয়েও পড়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইন্ডাস্ট্রি ব্যাপারটাকে একটা সাহসী পদক্ষেপ হিসেবেই দেখেছে।

এর আগে মূল ধারার বলিউডের তারকারা যে ছবির প্রয়োজনে নগ্ন হননি তা নয়। ‘নিউ ইয়র্ক’য়ে জন, ‘জেল’য়ে নীল নিতিন মুকেশ, ‘শাহিদ’য়ে রাজকুমার রাও, ‘সাওয়ারিয়া’তে রণবীর কপূর, ‘রং দে বসন্তী’তে কুনাল কপূর নগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করার তালিকায় নাম রয়েছে বেশ কিছু বলিউড নায়কদের। আর রয়েছে শাহরুখ খানের ১৯৯৩-এ করা ‘মায়া মেমসাব’য়ের সেই বিতর্কিত নগ্ন দৃশ্য। তবে ওই ছবিটির পর আর কোনও দিন শাহরুখকে এ রকম দৃশ্যে দেখা যায়নি। শাহরুখ-পরবর্তী মূল ধারার বলিউড ছবিতে যাঁরা নগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করেছেন, তাঁরা সেটা দিয়েই ফিল্মের প্রচারপর্ব শুরু করার সাহস দেখাননি। সে দিক থেকে দেখতে গেলে আমির নিঃসন্দেহে একটা নতুন ট্রেন্ড শুরু করেছেন বলিউডে।

প্রশ্ন একটাই। আমিরের এই পদক্ষেপে আমাদের দেশের নগ্নতা নিয়ে দ্বিচারিতা কি খানিকটা কমবে? কোনও তারকা সিনেমার প্রয়োজনে নগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করলে আবারও কি তাঁকে কাদা ছোড়ার সাহস হবে কারও? স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় অভিনীত ‘টেক ওয়ান’ ছবি যে সমাজকে দেখিয়েছে, পরিবর্তন কি সেখানেও আসবে? রক্ষণশীল দর্শকের অ্যাটিটিউড পাল্টাবে? না কি আমির বলে তাঁরা দেখেও না দেখার ভান করবেন? আমিরের জন্য এক ধরনের মাপকাঠি। আর অন্য তারকাদের জন্য বরাদ্দ থাকবে সেই তির্যক মন্তব্য?

প্রসেনজিত্‌ চট্টোপাধ্যায়ের মতে ‘পিকে’র পোস্টারে নগ্নতা নেই। “সুইমিং ট্রাঙ্ক পরেই তো ওটা করা যায়। মনে আছে ‘রাজা’ ছবির পোস্টারে দেবরাজ রায় ‘নেকেড বাম’ দেখিয়েছিল,” বলছেন তিনি। তাঁর অভিনীত বাংলা ছবি ‘ক্লার্ক’য়ের পোস্টারে প্রসেনজিতকে দেখা গিয়েছিল এক বাথটাবে। সে পোস্টার সাড়া জাগিয়েছিল কলকাতায়। কিন্তু বিতর্ক হয়নি।

‘পিকে’র পোস্টার দেখেছেন দেব। বলছেন, “আমির খানের বড় ফ্যান আমি। পোস্টারটা দেখে খুব ভাল লেগেছে। প্রত্যেক অভিনেতার নিজস্ব একটা যুক্তি থাকে কোনও দৃশ্যে অভিনয় করতে রাজি হওয়ার পেছনে। আমি নিশ্চিত যে আমিরেরও একটা যুক্তি আছে এটা করার জন্য।”

পাওলির অবশ্য দৃঢ় ধারণা যে রক্ষণশীল মানসিকতার দর্শকসংখ্যা কোনও দিনই বেশি ছিল না। “কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ কথা বলতেন। তাঁরা আগেও বলেছেন, আজও বলছেন আর পরেও বলবেন। কোনও কিছু নতুন করতে গেলে ধাক্কা আসবে। সেটা হজম করার ক্ষমতা তারকাদের থাকা দরকার। রাজকুমার হিরানি, বিধু বিনোদ চোপড়া, আমির খান এঁরা সেন্সিবল সিনেমার সঙ্গে যুক্ত। ছবির প্রয়োজনেই এই ধরনের একটা পোস্টার তৈরি করেছেন তাঁরা,” বলছেন পাওলি। যাঁরা তাঁকে এক সময় ‘ছত্রাক’য়ের সেই দৃশ্যে অভিনয় করার জন্য ক্রিটিসাইজ করেছিলেন, তাঁদের আজ কী বলবেন পাওলি? “আমার কাজ কথা বলেছে। এক ধরনের ছবিতে নিজেকে বেঁধে রাখিনি আমি। এখন বলব আমির উত্তর দিয়ে দিয়েছে। এর আগে রণবীর সিংহ একটা কন্ডোমের বিজ্ঞাপন শু্যট করেছিল। রণবীর, আমির মূল ধারার তারকা। এঁদের এই ধরনের কাজ দেখে ভাল লাগছে।”

তবে অস্বীকার করছেন না যেহেতু বলিউডের অন্যতম শক্তিপুঞ্জ হলেন আমির, তাঁর মতো সুপারস্টারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোটা সহজ নয়। এমন ফোটোশ্যুট করেছেন বলে আমিরের চরিত্রহনন করার আগে অনেকেই দু’বার ভেবে নেবেন। ‘পিকে’ না দেখেও অনেকেই সহজেই এই যুক্তি দেবেন যে ছবির প্রয়োজনে এমন পোস্টারের নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমির, রাজু, বিধু এই নামগুলোর বদলে যদি অন্য নাম থাকে, তখন? ছবি না দেখে তখন নায়ক-নায়িকার বিরুদ্ধে সব গেল-গেল বলে আবার ছুটে যেতে তাঁদের কি খুব একটা আটকাবে?

অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা বসু ‘গঙ্গৌর’ ছবিতে নগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন। বলছেন, “আমিরের পোস্টারটা দারুণ। তবে এর পরেও কিছুই পাল্টাবে না। হয়তো কিছু সময়ের জন্য বেশি সংখ্যক দর্শকের মধ্যে এই পোস্টারের একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে। তার কারণ ছবির ব্যানার আর পাবলিসিটি। কিন্তু বেশির ভাগ দর্শকের এখনও অনেক সময় লাগবে পাল্টাতে।”

‘শাহিদ’য়ের পরিচালক হনসল মেহতার বলছেন ইনোভেটিভ উপায়ে আমিরের ছবিটাকে প্রোমোট করতে এই পোস্টার সফল হয়েছে। ইতিমধ্যেই ‘পিকে’ সম্পর্কে দর্শকের মধ্যে কৌতূহল তৈরি করেও ফেলেছে এই পোস্টার। হনসলের মতে, “আমির বরাবরই নতুন নতুন জিনিস করে এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশে ক’জন মেনস্ট্রিম ছবির নায়ক ওকে দেখে এ রকম রিস্ক নিয়ে কাজ করেছে? তবে এ সবের সঙ্গে এটাও বলব যে এ দেশে পাবলিসিটি নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি হয়। ইনটলারেন্ট একটা সমাজে আমরা বাস করি। মেয়েরা এখানে ভরদুপুরে ধর্ষিত হবে। আবার সেই সমাজই পোস্টারে কোনও নায়িকার নগ্ন দৃশ্য দেখে রে-রে করে ছুটে আসবে।”

দেব নানা ধরনের চরিত্র নিয়ে পরীক্ষা করছেন ইদানীং। ‘চাঁদের পাহাড়’ থেকে ‘বুনোহাঁস’ করার পর তাঁকে যদি এ রকম একটা দৃশ্যে অভিনয় করতে বলা হয়? “আমি আমিরের পোস্টারটার প্রশংসা করি। তবে ওই রকম শ্যুট করার জন্য যে কমফর্ট লেভেলটা দরকার, তা আমার নেই। আমি ওটা করতে পারব না,” বলছেন দেব।

‘পিকে’র পোস্টারটা অঙ্কুশের দারুণ লেগেছে। নিজের কোনও ছবিতে ও রকম পোস্টারের শ্যুট করতে অসুবিধে নেই তাঁর। বলছেন, “ফ্যানেরা এ সবে অসন্তুষ্ট হয় না, যখন তুমি কেন এটা করছ, সেটা নিজের কাজ দিয়ে বোঝাতে পারো। ন্যুড সিন যদি ছ্যাবলামোর জন্য করতে হয়, তা হলে ভাবব। কোনও ইমোশনাল দৃশ্য বা সোশ্যাল মেসেজ থাকলে আমি করতে রাজি।”

যে নায়ক এক সময় পর্দায় চুমু খেতে চাইতেন না, তিনি কিনা আজ বলছেন ন্যুড দৃশ্য করতেও আপত্তি নেই? এটাই কি তা হলে আমির এফেক্ট? উত্তরে মুচকি হেসে অঙ্কুশ বলছেন, “সোলো ন্যুড দৃশ্যে আপত্তি নেই। কিন্তু চুমু খাওয়া নিয়ে আছে। তা ছাড়া ন্যুডিটি মানে তো এই নয় যে সর্বস্ব খুলে দেখাব। ব্যাপারটা হল এমন ভাবে শ্যুট করা যাতে পোর্ট্রেয়ালটা ঠিকমতো হয়। পোস্টারে রেডিয়োর ফাঁক দিয়ে আমিরের নীল অন্তর্বাস দেখা যাচ্ছে।”

তবে ১৯৫২-য় মেরিলিন ক্যালেন্ডার শ্যুটে কিছুই পরেননি। ভারতে প্রতিমা বেদী সম্পূর্ণ নগ্ন হয়েই এক ক্যালেন্ডার শু্যট করেছিলেন। কিন্তু প্রতিমা কোনও দিনই বলিউডের তারকা হতে চাননি। আমিরের পোস্টার এখন একটা লিটমাস টেস্ট। এখন দেখার বিষয় একটাই। সেন্সর বোর্ডের ঝক্কি, ছিছিক্কারের বন্যা আর আইনি ঝামেলার আক্রমণ সামলে বলিউডে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারছেন কি না আমির।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement