নাগরিক ছবিয়াল

তিনি নাছোড়। পুরনো সোনালি দিন ফিরিয়ে আনবেনই আর এক মাস বাদে। পয়লা বৈশাখে। তিনি? গৌতম ঘোষ। লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়তিনি নাছোড়। পুরনো সোনালি দিন ফিরিয়ে আনবেনই আর এক মাস বাদে। পয়লা বৈশাখে। তিনি? গৌতম ঘোষ। লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৬ ০০:১৯
Share:

‘শঙ্খচিল’

শিরোনামটি পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের।

Advertisement

হঠাৎ গৌতম ঘোষকে নিয়ে লেখায় এমন শিরোনাম?

কৌশিক বলেন, কবীর যদি নাগরিক কবিয়াল হন, তিনি যেন নাগরিক ছবিয়াল। দুই বাংলায় তাঁর নাড়া বাঁধা। লালন তাঁর সেতু। যেমনটা আছে কবীরেরও।

Advertisement

আমি নাগরিক কবিয়াল

করি গানের ধর্ম পালন

সকলে ভাবছে লিখছে সুমন

আসলে লিখছে লালন।

গৌতম ঘোষ। তিনি লালনেও আছেন। আছেন লেননেও।

মনেপ্রাণে আকিরা কুরোসওয়ার ভক্ত। ততটাই মনে ধরেন সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল।

‘‘ওঁর ছবি দেখে দেখে মনে হয় সিনেমা তাঁর কাছে নিছক বিনোদন নয়। একটা বড় মুভমেন্ট। একটা প্যাশন!’’ অনুভব পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের।

সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের মনে হয়, ‘‘অভিনয় করতে গিয়ে এতটা গ্রাউন্ডওয়ার্ক করতে খুব কম জনকেই দেখেছি। এখানে গৌতমদা অনেকের থেকেই আলাদা।’’

তাঁর ছবি মানেই ভরপুর রাজনীতি। গরিবি, ক্ষুধা, ছিন্নমূল মানুষের গল্প, নয়তো ফেলে আসা সময়ের দমচাপা কান্না। প্রান্তিক জনের জলছবি। হারানো সুখ, হারানো মনের আয়না। ‘মাভূমি’ দিয়ে শুরু, ‘দখল’, ‘পার’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ থেকে ‘মনের মানুষ’, ‘শূন্য অঙ্ক’।

হালে বক্স পাননি। তো কী? হার মানেননি। মনে মনে বলেছেন ট্র্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসার পর চার্লিও কি ভেবেছিলেন ‘মঁশিয়ে ভের্দু’ মুখ থুবড়ে পড়বে!

তা’হলে চেনা তকমা থেকে কি কোনও দিনই বেরোতে চান না?

‘‘না ঠিক তকমা নয়। নিজের তো একটা জগৎ থাকে প্রত্যেকটা মানুষের।’’

অন্যদের তুলনায় ছবিও তেমন করেন কই!

‘‘এই তো ‘শঙ্খচিল’ করলাম। আমি একটা ছবি করে দুম করে আরেকটা করতে পারি না। এ দিক থেকে সৃজিত-কৌশিক-শিবপ্রসাদরা সত্যিই প্রলিফিক। অনেক সময় আমার অনুপ্রেরণার দরকার হয়।’’

যেমন?

‘‘‘অন্তর্জলি যাত্রা’ করলাম। কমার্শিয়ালি ভাল চলল। তার পর আমায় পেয়ে বসল বিসমিল্লা খানে। মোহরদিকে (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) নিয়ে একটা ছবি করলাম। আমার তো একটা অ্যাকাডেমিক ইন্টারেস্ট আছে। ‘শূন্য অঙ্ক’-র পরে আমি যেমন কেজি সু্ব্রমন্নিয়মকে নিয়ে একটা ছবি করলাম। তিনি আবার চিত্রকর। এক সময় কলকাতাকে নিয়ে তথ্যচিত্র করার কথা ভেবেছিলাম। প্রচুর শ্যুটও করেছি। ধসে পড়া বেআইনি বাড়িতে ঢুকেও ক্যামেরা ধরেছি। কলকাতা আমার কাছে একটা চরিত্র। তার রাস্তাঘাট। হা-ঘরে, হা-ভাতে মানুষ। পুরনো পুরনো পাড়াগুলো। তার রোয়াক। সবটা মিলিয়ে।’’

আর কোনও তথ্যচিত্র ভাবছেন? ধরুন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বা কবীর সুমন?

‘‘দুটোই করার মতো। সৌমিত্রদা এই বয়সেও কত রকম কাজ করছেন। নমস্য। আর কবীর তো আমার বন্ধু মানুষ। বাংলা গানে ও কাল্ট ফিগার।’’

তবে এই মধ্য ষাটে পা রেখে ইদানীং ভাবছেন, এখন আপাতত তথ্যচিত্র নয়, বরং ছবির সংখ্যা কিছুটা হলেও বাড়াবেন।

‘শঙ্খচিল’-এর মুক্তির পরই হাত দিতে চলেছেন একটি ত্রিভাষিক ছবিতে। ‘লালা’।

হিন্দি-ইংরেজি-ইতালীয় ভাষায়। সের্জো স্ক্যাপাগনিনি নামের এক ইতালীয়র গল্প। প্রেক্ষাপট মধ্যপ্রদেশ-মুম্বই আর খানিকটা ইতালির। আর মাঝে মাঝেই ফেলুদাকে নিয়েও অদ্ভুত একটা চিন্তা তাঁকে ঘাই মারে।

‘‘কথাটা আমি বাবুকেও (সন্দীপ রায়) বলেছিলাম। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়কে রেখেই ফেলুদা করতে চাই। ফেলুদা যদি ফিরে আসে, কেমন হয়? ফেলুদা রিটায়ার করেছে। প্রচুর মোৎজার্ট শোনে। গান শোনে। বইপত্র পড়ে। একেবারে রিটায়ার্ড।

আর তোপসে আজকের সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতোই। শেয়ার বাজারে ইন্টারেস্টেড। তোপসে একটা কেস নিয়ে ফেলুদার কাছে আসে। কেসটা শুনে ফেলুদা উত্তেজিত। এই বয়সেও কিছু একটা করার ইচ্ছেটা পেয়ে বসে।’’

তবে তো নতুন করে গল্প লিখতে হয়!

‘‘তাও হতে পারে। কিংবা সত্যজিৎ রায়ের কোনও গল্প থেকেও অ্যাডাপ্ট করা যেতে পারে। আরেকটা মজা রাখব। সিদ্ধার্থর ছেলেকেও নেব। ওর চেহারাটা একেবারে ছোটবেলার পুরনো তোপসের মতো। ও বলে, তোমাদের সঙ্গে আমিও যাব। এই তিনজনকে কম্বাইন করে যদি আমাকে সন্দীপ রায় অনুমতি দেয়, করতে পারি। জটায়ুকে শুধু স্মৃতিতে ফেরাতে হবে। যেটা আমি করেছিলাম, রবিদাকে (ঘোষ) ‘আবার অরণ্য’-র স্মৃতি-তে ফিরিয়ে এনে।’’

ভ্যানিশ

চমকে উঠেছিলেন সত্যজিৎ রায়!

কমলকুমার মজুমদারের কাহিনি নিয়ে ওঁর ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ ছবি করার কথা শুনে!

বলেছিলেন, ‘‘সাঙ্ঘাতিক দুঃসাহস তো তোমার! তবে ভাল করে বানালে একটা বোমা হবে, বুঝলে!’’

উস্তাদ বিসমিল্লা খানকে নিয়ে যখন তথ্যচিত্র তৈরি করছেন, তার ঠিক আগেই বাবরি মসজিদ-অধ্যায়।

বিসমিল্লা বলেছিলেন, ‘‘পবিত্র গঙ্গায় আমি স্নান করি। মসজিদে নামাজ পড়ি। বালাজি মন্দিরে গিয়ে সানাই বাজাই।’’

শুনে ওঁর মনে হয়, এর চেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষ আর কে হতে পারে! লালন সাঁইকে নিয়ে ছবি করার ইচ্ছেটা জন্মায় তখনই।

ছোট্টবেলায় ‘ম্যাজিক’ দেখাতেন। প্রিয় বিষয় ছিল ‘ভ্যানিশ’।

২০১৪-য় বাংলাদেশ-সীমান্তে গিয়ে কাঁটাতারের ঘেরাটোপ দেখতে দেখতে মনে হল, এই নিষেধের বেড়াজালটা যদি ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়া যায়!

গৌতম ঘোষ এমনই।

দেশভাগকে স্মৃতিতে ধরে তাঁর নতুন ছবি ‘শঙ্খচিল’-এর খসড়া তৈরি ওই সময়েই।

পরে সে-কাহিনির আরও বিস্তার দিয়েছেন এক তরুণ লেখিকা। সায়ন্তনী পূততুন্ড।

দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনায় সেই ‘শঙ্খচিল’ মুক্তি পাচ্ছে বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন, পয়লা বৈশাখে।

জল জল আর জল

তাঁর ছবি মানেই নদী-পুকুর-ঘাট যেন ‘মোটিফ’!

পরিচালক গোবিন্দ নিহালনি বলেছিলেন, ‘‘তুই নিশ্চই আগের জন্মে মাছ ছিলি। খালি তোর সাঁতার দিতে ইচ্ছে করে।’’

এ বারও সেই নদী আছে। ইছামতী। আর আছে দু’পারের মানুষ। তাদের গল্প। ও পারে দেবহাটা। এ পারে টাকি। তার সঙ্গে জুড়ে গেছে পাখি। শঙ্খচিল।

এত পাখি থাকতে হঠাৎ শঙ্খচিল?

বললেন, ‘‘বাঙালির মনে তো কবিতা ঘোরে। কবিদের খুব প্রিয় পাখি শঙ্খচিল। বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশের— ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে।’ শঙ্খচিল শিকারি পাখি। পোষ মানে না। বাধা মানে না। দুই বাংলার নদীনালা, খালবিলে, জঙ্গলে উড়ান দেয়। তাতে আমার মনে হয়েছিল সীমান্তের গল্প নিয়ে, দেশভাগ নিয়ে এই যে চলচ্চিত্র, তাতে শঙ্খচিল একটা রূপক হতে পারে।’’

গল্পের শুরু সীমান্ত অঞ্চল দেবহাটা-র এক পরিবারকে ঘিরে।

মুন্তাসির চৌধুরী বাদল। ইস্কুল মাস্টার। কবিতা লেখেন। গান জানেন।

ওঁর স্ত্রী লায়লা। ওঁদের যে মেয়ে, তাঁকে বাদল ডাকেন চম্পক ঈশ্বরী।

এই পরিবার, তাঁদের চলাচল, তাঁদের কলকাতা যাওয়া, সীমান্তের ছোট্ট ছোট্ট গাঁ, তার মানুষজন, এমনকী সীমান্ত রক্ষীদের নিয়েও কাহিনি গড়ায় ‘শঙ্খচিল’-এর।

স্মৃতিতে ভেসে বেড়ায় দেশভাগ।

‘বাদল’ করছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। লায়লা বাংলাদেশের মডেল-অভিনেত্রী কুসুম শিকদার। আর চম্পক ঈশ্বরী হয়েছে সাঁঝবাতি।

সাদা পাতা হয়ে

অমিতাভ বচ্চন আর রবি ঘোষকে নিয়ে এক বার সেরভানতেসের ‘ডন কিহোতে’ করতে চেয়েছিলেন তিনি। কথা এগিয়েও সে আর হয়ে ওঠেনি।

উত্তমকুমারকে নিয়ে সমরেশ বসুর কাহিনি ‘শ্রীমতী ক্যাফে’ করবেন, সব ঠিকঠাক। অসম্ভব উৎসাহী ছিলেন মহানায়কও। তখন হঠাৎই তাঁর চলে যাওয়া।

ছবি-জীবনে গৌতমের এমন বহু আফসোস আজও যাওয়ার নয়। তবু তাঁর ছবির কাস্টিং বরাবরই যেন সত্তর দশকের ক্যারেবিয়ান ক্রিকেট টিম! সামাল দিতে একজন ক্লাইভ লয়েড লাগে!।

উৎপল দত্ত-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে নাসিরুদ্দিন শাহ-মিঠুন-চক্রবর্তী-শত্রঘ্ন সিনহা-নানা পাটেকর...।

ও দিকে রেখা-শাবানা আজমি হয়ে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়-পাওলি দাম।

এর পরেও কিন্তু গৌতম বলেন, ‘‘আমি খুব সোজা পথে চলি। আগেভাগেই বলে নিই, তিনি যেই হন, একটা সাদা পাতা হয়ে আসতে হবে। যার ওপর আমরা চরিত্র লিখব। এ ভাবেই আমি ছবি করে এসেছি। আর এর সঙ্গে থাকে অভিনেতার নিজেকে তৈরি করা!’’

‘মনের মানুষ’ করার সময় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় যেমন। মাস কয়েক অন্য ছবি থেকে ছিলেন দূরে। একতারা, দোতারা ধরেছেন। সাঁইয়ের গান গলায় বেঁধেছেন। মাদুর পেতে মাটিতে শুয়েছেন।

আর এ বারে?

‘‘লালন করার পর চরিত্র তৈরির নেশা ধরে গেছে বুম্বার। এ বারে আমি লোকাল স্কুলের মাস্টারদের ছবি তুলে তুলে দিয়েছিলাম ওকে। সেই ছবিগুলো স্টাডি করে চশমাটা... লুকটা... ধীরে ধীরে ও যে ভাবে নিজের মধ্যে নিয়েছে, আমি খুব খুশি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ভারী ফ্রেমের চশমা। আর তার আড়ালে একজোড়া স্বপ্নালু চোখ, কখনও বা ফ্যালফ্যালে চাউনি...। নায়ক-নায়ক নয়, বরং গড়পরতা মানুষ যেমন হয়। আর অনেক কবিতা পড়তে দিয়েছিলাম।’’

সেনার চোখে জল

‘পার’ করার আগে নাসিরুদ্দিন সাঁতার জানতেন না।

সুইমিং পুলে দিনের পর দিন তালিম নিয়েছিলেন। তবু শুয়োরের পাল নিয়ে ঘন বর্যার গঙ্গা পেরোতে পেরোতে প্রায় ডুবতে বসেছিলেন। বাঁচান ডুবুরিরা।

একই রকম বিপদ হতে পারত ‘পদ্মানদীর মাঝি’র সময়। টালমাটাল পদ্মায় তলিয়ে যেতে পারত ইউনিটের লোকজন-অভিনেতা-অভিনেত্রী সমেত বড়সড় একটা দল।

‘মনের মানুষ’-এর সময়ও তো প্রায় তাই। নদীর জলে শট দিতে দিতে ভাসতে ভাসতে এত দূরে চলে গিয়েছিলেন প্রসেনজিৎ, ঠাওর করা যাচ্ছিল না প্রায়।

এ সব স্মৃতি এখনও টাটকা পরিচালকের মনে।

তেমন হাড়-কাঁপানো বিপদ এ বারেও আসতে পারত। নদীতে নয়, ডাঙাতে।

সীমান্ত পার। বন্দুক উঁচিয়ে রক্ষী। যে কোনও সময় গোলাগুলি না হলেও ‘আটক’ হওয়ার ভয়। গায়ে গায়ে বাড়ি। এ বাড়ি ভারতে, তো ও বাড়ি বাংলাদেশ।

কখনও আবার শোওয়ার ঘরটা এ পারে। হাত কয়েক দূরে গোসলঘর। সেটি আবার বাংলাদেশ।

জাত আলাদা। ধর্ম ভিন্ন। মাঝে শুধু খুঁটির বেড়া। কখনও আবার বেড়াও নেই। নদীই তফাত করে দিয়েছে দু’দেশের।

শেষমেশ?

‘‘অভিজ্ঞতা হল একেবারে অন্য। লোকজন তো মিলেমিশেই থাকে। বুঝি না, কেন যে এই ফারাকের পাঁচিল‌! ইউরোপ বা আমেরিকার মতো সিম-লেস বর্ডারও তো হতে পারত! হাজার হাজার লোক শ্যুটিং দেখতে আসত। প্রসেনজিৎ তো ওখানেও সমান জনপ্রিয়। আমাদের ক্ষমতা ছিল না ওদের রোখা।
সামাল দিত বাংলাদেশের রক্ষীরাই। ফাঁক পেলে আমাদের ইউনিটের লোকজনের সঙ্গে বসে বসে ওরা গানবাজনা করত। আড্ডা দিত। আর শেষ দিন? যখন চলে আসছি, সে বড় অদ্ভুত কাণ্ড!
জীবনে প্রথম বার সৈন্যদের চোখে জল দেখলাম।’’

গায়ক প্রসেনজিৎ

ওঁদের ছিল গানের বাড়ি। ঠাকুর্দা বলতেন, বড় গাইয়ে হতে হবে না। সরগমটা শিখলেই হবে। মন ভাল থাকবে।

ল্যান্সডাউনে মামাবাড়িতে একটা মস্ত অর্গান ছিল। বাবা পশ্চিমি, শাস্ত্রীয় দু’ধারার গানেরই ভক্ত। ধরে ধরে ‘রাগ’ চেনাতেন। সেই থেকে গান তাঁর প্রাণে লেগে আছে।

‘মনের মানুষ’ ছিল পুরোদস্তুর গানের। লালনের। এ বারে অত নয়, টুকরো টুকরো গান। মুকুন্দদাস, রজনীকান্ত, নজরুল।

থিমের মতো ফিরে ফিরে এসেছে জীবনানন্দের ‘আবার আসিব ফিরে’। বহু কাল আগে যাকে সুরে ধরেছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাদা, অনির্বাণ। গাইছেন ইরফাত আরা।

আর আছেন মনোময় ভট্টাচার্য, রূপঙ্কর। সেই সঙ্গে ঘরে গাওয়া কিছু গান রেখে দিয়েছেন অভিনেতা-অভিনেত্রীর গলাতেই। ফলে এ ছবিতে গান গাইতে শোনা যাবে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কেও।

ছবির প্রচারে ব্যবহার করছেন জন লেননের ‘ইম্যাজিন’— ‘ইম্যাজিন দেয়ার ইজ নো কান্ট্রিজ/ ইট ইজ নট হার্ড টু ডু’।

—দেশ নেই, কাঁটাতার নেই। রাষ্ট্রও নেই। তবে কি আপনিও রাষ্ট্রবিরোধী, কী বলেন!

প্রশ্ন শুনে প্রায় আকাশভাঙা হাসি পরিচালকের গলায়।

—‘‘তবে তো লেনন কবে থেকেই তাই! ...আসলে এ তো স্বপ্নের গান। স্বপ্নে আমরা যে-কোনও সীমান্ত পেরোতে পারি। যেমন পাখিরা পেরোয়।’’

এ পারের দেশদ্রোহী বিতর্ক তাঁকে ভাবায়। জেএনইউ-যাদবপুরও তাই। অসহিষ্ণু সময়টা তাঁকে চিন্তায় ফেলে। কবীর সুমনের ফেসবুক ব্লক হওয়াটা তাঁর কাছে যেমন আশঙ্কার, ওপারের ব্লগার হত্যাও তেমনই।

তা হলে দেশভাগ-এর বদলে এই তাজা সময়টা ধরলেন না কেন?

‘‘ধরব। কোনও দিন হয়তো ধরব। তেলেঙ্গানা নিয়ে ছবি করেছি। এক দিন কাশ্মীর, গোর্খাল্যান্ড, ছত্তীসগঢ়ও আমার ছবির বিষয় হতেই পারে। তবে র‌্যাডক্লিফ সাহেবের এই বাংলা বিভাজন রেখাটা কতটা অ্যাবসার্ড সেটাও বারবার বলা দরকার। সেটাও আমার কাছে একই রকম তাজা। সীমান্ত অঞ্চলগুলোয় গেলে, ছিটমহলগুলো দেখলে শিউরে উঠতে হয়। র‌্যাডক্লিফ নিজেই তো পরে তাঁর সৎ ছেলেকে চিঠিতে স্বীকার করে গিয়েছেন, আমি যেটা করে গেলাম, সে জন্য ইতিহাস আমাকে কোনও দিন ক্ষমা করবে না।’’

টলিউডে আত্মহত্যা

‘শব্দ’, ‘নির্বাসিত’-র মতো ছবি দেখলে তাঁর মনে হয় যেন নিজের ঘরানার ফিল্ম দেখছেন।

আবার, ছবির গল্পে হোমোসেক্স, লেসবি, ট্রান্সজেন্ডার ঢুকে পড়াতে আপত্তির কোনও কারণ দেখেন না।

বরং সদ্য কমল হাসান-ওম প্রকাশ মেহেরাদের সঙ্গে শ্যাম বেনেগাল কমিটিতে এসে সেন্সর নিয়ে জোরদার সওয়াল শুরু করেছেন।

তাঁর সাফ কথা, একটা দেশে দুটো আইন তো থাকতে পারে না। টেলিভিশনের জন্য কোনও সেন্সর নেই। কাউকে কিছু অনুমতি চেয়ে দেখাতে হয় না। তবে সিনেমার জন্য কেন? সেন্সরের কাঁচির কি কোনও দরকার আছে? আর এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর যুগে সেন্সরড বলে কিছু হয় কি আদৌ?

তাঁর খারাপ লাগে আরও অন্যখানে। তার পুরোটাই বাংলা ছবি, আর টালিগঞ্জকে ঘিরে।

‘‘এক দিনে দুটো-তিনটে ছবি রিলিজ! একটা বিশ্রী রকমের প্রতিযোগিতা চলছে এখানে। আত্মহত্যার মতো। একেই তো ছোট দর্শক। তার মধ্যেও যদি এই কাটাকাটি চলে! আগে এটার নিয়ন্ত্রণ ছিল। প্রযোজকদের মধ্যেও বোঝাপড়া ছিল। আমার মনে আছে ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ যখন রিলিজ করছিল, তপনদার (সিংহ) একটা ভাল ছবি রিলিজ করার সময় এসে পড়েছিল। তপনদা বলল, না, গৌতমের একটা ছবি রিলিজ করছে, আমার ছবিটা চার সপ্তাহ বাদে আনো। আর এখন? ঠিক তার উল্টো। যেমন যৌথ প্রযোজনা ছাড়া বাংলা ছবির বাজার বাড়বে না, তেমন এটাও বন্ধ হওয়া উচিত। এই আকালের দিনে নইলে বাংলা ছবির হাল আরও খারাপ হবে।’’ এও তো এক ভাগাভাগির গল্প। অসহিষ্ণুতারও। শুধু ‘ভ্যানিশ’টা করবে কে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement