গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
শতবর্ষ যথাযথ ভাবে পালন করতে গেলে একটা ‘ট্রিবিউট’ অবশ্যম্ভাবী। বিশেষত, যদি শতবর্ষটা সত্যজিৎ রায়ের মতো একজন দীর্ঘ (আক্ষরিক ও রূপক দুই অর্থেই) মানুষের হয়ে থাকে, যাঁর ছায়া ভারতীয় চলচ্চিত্রে এবং বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি বিশেষ ধারায় প্রলম্বিত। সেই হিসেবে ‘রে’ (নাকি ‘রায়’) নামক ওয়েব সিরিজটি ভারতীয় চলচ্চিত্রের সেই প্রগাঢ় পুরুষের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। সত্যজিতের চারটি গল্প অবলম্বনে চারটি মধ্যম দৈর্ঘ্যের ছবি নিয়ে তৈরি অ্যান্থোলজি সিরিজের মধ্যে যে চারটি ছবি রয়েছে, তার পরিচালক তিন জন। সৃজিত মুখোপাধ্যায়, অভিষেক চৌবে এবং ভাসান বালা। এর মধ্যে সৃজিত পরিচালনা করেছেন দু’টি।
সত্যজিতের যে গল্পগুলি এখানে চিত্রায়িত হয়েছে, সেগুলি যথাক্রমে ‘বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম’, ‘বহুরূপী’, ‘বারীন ভৌমিকের ব্যারাম’ আর ‘স্পটলাইট’। এই অ্যান্থোলজিতে তাদের নাম যথাক্রমে ‘ফরগেট মি নট’, ‘বহুরূপিয়া’, ‘হাঙ্গামা হ্যায় কিঁউ বরপা’ এবং ‘স্পটলাইট’। নাম বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভোল বদলও ঘটেছে। মূল কাহিনির কাঠামো সত্যজিতের হলেও সে সব কাহিনিকে বদলে ফেলা হয়েছে বা বলা সঙ্গত ‘যুগোপযোগী’ করে তোলার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। সত্যজিৎ তাঁর ‘বারো’ সিরিজের গল্পগুলি সম্ভবত লিখতে শুরু করেন ১৯৬০-উত্তর পর্বে। সত্যজিৎ প্রয়াত হন ১৯৯২ সালে। ফলত তাঁর পক্ষে বিশ্বায়ন বা যোগাযোগ বিপ্লব দেখে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এই চারটি কাহিনিতেই যে দুনিয়া ধরা রয়েছে, তা বিশ্বায়ন-পূর্ববর্তী একান্ত বাঙালি একটা পরিসর। কিন্তু আজকের গ্লোবাল ভারতীয়ের জন্য ওটিটি প্ল্যাটফর্মের উপযোগী ছবি বানাতে গেলে কিছু ‘মশলা’-র প্রয়োজন হয় যা সত্যজিতের মূল গল্পে ছিল না। সেই ‘মশলা’গুলি এই ছবিগুলিতে বিপুল পরিমাণে মজুত।
‘ফরগেট মি নট’ এবং ‘বহুরূপিয়া’ নির্মাণে সৃজিত যে কাজটা সর্বাগ্রে করেছেন, তা সত্যজিতের কাহিনির একান্ত স্বাক্ষর বিপত্নিক ও অবিবাহিত প্রৌঢ়ের নারীবিবর্জিত জগৎটির বিলোপসাধন। সত্যজিতের লেখনীতে বিপিনবাবু বিপত্নিক এবং ‘বহুরূপী’ গল্পে নিকুঞ্জ সাহা ছিল ব্যাচেলর। নিঃসঙ্গ প্রৌঢ়ের মধ্যবয়সের সঙ্কট সেই সব গল্পের মধ্যে ফল্গুস্রোতে খেলা করেছে। বা সে সব গল্পের অবচেতনকে নির্মাণ করেছে। সৃজিত সেই অবচেতন থেকে সরেছেন। তাঁর পরিচালিত দু’টি ছবিতেই নারী ও যৌনতা বড় ভূমিকায় অবতীর্ণ। ‘ফরগেট মি নট’-এর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন নায়ক ঈপ্সিত (আলি ফজল) অসামান্য সফল এক বাণিজ্য টাইকুন। তার সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গেই বহমান তার আত্মপ্রেম ও অন্যের প্রতি বিপুল অবজ্ঞা। পারিবারিক জীবনকেও সে মেপে চলে। অন্য সম্পর্ককেও। হঠাৎই এক পানশালায় এক আগন্তুক মহিলা তাকে বলে বসে এমন এক ঘটনার কথা, যা নাকি তার দ্বারা সংঘটিত। অথচ ঈপ্সিত তা মনে করতেই পারে না। একে একে তার ঘনিষ্ঠজন প্রত্যেকেই সেই বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে থাকলে সে বিপন্ন হতে শুরু করে এবং এক সময়ে তা এক চূড়ান্ত সঙ্কটের বিন্দুতে পৌছয়। ঈপ্সিত মানসিক ভারসাম্য হারায়। ক্রমে উন্মোচিত হয় যৌন প্রতারণা, ক্রমাগত বিশ্বাসভঙ্গ এবং বন্ধুত্বের অবমাননার একের পর এক দৃষ্টান্ত। ছবিতে এমন কিছু দৃশ্যের অবতারণা করেছেন সৃজিত, যা অতীতের বেশ কিছু মায়েস্ত্রোর কাজকে মনে পড়ায়।। স্বপ্নের মধ্যে গাড়ির ভিতরে আটকে পড়ার দৃশ্যে দর্শকের মনে পড়তে পারে ফেদেরিকো ফেলিনির ‘এইট অ্যান্ড হাফ’-এর প্রথম দৃশ্য। ছবির শেষ দৃশ্যে মানসিক ভারসাম্যহীন ঈপ্সিতকে তার সেক্রেটারি ম্যাগি (শ্বেতা বসু প্রসাদ) জানায় তার স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার পিছনে ক্রিয়াশীল এক চক্রান্তের কথা। তখন মানসিক হাসপাতালের দেওয়াল জুড়ে দেখা যায় ঈপ্সিতের লেখা তার নিজের বিষয়ে তথ্যের পর তথ্য। যা দেখে চকিতে মনে পড়তে পারে ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত হলিউড ব্লকবাস্টার ‘মেমেন্টো’ (২০০০)-র কথা।
কিন্তু কোথাও কি একটু তাড়াহুড়ো করে ফেললেন সৃজিত? সত্যজিতের কাহিনি নেহাতই একটা প্র্যাক্টিক্যাল জোকের গল্প। তাতে নায়ক বিড়ম্বিত হন। নিজের দম্ভের উচিত শিক্ষা পান। কিন্তু যেখানে নায়কের কৃতকর্ম আরও গভীরে কখনও যৌন-বিশ্বাসঘাতকতা, কখনও কর্পোরেট চাণক্য নীতি দ্বারা পরিচালিত ক্রুরতার দ্বারা নির্ধারিত, সেখানে খুব দ্রুত যেন ছবি গুটিয়ে আসে। সঙ্কট দর্শকের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়ার রাগেই যেন তা ফুরিয়ে যায়। অভিনয়ে আলি এবং শ্বেতা যথাযথ।
'হাঙ্গামা কিঁউ হ্যায় বরপা' ছবিতে মনোজ বাজপেয়ি এবং গজরাজ রাও।
সৃজিত পরিচালিত দ্বিতীয় ছবিটি ‘বহুরূপিয়া’। সত্যজিতের মূল গল্পে কাহিনির নায়ক নিকুঞ্জ এক প্রায়-প্রৌঢ় ব্যাচেলর। মেক আপ বা বলা ভাল প্রস্থেটিক মেক আপ করা তার শখ। এই গল্পটি সত্যজিতের অন্যতম প্রিয় জ্যঁর ‘আনক্যানি’ শ্রেণির। সৃজিত এখানেও যৌনতা এনেছেন। বেশ প্রকট ভাবেই এনেছেন। ‘নিকুঞ্জ’এখানে ‘ইন্দ্রাশিস’। থিয়েটারের রূপটানশিল্পী। উত্তরাধিকার সূত্রে সে তার ঠাকুমার বিপুল সম্পত্তি এবং তাঁরই তৈরি করা মেক আপ সংক্রান্ত একটি বই ‘বহুরূপিয়া’ পায়। তার প্রেম থিয়েটার নায়িকা দেবশ্রীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয় এবং সে জানতে পারে, দেবশ্রী আক্ষরিক অর্থেই রূপোপজীবিনী। প্রবল প্রতিশোধস্পৃহা তাকে ঠেলে নিয়ে যায় প্রস্থেটিক মেক আপের অবসেসনে। সে নিজেকে ঈশ্বরের সমকক্ষ ভাবতে শুরু করে। ইন্দ্রাশিস ভাবে, সে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তও ঘটাতে পারে। যা দেখে কোথাও যেন দর্শকের মাথায় ধাক্কা মারলেও মারতে পারে ‘মহাপুরুষ’ (১৯৬৫)। ক্রমশ বিবিধ ছদ্মবেশ ধরে ইন্দ্রাশিস প্রতারিত করে তার বস্কে, দেবশ্রীকে। সে সব সাফল্য তাকে বৃহত্তর চ্যালেঞ্জের দিকে নিয়ে যায়। কলকাতায় আগত এক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন পির সাহেবের কাছে সে ভেক ধরে হাজির হয়। পির বুঝতে পারেন সবই। অপ্রস্তুত হওয়ার আগেই ইন্দ্রাশিস পালায় সেখান থেকে। পরে আবার ফিরে যায় পিরের কাছে। তার রোখ— পিরকে সে হারাবেই।
এ বার সে ছদ্মবেশ নেয় এক পলাতক ধর্ষকের যাকে সারা দেশ খুঁজছে। যার ছবি রয়েছে পোস্টারে। পির তাকে তার নাম জিজ্ঞাসা করলে সে সেই ধর্ষকের নাম বলে। পর পর তিন বার বলে। পির জানান, অতঃপর তার সেই পরিচয়ই বহাল থাকবে। সমবেত জনতা তাকে চিনতে পেরে সেই ধর্ষক ভেবে তাড়া করে। ইন্দ্রাশিস মেক আপ খুলে ফেলতে চায়। কিন্তু ততক্ষণে তা আর তার মেক আপ নেই। সেটিই তার স্বরূপ হয়ে উঠেছে। জনতার তাড়া খেয়ে সে একটা সেলুনে ঢুকে ঝাঁপ বন্ধ করে। ক্ষুর চালায় আড়াআড়ি নিজের প্রস্থেটিক মেক আপ করা কপালে। নিজের ত্বকের মতো ফেটে যায় কপাল। গলগল করে বেরিয়ে আসে রক্ত। এ বার তার ক্ষুর এগিয়ে যায় তার নিজের চোখ লক্ষ্য করে। দর্শকদের কারও কারও এই দৃশ্য দেখে মনে হতে পারে সালভাদোর দালি এবং লুই বুনুয়েল পরিচালিত ‘আন শিয়েন আন্দালু’ (১৯২৯)-র বিখ্যাত চোখ বরাবর ক্ষুর চালানোর দৃশ্যের কথা। তবে এ ছবি ‘আনক্যানি’ হতে গিয়েও হয়নি। দালি-বুনুয়েলের সুররিয়্যাল ভুবনে ঢুকতে গিয়েও ঢোকেনি। আবার সত্যজিতের গল্পে ফিরে-ফিরে আসা বাতিকগ্রস্ত মধ্যবিত্ত ব্যাচেলরের আত্মিক সঙ্কটের দিকেও যায়নি। যৌনতা (তা বেশ ছমছমে, উদ্ভট ‘রোল প্লে’ সম্বলিত) ইন্দ্রাশিসকে কতটা পরিচালিত করেছে, তা-ও স্পষ্ট বোঝা যায়নি। ইন্দ্রাশিসের ভূমিকায় কেকে মেনন স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। পির সাহেবের চরিত্রে দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য আবার (ওয়েব সিরিজ ‘আঁখো দেখি’-র পর) নজর কেড়েছেন।
'ফরগেট মি নট' ছবিতে আলি ফজল।
সিরিজের চতুর্থ ছবি ‘স্পটলাইট’। সত্যজিতের মূল গল্পে বাঙালির ‘পশ্চিম প্রবাস’ ঘটিত স্মৃতিবিলাস ছিল। পরতে পরতে উইট ছিল আর শেষ বিন্দুতে পৌঁছে ছিল এক অনবদ্য মোচড়। এক সফল চিত্রতারকার দিক থেকে মানুষের নজর কী ভাবে এক বৃদ্ধ তাঁর নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন, তারই এক উইটঋদ্ধ কাহিনি ছিল সেটি। এখানে ঘটনাটি উলটো। স্পটলাইট থেকে বঞ্চিত এক ‘সফল’ নায়ক এবং স্পটলাইট কেড়ে নেওয়া এক ছদ্ম আধ্যাত্মিক মহিলার টানাপড়েন। এখানে সত্যজিৎ ‘ট্রিবিউটায়িত’ হয়েছেন প্রায়শই। নায়কের গাড়ির বন্ধ কাচে জনতার হামলে পড়া সত্যজিতের ‘নায়ক’-এ ট্রেনের জানালায় ভিড়ের বিখ্যাত দৃশ্যকে মনে পড়ায়। বিভ্রান্ত অবস্থায় নায়ক প্রত্যক্ষ করে তার মা’কে। তিনি বসে রয়েছেন এক আলোকিত তারকাচিহ্নের মাঝে। যে তারাটিকে দেখা গিয়েছিল ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে ভূতের রাজার পিছনে। নায়ক সত্যজিতের আঁকা ভূতের ছবিওয়ালা টি-শার্ট পরে। নায়কের ছায়াসঙ্গী আপ্ত সহায়কের নাম ‘রবি ঘোষ’। এখানে ‘শ্রদ্ধা’ অনেক প্রকট।
শেষ পর্যন্ত ছবি গড়ায় এক স্বপ্নবাস্তব পরিণতিতে। নায়ক তার নায়কোচিত বিভ্রম কাটিয়ে ‘শিল্পী’ হয়ে ওঠে। ভাসান বালা পরিচালিত এই ছবি সত্যজিতের মূল গল্পের ধারে কাছেও নেই। না থাকায় অসুবিধা কিছু নেই। কিন্তু কেন সেই কাহিনির প্রাণশক্তি উইটটুকু থাকবে না, তা নিয়ে সত্যজিৎ-ভক্তরা প্রশ্ন তুলতে পারেন। অন্য কোনও কাহিনি হলে এত কথা উঠত না। কিন্তু সিরিজের টাইটেল কার্ডের গ্রাফিক আর শীর্ষসঙ্গীতের কম্পোজিশন দিয়ে দর্শককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটা সত্যজিতের প্রতি ‘ট্রিবিউট’। সেখানে মূল স্রষ্টার সৃষ্টির অভিপ্রায়টাই হাওয়া হয়ে গেলে কিছু বলার থাকে না। অভিনয়ে হর্ষবর্ধন কপূর আর রাধিকা মদন চলনসই।
'বহুরূপিয়া' ছবিতে কেকে মেনন।
কিন্তু এই অ্যান্থোলজি সিরিজ দেখতে বসে যেখানে থমকে দাঁড়াতে হয়, সেটা সিরিজের তৃতীয় ছবি ‘হাঙ্গামা হ্যায় কিঁউ বরপা’। যে কারণে এই লেখাতেও প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থের পর আসছে তৃতীয়। কারণ, তৃতীয় ছবিটি কিছু অন্যরকমের দাবি রাখে। সত্যজিতের মূল গল্প ‘বারীন ভৌমিকের ব্যারাম’ থেকে এই গল্প অবশ্যই সরেছে। কিন্তু সেই সরে যাওয়াটা খুবই মুন্সিয়ানার। মূল গল্পে বারীন ভৌমিক এক সফল সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর সঙ্গে ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায় দেখা হয় পুলক চক্রবর্তী নামে এক প্রাক্তন বক্সারের। কাহিনির প্রেক্ষিত এটুকুই। এ বার সহযাত্রা ও বারীনের ক্রমাগত অস্বস্তিবৃদ্ধি। কারণ, এক সময়কার ‘ক্লেপ্টোম্যানিয়াক’ বা চৌর্যপ্রবৃত্তির রোগে ভোগা বারীন বেশ কিছু বছর আগে এমনই এক প্রথম শ্রেণির কামরায় পুলকের ব্যাগ থেকে তাঁর একটি দামি ট্রাভেল ক্লক চুরি করেছিলেন। সেটাই বারীনের শেষ চুরি।
এখানে বারীনের নাম মুসাফির আলি। তিনি একজন সফল গজল গায়ক। তাঁর সহযাত্রী প্রাক্তন কুস্তিগির আসলাম বেগ ওরফে জঙ্গা। তরুণ মুসাফির তখনও খ্যাতি পাননি। আর কুস্তির রিংয়ে দারা সিংহের হাতে জখম হয়ে আসলাম তখন ক্রীড়া সাংবাদিক। সেই যাত্রাতেই আসলাম মুসাফিরকে একটি পকেটঘড়ি দেখান। সোনালি রঙের অপূর্বদর্শন সেই ঘড়ির নাম ‘খুশওয়ক্ত’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘সুসময়’। আসলামের বিশ্বাস, সেই ঘড়ি তাঁকে সৌভাগ্য এনে দিয়েছে। ঘড়ির সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে মুসাফির ট্রেনের কামরাতেই সেটি চুরি করেন। ১০ বছর পর আবার রেলের কামরায় আসলামের সঙ্গে দেখা হতেই মুসাফির সচেতন হয়ে যান। কিন্তু আসলাম তাঁকে চিনি-চিনি করেও চিনতে পারেন না। কাহিনি এগোয়। মুসাফিরের হাতে ‘খুশওয়ক্ত’ আসার পর থেকে তাঁর সৌভাগ্যের কাহিনি গজলের সুরের মতোই এগোতে থাকে। হালকা মীড় থেকে মীড়ান্তরে দক্ষ দানাওয়ালা কণ্ঠে নেপথ্যে বাজতে থাকে আকবর ইলাহাবাদি রচিত গজল ‘হাঙ্গামা হ্যায় কিঁউ’।
দরবারি কানাড়ায় বাঁধা সেই গান বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে শ্রোতার আত্মমননকে। নিয়ে যেতে পারে সম্পূর্ণ অজানা জগতে। সেই জগৎ প্রাচ্যের ইসলামি জগৎ। সেখানে ফুটে উঠতে থাকে ইরান-ইরাক-মরক্কো-মিশর বা ভারতের দিল্লি নগরীর সরাইখানায় সমবেত মুসাফিরদের কাছে যুগ যুগ ধরে দাস্তানগো বা গল্পকথকদের বলে যাওয়া সহস্র এক আরব্য রজনীর কাহিনি। গজল থেকে বার বার ছিটকে আসতে থাকে ‘হাঙ্গামা কিঁউ হ্যায় বরপা থোড়ি সি জো পি লি হ্যায় / ডাকা তো নেহিঁ ডালা, চোরি তো নেহিঁ কি-ই হ্যায়’। ঘুরে ফিরে আসতে থাকে ‘চোরি তো নেহিঁ কি-ই হ্যায়’। ক্যামেরা স্মৃতিসরণির অলিপথ-গলিপথ ধরে এগোয়। ফুটে উঠতে থাকে মুসাফিরের জীবনে সাফল্যের একেকটা বাঁক। আর একবারে গাদ্যিক ভাবে আসলাম জানান ‘খুশওয়ক্ত’ চুরির যাওয়ার পর থেকে তাঁর দুর্ভাগ্যের কথা।
বিরাট দোটানায় পড়ে মুসাফির ট্রেনের কামরাতেই সেই ঘড়ি ফেরত দিতে গিয়ে ধরা পড়ে আসলামের কাছে। আসলাম ‘খুশওয়ক্ত’ মুসাফিরের হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, পরদিন সকালে পুরানা দিল্লির এক অখ্যাত এলাকায় এক পুরনো জিনিসের দোকানে সেটি দিয়ে আসতে। সেই দোকানের নাম ‘রুহ সাফা’ অর্থাৎ ‘আত্মার শুদ্ধিকরণ’। সেখানে পৌঁছয় মুসাফির। ফেরত দেয় ‘খুশওয়ক্ত’। আর চমকে ওঠে সে দোকানে রাখা সব জিনিস দেখে। তার মধ্যে সত্যজিতের খেরোর খাতাও আছে। এ কাহিনির ক্লাইম্যাক্সের কথা থাক। এই উর্দুভাষী, গজল-কেন্দ্রিক কাব্যময় ইসলামি জগৎ এ দেশ থেকে ক্রমেই মুছে যাচ্ছে। মুছে যাচ্ছেন গুলাম আলি, মেহদি হাসান, জগজিৎ সিংহ। হাঙ্গামা নেই। নিঃশব্দেই চুরি হয়ে গিয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের ‘খুশওয়ক্ত’। ঘড়ি এখানে রূপক। সে দর্শককে সময় থেকে সময়ান্তরে নিয়ে যায়।
'স্পটলাইট' ছবিতে হর্ষবর্ধন কপূর।
‘রে’ দেখতে বসে সদ্য প্রৌঢ় পুরুষ বা মহিলার মনে পড়ে যেতে পারে আটের দশকে দূরদর্শনে দেখা হিন্দি ধারাবাহিক ‘সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস’। সে জগৎও কখন যেন হারিয়ে গিয়েছে! কর্পোরেট আর মিথ্যা, ছদ্মবেশ আর আত্মপ্রেম এসে নিঃসাড়ে নিয়ে গিয়েছে ‘খুশওয়ক্ত’। নিজের চৌর্যপ্রবৃত্তির চিকিৎসা করাতে মুসাফির গিয়েছিল এক হেকিমের কাছে। সেই হেকিম মনের চিকিৎসাও করেন। কোথাও যেন স্মৃতির ঘণ্টার দড়িতে টান পড়ে। মনে পড়ে যায়, সুধীর কক্করের গবেষণা ‘শ্যামানস মিস্টিকস অ্যান্ড’ ডক্টর্স’-এ বর্ণিত পুরানা দিল্লির হেকিমদের কথা। ‘রুহ সাফা’ যেন উপমহাদেশের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে এক স্বপ্নের বিপণি। তা যেন মধ্যপ্রাচ্যের নিশাপুর নগরীর সুফি দার্শনিক ফরিদউদ্দিন আত্তরের রহস্যময় সুগন্ধীর দোকান। সেখানে বিক্রি হয় স্বপ্ন দেখার সৌরভ। সেই সৌরভ এই সিরিজ দেখার পরেও লেগে থাকে স্মৃতিরেখায়।
হয়তো অন্য প্রজন্মের দর্শক এই অ্যান্থোলজিকে অন্য চোখে দেখবেন। কিন্তু যে প্রজন্ম ‘এক ডজন গপ্পো’, ‘আরো এক ডজন’ পড়তে পড়তে বড় হয়েছে, যাদের কৈশোরে এসে লেগেছিল গুলাম আলি বা মেহদি হাসানের কণ্ঠে ধরে রাখা ‘হাঙ্গামা হ্যায় কিঁউ’, তাঁরা বেরিয়ে আসবেন কর্পোরেট-সর্বস্বতা ছেড়ে, বেরিয়ে আসবেন আত্মসর্বস্বতা থেকে। অভিষেক চৌবে আশা জাগালেন এই ছবিতে। আর মুসাফির মনোজ বাজপেয়ি এবং আসলাম গজরাজ রাওয়ের অভিনয়ের টকরার দেখে হয়তো সত্যজিৎ কোনও এক অলীক কফিখানায় বসে উলটে নিলেন তাঁর খেরোর খাতা। নিজেই পড়তে শুরু করলেন নিজেরই লেখা একটা গল্প ‘দুই ম্যাজিশিয়ান’। তিনি বিলক্ষণ জানেন, এই পৃথিবীতে সব কিছু ফুরোলেও গল্প কখনও ফুরোয় না।