তখন সন্ধি। বোলপুরে অনুব্রতর দফতরে কাজল শেখ। —ফাইল চিত্র।
সত্তরের দশক। মুম্বই আন্ডারওয়ার্ল্ডে কান পাতলে তখন একটাই নাম— সুলতান মির্জা ওরফে হাজি মস্তান। বলিউড-সহ গোটা মুম্বইয়ের কোণায় কোণায় এই নাম তখন সমীহ জাগাত।
হাজি খতম। মঞ্চে প্রবেশ দাউদ ইব্রাহিমের। একদা হাজির ডান হাত। হাজির হাত ধরেই আন্তর্জাতিক চোরাচালানের খুঁটিনাটি শেখা। হাজির মতোই বলিউড সেলিব্রিটিদের সঙ্গে মাখামাখি শেখা। হাজিকে ‘জো হুজুর’ করতেই করতেই তাঁকে কোণঠাসা করে মাফিয়া সাম্রাজ্য কায়েম করা। তার পর মুম্বই বিস্ফোরণ। বাকিটা ইতিহাস।
আরবসাগরের তীর থেকে সোজা অজয় নদের তল্লাট। চোখ ঝলসানো মেরিন ড্রাইভ থেকে লাল মাটি, সবুজ ধান, বালির খাদান। এবং অবশ্যই চণ্ডীদাসের ভূমি।
নাম তার নানুর।
এখানেও কোথাও একটা সুলতান-দাউদের গল্প তৈরি হচ্ছিল। অনেক ছোট পরিসরে অবশ্যই। সে প্রায় এক দশক আগের কথা। ‘সুলতান’ এখানে খতম হননি ঠিকই। কিন্তু, একদা অনুগত ‘দাউদের’ দাপটে আজ অনেকটাই কোণঠাসা। ‘সুলতান’ তাই পণ করেছেন, বেঁচে থাকতে ‘দাউদ’-কে নানুরের দখল নিতে দেবেন না। ‘দাউদ’-ও মরিয়া, বালিঘাট-সহ নানুরের সব পঞ্চায়েত নিজের কব্জায় আনতে। মুম্বই মাফিয়া জগতের মতোই এলাকা দখলের লড়াইয়ে দু’পক্ষের রেষারেষি। রক্তারক্তি, খুনোখুনি, বোমাবাজি, গুলি—কী নেই এই রোমাঞ্চকর চিত্রনাট্যে!
চণ্ডীদাসের নানুর আজ আর শান্তির নানুর নয়। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’-র নানুরে এখন ‘সত্য’ এলাকা দখলকে ঘিরে তৃণমূলের দুই নেতার অনুগামীদের মধ্যের লড়াই। ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’ বদলে গিয়েছে ‘গ্যাংস অফ নানুর’-এ!
যে গ্যাং-এর এক মাথার নাম কাজল শেখ। অন্য জন, গদাধর হাজরা। প্রথম জন, নানুরের প্রবল পরাক্রমী তৃণমূল নেতা। দ্বিতীয় জন, নানুরের বিদায়ী বিধায়ক, এ বারও তৃণমূলের প্রার্থী। এক সময়ের বন্ধুত্বে আজ শুধুই তিক্ততা-শত্রুতার বিষ!
গোটা বীরভূমে এই কাজলই একমাত্র কাঁটা তাই গদাধরের বর্তমান ‘গডফাদার’ অনুব্রত মণ্ডলের। গদাধর শিবির থেকেই জানা যাচ্ছে, কাজল নানুরের ভোটকে নিজের অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে দেখছেন। গদাধরকে না জেতানোর জন্য যা যা করার, আড়ালে থেকে সবই করছেন। এখানেও সেই ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’-এর ছায়া! যেখানে মাফিয়া সর্দার খান (কাজল) বিধায়ক রামাধীর সিংহ (গদাধর) সম্পর্কে বলছে, ‘উস হা...মি কো মিটানা হ্যায় হমে। গোলি নহি মারেঙ্গে, কহ কে লেঙ্গে উসকি’!
নানুরের সেই সর্দারের দাপট এতটাই যে, তিন কর্মী খুনের মামলা থাকার পরেও পুলিশ কাজলকে খুঁজে পায় না। বলা হয়, তিনি ফেরার। যদিও কাজলের গ্রাম পাপুড়ির বাসিন্দাদের কথায়, ‘দাদা ফেরার নন। ঘরছাড়া। গ্রামে থাকলে গদাইয়ের (গদাধর) দলের হাতে তাঁর প্রাণ সংশয় আছে।’’ তবু, ‘ঘরছাড়া’ এই কাজলের দাপটেই নানুরের একটা বড় অংশে কার্যত প্রচারই করতে পারেননি গদাধর। নিন্দুকেরা বলে, এই কাজলের ‘ভয়েই’ নাকি এখন গদাধরের সর্বক্ষণের সঙ্গী চার দেহরক্ষী। নানুরের এক বিস্তীর্ণ তল্লাটে কান পাতলেই শোনা যায়, গদাধরের হার-জিতের চাবিকাঠি রয়েছে কাজল শেখের হাতেই! স্রেফ তাঁর জন্যই গোটা জেলায় নানুর এক বিচ্ছিন্ন ভূমি হিসেবে বরাবর চিহ্নিত হয়ে এসেছে তৃণমূল শিবিরে।
অতীত কিন্তু এমন ছিল না।
বিধায়ক হওয়ার বেশ কিছু দিন আগে পর্যন্তও গাড়ি চালাতেন গদাধর। নিজের গাড়িতে করেই কাজল শেখকে নানুরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরিয়ে বেড়াতেন। তত দিনে সিপিএম এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের দাদা, কেতুগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজের সঙ্গে মিলে তৃণমূলকে অনেকটাই শক্ত ভিতের উপরে দাঁড় করিয়েছেন কাজল। মূলত এলাকার যুবকদের টেনে নিয়ে সংগঠন বাড়াতে থাকেন কাজল। সিপিএমের কায়দাতেই ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরের পর গ্রাম পঞ্চায়েতের দখল নেয় কাজল-বাহিনী। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেতেই কাজল-গোষ্ঠীর দখলে চলে আসতে থাকে বালির ঘাট, ধান-চালের আড়ত। আয়ের উৎসমুখ যত খুলতে থাকে, কাজলের দলে নাম লেখাতে ভিড়ও বাড়তে থাকে ততই।
সেই কাজলই ‘খুশি’ হয়ে গদাধরকে নানুর ব্লকের যুব সভাপতির দায়িত্ব দেন। এমনকী, ২০১১ সালে বিধানসভায় প্রার্থী করার জন্য কাজলই দলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের কাছে গদাধরের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। ‘দোস্তি’ টিকেছিল ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত। তার পরেই শুরু কুস্তি। গদাধর চলে যান জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের আশ্রয়ে। ‘শত্রুর শত্রু মিত্র’—রাজনীতির এই আপ্তবাক্য মেনে অনুব্রতও গদাধরকে তোল্লা দেওয়া শুরু করলেন। যাতে নানুরে কাজলের বিরুদ্ধে একটা মুখকে তুলে ধরা যায়। অস্বীকার করার উপায় নেই, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে গদাধর সেই কাজে অনেকটা সফলও হয়েছেন। নানুরের (বিশেষ করে বোলপুর লাগোয়া অঞ্চলে) এক বড় অংশে কাজলকে কোণঠাসা করেছে গদাধর-শিবির।
নানুর ব্লকের ১৩টি এবং বোলপুর ব্লকের ৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে নানুর বিধানসভা আসন। এলাকা সূত্রের খবর, প্রভাব কিছুটা কমলেও এখনও ১৩টি পঞ্চায়েতে কাজল-গোষ্ঠীর দাপট। নানুর পঞ্চায়েত সমিতিতেও কাজলের কথাই চলে।
তৃণমূলের কর্মীরাই জানাচ্ছেন, তোলা আদায়, পঞ্চায়েত সমিতিতে টাকা আদায় কিংবা অজয়ের বালি ঘাট নিয়ে রেষারেষির জন্যই আজ নানুরের ‘গ্যাং ওয়ার’। কাজল বা গদাধরের ‘বিশ্বস্ত’ সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাথমিক স্কুলে চাকরি দেওয়া নিয়েও দু’জনের চিড় বেড়েছে। যা আজ বিরাট ফাটলে পরিণত। দুই শিবিরের মধ্যে গুলি ও বোমার লড়াইয়ে জীবন ওষ্ঠাগত হয়েছে সাধারণ মানুষের। বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাতেও ভয় পান অভিভাবকেরা। পাছে সন্তান সেই লড়াইয়ের মাঝে পড়ে যায়!
পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝে তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে পুরমন্ত্রী তথা বীরভূমের পর্যবেক্ষক ববি হাকিমের দৌত্যে অনুব্রত ও কাজলের সন্ধি হয়। তার পর থেকে বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচিতে অনুব্রত, কাজল ও গদাধরকে এক সঙ্গে দেখা গিয়েছে। তলায় তলায় অবশ্য তিক্ততা কখনও মেটেনি। দু’পক্ষের সংঘর্ষও থামার লক্ষণ নেই। গত সেপ্টেম্বরে ফিল্মি কায়দায় গদাধর-অনুগামী তিন তৃণমূল কর্মী খুন হওয়ার পরে দু’জনের শত্রুতা আরও চরমে ওঠে।
এ হেন কাজলকে অবশ্য প্রকাশ্যে পাত্তা দিতেই নারাজ অনুব্রত মণ্ডল। ‘কে কাজল?’—বোলপুরের নিচুপট্টির বাড়িতে বসে কাজল নিয়ে প্রশ্ন করতেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে উঠলেন তিনি। নানুরে ৩০-৩৫ হাজার ভোটে জিতবেন বলেও দাবি করলেন কেষ্টদা।
এতটা প্রত্যয়?
অনুব্রতর যুক্তি, ‘‘ও তো এখন সিপিএমে। ওর অত্যাচারে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। ও দলে থাকলে ওকে নিয়ে ভোট করলে আমাদের ক্ষতিই হত। ওর মতো ক্রিমিনাল সিপিএমে যাওয়ায় আমাদের সুবিধাই হয়েছে।’’
সুবিধা কি আদৌ হয়েছে? তৃণমূল সূত্রেই জানা যাচ্ছে, গোপনে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন কাজল। তার প্রমাণও মিলেছে, সম্প্রতি নানুরের মাটিতে বামেদের বিশাল মিছিল কিংবা নানুরের একমাত্র কলেজের ছাত্র
সংসদ রাতারাতি টিএমসিপি-র হাত থেকে এসএফআইয়ের কব্জায় চলে যাওয়া দেখে। ক’দিন আগে নানুরে সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের সভায় জনসমাগমের পিছনেও কাজলের ‘অদৃশ্য’ হাত দেখেন জেলা তৃণমূলের অনেকে। একই ভাবে সিপিএমের দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে থাকা খুজুটিপাড়ার পার্টি অফিস খোলাও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়।
ফলে, এ বার নানুরের ভোট হতে চলেছে ‘অন্য রকম’। কাজলের অনুগামীরা বলে দিচ্ছেন, ‘‘ভোটের দিন ‘দাদা’ কী খেল দেখায়, দেখুন!’’
(সহ প্রতিবেদন: আবীর মুখোপাধ্যায়)