West Bengal Assembly Election 2021

Bengal Polls: ধর্মের বাতাস বনাম গড় রক্ষার লড়াই

ধর্মীয় মেরুকরণের এই চোরা হাওয়ায় জেলায় হাত বা জোড়াফুলের হিসেব যে বরবাদ হতে পারে, অনেকেই সেটা মনে করছেন।

Advertisement

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২১ ০৫:৪১
Share:

কিরীটেশ্বরীর পূজারী দিলীপকুমার ভট্টাচার্য। নিজস্ব চিত্র।

এই যে শিলাখণ্ড এখানে নিত্য পূজা পায়, মনে করা হয় এ’টি সতী মায়ের করোটি— মহাদেবের অস্ত্রে ছিন্ন হয়ে পড়েছিল মুর্শিদাবাদের নবগ্রামের এই কিরীটকোনা গ্রামে। ‘করোটি’ লোকমুখে অপভ্রংশ হয়ে কিরীটিতে পরিণত হয়েছে।

Advertisement

খর বৈশাখের শুনশান দুপুরে জনমনিষ্যি নেই কিরীটেশ্বরী দেবালয়ে। পাশে সাত-বুড়ো অশ্বত্থ গাছের কোনও ডালে বসে এক টানা ডেকে চলেছে নিঃসঙ্গ ঘুঘুপাখি। গর্ভগৃহে প্রাচীন পাথরের মেঝেতে বসে ধর্মের গূঢ়-কথা শোনাচ্ছেন পূজারী দিলীপকুমার ভট্টাচার্য। “৫১ পীঠের অন্যতম হিন্দুদের এই প্রাচীন দেবালয় প্রতিষ্ঠা করেন পদ্মার ওপারে নাটোরের রানি ভবানী। শিলাখণ্ডের চালচিত্রে এই যে ছবি, এটা বৌদ্ধ যন্ত্রম— বহু গুম্ফায়, স্তূপে এই চিত্রের পুজো হয়। আর তার দু’পাশে যে স্তম্ভ, যার মাথায় ইসলামি রীতির খিলান— এটা বহু মসজিদে দেখবেন। কিরীটেশ্বরীর এই শিলাখণ্ডে নিবেদিত ভক্তের শ্রদ্ধা অনায়াস ধারায় প্রবাহিত হয় অপর ধর্মের সূক্ষ্ম-প্রতীকেও। এ-ই তো সনাতন হিন্দু ধর্ম— হানাহানির স্থান নেই এতে !”

উঠে পড়েন পূজারী, শালপ্রাংশু দেহ, কপালে তাঁরও আঁকা সিঁদুরের টিকা। কিন্তু এমন চেহারার রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে কতই না ফারাক তাঁর ধর্ম-বীক্ষার। কিরীটেশ্বরীকে নিবেদিত সেই পদ্ম যখন ভোটের প্রতীকে পর্যবসিত, তার পূজারীরা শুধু ‘ওরা-আমরা’-য় ব্যস্ত। এবং সেই মেরুকরণ দিব্যি পৌঁছে গিয়েছে সুবে বাংলার নবাবি জেলা মুর্শিদাবাদেও, রাজ্যের ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা যেখানে সংখ্যালঘু। সেই ৩৩ শতাংশ ভোটকে সংহত করে জেলায় পদ্ম ফোটাতে মরিয়া গেরুয়া শিবির। মুখে যদিও বিজেপি নেতারা বলছেন, তাঁরা কেন্দ্রের উন্নয়নের কথাও তুলে ধরছেন। জেলায় ৫ জন সংখ্যালঘু প্রার্থী দিয়েছেন। সুতরাং শুধু ধর্ম তাঁদের কৌশল নয়। তবে ধর্মীয় মেরুকরণের এই চোরা হাওয়ায় জেলায় হাত বা জোড়াফুলের হিসেব যে বরবাদ হতে পারে, অনেকেই সেটা মনে করছেন।

Advertisement

যেমন ঐতিহ্যগত ভাবে কংগ্রেসের আসন বহরমপুর। রেল স্টেশন থেকে বড় রাস্তায় উঠতেই ধাক্কা। ডানা কাটা সুবিশাল গরুড় পাখির মতো মুখ থুবড়ে বছরের পর বছর পড়ে আছে শেষ-না-হওয়া উড়ালপুল। রাজ্য সরকার ও রেল দফতরের বনিবনার অভাবের যেন জ্বলন্ত উদাহরণ। নাজেহাল যানজটে ব্যস্ত চত্বর। “অধীর চৌধুরী দিল্লির এত বড় নেতা, এইটার একটা ব্যবস্থা করতে পারেন না,” ক্ষোভ উগরে দেন আমজনতা। আর সেই সুযোগে ‘ডাবল ইঞ্জিন’-এর তত্ত্ব পাতে ঢেলে দেন সন্ধানীরা, ধর্মের অনুপান সহযোগে। মেরুকরণের হাওয়া যে রয়েছে, মানলেও গায়ে মাখতে চাইছেন না বহরমপুরে কংগ্রেসের প্রার্থী মনোজ চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, “বহরমপুর অন্য জিনিস। ভোট হয়তো কয়েকটা বেশি পাবে ওরা। তবে এখানকার মানুষ জানেন, হাত বাড়ালে ‘হাত’-কেই পাওয়া যায়।” বামেদের সঙ্গে বোঝাপড়াটাও এ বার বেশ শক্তপোক্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে তাঁর। সঙ্গে ২০১৯-এ অধীর চৌধুরীর প্রায় ৮০ হাজার ভোটের লিড। কিন্তু হিসেবিরা বলছেন, ওটা অধীরের ভোট, মনোজের নয়। জেলা সামলে বহরমপুরের প্রচার শেষ বেলার জন্য তুলে রেখেছিলেন অধীর। কোভিড সংক্রমণে ঘরবন্দি হয়ে পড়ায় সেটা আর হয়নি।

পদ্মের হাওয়ায় হাসি ফুটছে জোড়াফুলের প্রার্থী নাড়ুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের। তবে ২৯ এপ্রিল জেলায় দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোটের আসনগুলির মধ্যে খড়গ্রাম, কান্দি, বড়ঞা, ভরতপুর, বেলডাঙ্গা, নওদায় যথেষ্ট সাড়া পাচ্ছে সংযুক্ত মোর্চা। ডোমকলেও প্রচারে এগিয়ে শরিক সিপিএমের যুবনেতা মুস্তাফিজুর রহমান। কান্দিতে কংগ্রেসের সাইফুল আলম খান বনুর প্রতিপক্ষ জোড়াফুলের অপূর্ব সরকার এবং পদ্মের গৌতম রায়— দু’জনেই এক সময়ের অধীর অনুগামী। আবার জলঙ্গিতে দু’বারের সিপিএম বিধায়ক আব্দুর রজ্জাক শিবির পাল্টে এ বার জোড়াফুলের প্রার্থী।

মুর্শিদাবাদ যদি নবাব সিরাজের হয়, এখন তবে সেই মসনদে অধীর চৌধুরী। নিজের গড় বাঁচাতে লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা যে অমানুষিক পরিশ্রমটা করেছেন, তার সঙ্গে অনেকেই রানা কুম্ভের সাদৃশ্য পাচ্ছেন। প্রতিপক্ষ দুই ফুলের তাবড় নেতা-নেত্রীরা ময়দানে, মুর্শিদাবাদে তিনি একাকী ঘোড়সওয়ার! ২০১৬-য় জেলায় ১৪টি বিধানসভা আসন পেলেও ২০১৯-এর লোকসভার ভোটে জেলার তিনটি আসনের মধ্যে দু’টিই হারায় কংগ্রেস। নিজের বহরমপুরেও পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্রে জোড়াফুলের কাছে পিছিয়ে পড়েন অধীররঞ্জন। ঘরবন্দি হয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত ফি-দিন জেলা চষে চার-পাঁচটি করে সভা বা রোড-শো করতে হয়েছে তাঁকে। তার পরেও ফাটল দিয়ে মাথা তুলছে পদ্মের কলি।

গত লোকসভার হিসেবে জেলার ২২টির মধ্যে ১৮টিতেই এগিয়ে ছিল জোড়াফুল। তবে সেই সময়ে দলের পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে থাকা শুভেন্দু অধিকারী এখন ফুল পাল্টে পদ্মে। ভোটের আগে জেলার নেতারা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে অন্তত ১৬টি আসনে জয় উপহার দেওয়ার অঙ্গীকার করে এসেছিলেন। জেলা তৃণমূল সভাপতি আবু তাহের খান বলছেন, “প্রথম দফায় যে ৯টি আসনে ভোট হয়েছে, তার সব ক’টিই জিতব। পরের দফা ধরে লক্ষ্যপূরণ হয়ে যাবে।” শুভেন্দুর পথে বিজেপিতে না-গেলেও কিছু নেতা কংগ্রেসে গিয়েছেন, অথবা মিরজাফরের ভূমিকা নিয়েছেন। জেলা পরিষদে তৃণমূলের সভাধিপতি মোশারফ হোসেন মণ্ডল তো নওদা কেন্দ্রে হাত-এর প্রার্থীই হয়ে গিয়েছেন। অনেকে সরাসরি প্রচারে নেমেছেন বিজেপি বা কংগ্রেসের হয়ে। কয়েক জন দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্দল হয়েও দাঁড়িয়ে গিয়েছেন।

২৬-এ প্রথম দফা ভোটের মুখে দলনেত্রী মমতা নিজেই ঘাঁটি গেড়েছিলেন বহরমপুরে। কর্মীদের সঙ্গে বৈঠকের পরে ভোটের মধ্যেই ‘মিরজাফর’দের শাস্তি ঘোষণা করেছেন। জেলার তৃণমূল নেতৃত্ব আশা করছেন, মুখ্যমন্ত্রীর এই পদক্ষেপে কর্মীরা আরও চাঙ্গা হবেন। তৃণমূলের এক জেলা নেতার অভিযোগ, পদ্মের সঙ্গে গোপনে গাঁটছড়া বেঁধে জোড়াফুলের ভোট কাটার ফন্দি এঁটেছেন অধীরই। শুভেন্দুর সঙ্গে তাঁর একটা যোগাযোগ আছে বলেই নন্দীগ্রামে তাঁর জোটের প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও অধীর ঘোষণা করেন— সেখানে শুভেন্দু জিতবে। কংগ্রেস নেতা মনোজ চক্রবর্তী অবশ্য বলছেন, “অধীরের বিরুদ্ধে এ সব ছেঁদো কথা মুর্শিদাবাদের মানুষ মানবেন না!”

তবে বহরমপুরে মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘাঁটি গাড়ার সিদ্ধান্ত ভাল চোখে দেখছে না অন্য দুই প্রতিপক্ষ। প্রশাসনকে চাপে রেখে নির্বাচনে প্রভাব খাটানো তাঁর লক্ষ্য, নির্বাচন কমিশনকে চিঠিতে নালিশ করেছে বিজেপি। নিভৃতবাস থেকে নির্বাচন কমিশনকে লেখা অধীর চৌধুরীর চিঠিতে আবার বলা হয়েছে, ‘তিনি প্রভাব খাটিয়ে সরকারি আধিকারিকদের নির্দেশ দেবেন। সঙ্গে তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনীকেও মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে ভোট লুট করার নির্দেশ দেবেন।’ জবাবে তৃণমূলের জেলা সভাপতি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী একটি বেসরকারি হোটেলে ছিলেন, কারও সঙ্গেই দেখা করেননি। তার পরে এ সব অভিযোগ তোলা বাতুলতা মাত্র।”

নবাবের জেলার ভোটের লড়াইয়ে যেন ইতিহাসেরই পূর্বানুবৃত্তি। সিরাজ-উদ-দৌলা চরিত্র রয়েছে, উদ্ভাসিত মিরজাফরেরা, এমনকি ধনাঢ্য জগৎ শেঠ-উমিচাঁদরাও!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement