খড়্গপুরে বিএনআর ময়দানের সভায় নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দিলীপ ঘোষ। শনিবার। নিজস্ব চিত্র।
বিজেপির গায়ে লেগে থাকা ‘অবাঙালি’ তকমা মুছতে মরিয়া হয়ে এ বার আসরে নামলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। খড়্গপুরে শনিবার নির্বাচনী প্রচারে এসে মোদী বলেন, ‘‘বিজেপি জনসঙ্ঘ থেকে বেরোনো দল। জনসঙ্ঘের জন্মদাতার নাম কী? জনসঙ্ঘের জন্মদাতার নাম হচ্ছে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এখানে যদি বাংলার কোনও দল থেকে থাকে, তা হলে সেটা শুধু বিজেপিই।’’ প্রধানমন্ত্রীর সংযোজন, ‘‘বিজেপির ডিএনএ-তে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আচার, বিচার, ব্যবহার, সংস্কার আছে।’’
মোদীর এই বক্তব্যে অবশ্য সহমত নন ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান এবং রাজনীতির অনেকেই। আর বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল ওই মন্তব্যের জন্য মোদীকে ‘অসত্য ইতিহাস’ প্রচারের দায়ে অভিযুক্ত করেছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বিজেপির কোনও ডিএনএ রিপোর্ট আছে কি না, জানা নেই। ডিএনএ দিয়ে আমরা গোটা মানুষকে চিনি না। আমরা মানুষকে চিনি চেহারা এবং আচরণ দিয়ে। বিজেপির ডিএনএ-তে কি আছে, তা হয়তো প্রধানমন্ত্রী জানেন! কিন্তু আমরা বিজেপিকে চিনি তার আচরণ দিয়ে। যেমন বিজেপির নেতৃত্বে বাবরি মসজিদ বিরোধী আন্দোলন হয়েছিল। পরিণতিতে তা ভাঙা হয়েছিল।’’ সৌরীনবাবুর সংযোজন, ‘‘নবজাগরণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আমরা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে পেয়েছি। তাঁর ভারত-চিন্তায় হিন্দুত্ববাদী ভারত ছিল না।’’ শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গেও এখনকার বিজেপির পার্থক্য করতে চান সৌরীনবাবু। তাঁর মতে, ‘‘শ্যামাপ্রসাদ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করলেও এখনকার বিজেপির মতো এত সঙ্কীর্ণ রাজনীতি করেননি। নরেন্দ্র মোদীরা তামিলনাড়ুতে গিয়ে তামিল, পশ্চিমবঙ্গে এসে বাঙালি সাজছেন। এর মধ্যে একটা প্রাদেশিকতার উপাদান আছে। শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু ভারত থেকে এই রাজনীতি সরে এসেছে।’’
ইতিহাসবিদ সুগত বসু বলেন, ‘‘শ্যামাপ্রসাদ বাংলার রাজনীতিতে একটি সঙ্কীর্ণ স্রোতের প্রতিনিধিত্ব করতেন। সাম্য, ঐক্য, সম্প্রীতির যে উদার স্রোত, সেখানে ধারাবাহিক ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। বাংলার উত্তরাধিকার এটাই।’’ তাঁর কথায়, ‘‘বাংলা ও বাঙালির ডিএনএ সেই উদার স্রোতের উত্তরাধিকার বহন করছে। এটা কেউ গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও পারবেন না। আরও একটি জিনিস হল— বঙ্গভঙ্গ এবং তার ফলে পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের দুর্দশার দায় শ্যামাপ্রসাদ এড়াতে পারেন না। তাই যাঁরা তাঁকে অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করতে চাইছেন, বঙ্গভঙ্গের উদাহরণ সামনে রেখে তাঁদের বুঝতে হবে, শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু বাঙালিকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।’’
বিজেপিকে ‘বহিরাগত’ এবং ‘বাংলা বিরোধী’ বলে লাগাতার প্রচার করছে তৃণমূল। নির্বাচনী প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘বাংলা থাকবে বাংলার হাতেই, বহিরাগত গুন্ডাদের হাতে যাবে না।’’ এ বার নির্বাচনী প্রচারে এসে তৃণমূলকে পাল্টা বিঁধলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
প্রধানমন্ত্রীর ওই মন্তব্যে প্রত্যাশিত ভাবেই রাজনৈতিক লাভের লক্ষ্য দেখছে তৃণমূল। দলের মুখপাত্র সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় বলেন, ‘‘বৃহত্তর বাংলার ভূখণ্ড হারানোর দায় এই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়েরও। তা ছাড়া বিজেপির মতো এই সাম্প্রদায়িক দলটি তো তৈরি হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর ২৭ বছর পরে। আর শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কোনও তুলনাই চলে না। আশুতোষ ছিলেন উদারমনা, আধুনিক শিক্ষার অন্যতম প্রবর্তক।’’ তাঁর কটাক্ষ, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম কোনও কিছুই জানেন না। কিন্তু এই ইতিহাস বাঙালি মাত্রেই জানেন। তাই এই দুই নাম ব্যবহার করে তিনি যে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে চেয়েছেন, তা হাস্যকর।’’
পাশাপাশি, প্রাক্তন আমলা জহর সরকার মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘শ্যামাপ্রসাদ আসলে হিন্দু মহাসভার নেতা। যখন আরএসএস একটি রাজনৈতিক সংগঠন করার কথা চিন্তা করে, তখন তিনি জনসঙ্ঘ তৈরি করেছিলেন। তবে সেটা একেবারে তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে। আজ বিজেপির ডিএনএ খুঁজতে যদি শ্যামাপ্রসাদের নাম টেনে আনা হয়, তা হলে তাঁর সঙ্গে হিন্দু মহাসভার সম্পর্কের কথাও আরও বড় হয়ে সামনে আসবে। সে ক্ষেত্রে গাঁধী হত্যার প্রসঙ্গ এড়ানো যাবে না।’’