বর্ধমানের গোদার একটি বুথে এক জন ভোট দেওয়ার সময়ে হাজির অন্য জন। ছবি: উদিত সিংহ।
ধাক্কাধাক্কি করা হবে না। বড় গোলমালও নয়। বাজিমাত করতে হবে নিঃশব্দে।
ভোটের দিনে ‘কাজ হাসিলের’ জন্য এটাই ছিল ছক। কেতুগ্রাম বাদ দিলে বাকি সব এলাকাতেই ‘প্লেয়ার’রা ছক মেনে খেলে দিয়েছেন, বৃহস্পতিবার ভোট শেষে মনে করছে শাসক দল।
তাঁদের দাবি, এমন ভাবে কাজ সারা হয়েছে যে বিরোধীরাও সে ভাবে বড় কোনও অভিযোগ তুলতে পারেনি। বরং, তারা মনে করছে, ভোটারেরা পণ্ড করে দিয়েছেন তৃণমূলের ‘কৌশল’। সিপিএমের জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক অবশ্য বলছেন, “সারা দিন ধরে তৃণমূল বুথ দখল, ভোটার আটকানো, এজেন্টদের চমকানোর চেষ্টা করেছিল। কিছু জায়াগায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু মানুষের প্রতিরোধের সামনে বেশির ভাগ জায়গায় তৃণমূলের কৌশলের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে।’’ বিজেপির বর্ধমান সদর জেলা সভাপতি সন্দীপ নন্দী অবশ্য বলেন, “সিপিএমের কায়দাতেই তৃণমূল চুপচাপ ভোট করিয়ে নিল।’’
জেলা তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, গত সোমবার বিকেলে দলের জেলা পর্যবেক্ষক অরূপ বিশ্বাস ও জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথ ভোটের রণনীতি নিয়ে বৈঠক করেন। কোন এলাকায় কারা কী ভাবে ভোট নিয়ন্ত্রণ করবেন, ছক কষা হয় সেখানে। সেই ‘ছক’ অনুযায়ী খেলে দিয়েছেন ‘প্লেয়ার’রা— দাবি তৃণমূল নেতৃত্বের। এ দিন সকাল ১০টা নাগাদ বর্ধমান শহরের টাউন স্কুলের বুথে গিয়ে দেখা যায়, তৃণমূল নেতা উত্তম সেনগুপ্ত দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে। বুথ থেকে ২০০ মিটার দূরের কথা, ১০ মিটারের মধ্যেই ‘শিবির’ করেছেন তাঁরা। সেখান থেকে দেদার জলের বোতল বিলি হচ্ছে। ভোটারদের প্রভাবিত করছেন? “এই গরমে প্রতিবেশীরা জল চাইলে আপনি কী করতেন? জল দেওয়াটা কী অপরাধ?’’—পাল্টা প্রশ্ন উত্তমবাবুর। ততক্ষণে ওই বুথে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট হয়ে গিয়েছে।
পার্কাস রোড থেকে সোজা পাওয়ার হাউস পাড়া। গোটা রাস্তায় ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে ‘আড্ডা’ দিচ্ছেন তৃণমূলের কর্মীরা। রাজ কলেজের বুথের ঠিক আগেই পরপর দু’টো তৃণমূলের বুথ ক্যাম্প। অভিযোগ, এই রাস্তায় নাকি তৃণমূলের বাহিনী বেশ কয়েক জনের ভোটার কার্ড ও ভোটার স্লিপ কেড়ে নিয়েছে।
বর্ধমান উত্তর কেন্দ্রে এক বুথে গিয়ে দেখা গেল, জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ গোলাম জার্জিস ভিতরে একাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সেখানে সিপিএমের কোনও এজেন্ট নেই। পাশের বুথেও সিপিএমের এজেন্ট ছিল না। খাঁ-খাঁ বুথে আপনি কী করছেন? ক্ষিপ্ত হয়ে গোলাম জার্জিস বলেন, “বুথের ভিতর এক জন ভোটার কী করেন? আমিও তাই করতে গিয়েছিলাম।’’ কিন্তু আপনি তো এই বুথের ভোটারই নন? সদুত্তর না দিয়ে হনহন করে হাঁটা দিলেন তিনি। প্রিসাইডিং অফিসার নুরুল হক বলেন, “আমি তো ভেবেছিলাম, উনি ভোট দিতে এসেছেন! বিষয়টি বোঝার পর কেন্দ্রীয় বাহিনীর নির্দেশে উনি চলে যান।’’
বর্ধমান শহরে পূর্ত ভবনের ভিতর দু’টি বুথে সিপিএমের কোনও এজেন্ট ছিল না। তার মধ্যে ২৭৭ নম্বর বুথে তৃণমূলের প্রদীপ দে ও দীপনারায়ণ সাউ নামে দু’জন এজেন্ট বসেছিলেন। আর বাইরে ভোটারদের ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে দেখা গেল তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা রাসবিহারী হালদার। ওই বুথের প্রিসাইডিং অফিসার সুজিতকুমার সিংহ জানান, সকাল থেকে সিপিএমের কোনও এজেন্টকে তিনি দেখেননি। তাহলে ‘পোলিং এজেন্ট’-এর টেবিলে দু’জন বসে থাকলেন কী ভাবে? আমতা-আমতা করে তিনি বলেন, “সম্ভবত এক জনকে ‘রিলিফ’ দেওয়ার জন্য অন্য জন এসেছেন।’’ একই উত্তর তৃনমূল ছাত্র পরিষদ নেতার। আর তৃণমূলের দু’জন এজেন্ট কথা না বলে শুধুই হাসেন। বোঝা গেল, সকাল থেকেই এই বুথে জমিয়ে বসেছেন তাঁরা।
বিবেকানন্দ কলেজ মোড়ের কাছে একটি বুথে গিয়ে দেখা যায়, দু’টি বুথে ছ’জন পোলিং এজেন্ট বারান্দায় বসে খোশমেজাজে গল্প করছেন। তখন বিকেল ৩টে। ওই ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ৭৫ শতাংশের উপর ভোট পড়ে গিয়েছে। সিপিএমের এজেন্ট নেই? কেউ উত্তর দেন, ‘‘সিপিএমের এজেন্ট খেতে গিয়েছেন’’, কেউ আবার বললেন, ‘‘বাথরুমে গিয়েছেন।’’ কিন্তু সেক্টর অফিসার ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর সামনে বসে বুথের কাছে তাঁরা আড্ডা দিচ্ছেন কী ভাবে? প্রশ্ন শুনেই সবাই এ দিক-ও দিক হাঁটা দিলেন।
বর্ধমানের বাবুরবাগ সিএমএস হাইস্কুলের সামনে দেখা গেল ২৭ নম্বরের কাউন্সিলর, তৃণমূলের অন্যতম ‘প্লেয়ার’ বসির রহমানকে। তিনি জানালেন, প্রতিটি বুথে এজেন্ট রয়েছে। কোথাও কোনও গোলমাল হয়নি। সবাই শান্তিতে ভোট দিচ্ছেন। কাঞ্চননগরের রথতলা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের সামনে নীল পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন দলের আর এক নেতা খোকন দাস। বললেন, ‘‘আমার এখানে সব বুথেই সকাল থেকে এজেন্ট আছে। তবে যতক্ষণ না ৯০ শতাংশ ভোট পড়ছে, শান্তি পাচ্ছি না।’’ ৯০ শতাংশ না হলে কী ‘জল’ ঢালা হবে? নেতা হেসে বলেন, “ও সব এখানে দরকার হয় না। মানুষ তৃণমূল ছাড়া কাকে ভোট দেবে?’’
কোনও ‘কৌশলের’ কথা মানতে চাননি তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক অরূপ বিশ্বাসও। তিনি বলেন, ‘‘ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে। মানুষের রায় মাথায় নিয়ে ১৬টি আসনেই আমরা জিতব।’’