প্রতীক্ষার প্রায় অবসান। রাত পোহালেই ভোট গণনা।
তবু কারও যেন তর সইছে না।
রেজাল্ট বেরনোর আগেই এক বার রেজাল্ট বেরিয়ে গিয়েছে। টিভি চ্যানেলের ভোট পরবর্তী সমীক্ষায়।
ভোট হয়ে গিয়েছে প্রায় এক মাস আগে। কে আসবে রাজ্যের ক্ষমতায়, মুর্শিদাবাদে কে ক’টা আসন পাবে, বহরমপুরের যুবরাজ উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ আলো করে বসতে পারবেন কি না, এ নিয়ে আলোচনা করে-করে জেলার মানুষ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
জেলায় ভোট হয়েছে ২১ এপ্রিল । ভোট ফুরোবার পর থেকেই হিসেব নিকেষ নিয়ে বসে পড়েছেন সবাই। ভোটের পর থেকে যার সঙ্গেই যার দেখা হয়েছে, ছোট্ট জিজ্ঞাসা, “কী বুঝছেন, কী হবে?” একঘেয়ে চর্চাটা খানিক থিতিয়ে এসেছিল। কিন্তু সব একঘেয়েমি উড়িয়ে পারদ আবার চড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে সোমবার রাতে টিভির পর্দায় বুথ ফেরত বা ভোট পরবর্তী সমীক্ষা। আবার স্নায়ুর চাপ বেড়ে গিয়েছে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী থেকে সাধারণ মানুষের।
সমীক্ষায় হাওয়াই চটির পদধ্বনি শোনার পরে প্রত্যাশিত ভাবে হাসি চওড়া হয়েছে তৃণমূল নেতাদের। এত দিন যাঁরা টেনেটুনে দু’টি আসন খুঁজে পাচ্ছিলেন, এখন তাঁরাই বুক ঠুকে বলছেন, “এই জেলায় ৯ থেকে ১০টা আসন ঠেকায় কে?”
সোমবারের ওই সমীক্ষায় একটি চ্যানেল মুর্শিদাবাদে তৃণমূলকে ৪টি আসন দিয়েছে। অন্য চ্যানেলের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, তৃণমূল পেতে পারে ৩টি আসন। যদিও একটিতে আবার তৃণমূলের সম্ভাব্য প্রাপ্তি শূন্য। কিন্তু এ সব ক্ষেত্রে যা হয়, তৃণমূল নেতারা ওই শেষ সম্ভাবনাকে আমল দিতে নারাজ। বরং বেশির দিকটাই তাঁরা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরছেন।
একই প্রবণতা জোটের নেতাদের। ভোট পরবর্তী সমীক্ষার ‘অপ্রিয় ফল’ মানতে চাইছেন না কেউই। জোটের দুই শরিক, সিপিএম এবং কংগ্রেস নেতারা যাবতীয় বুথ ফেরত সমীক্ষায় গুলি মেরে বুক ঠুকে বলছেন, রাজ্যে যা-ই হোক, মুর্শিদাবাদে ২২-এ ২২।
যদিও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী তা বলছেন না। বরং দু’দিন আগেই তিনি বলে দিয়েছেন, একটা আসন হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেটা জঙ্গিপুর না ডোমকল না হরিহরপাড়া, তা অবশ্য তিনি খোলসা করেননি। সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যও ঝেড়ে কাশছেন না। হরিহরপাড়া নিয়ে তাঁরও উদ্বেগ রয়েছে।
রাজ্যে প্রায় সার্বিক জোট সত্ত্বেও মুর্শিদাবাদই এক মাত্র ব্যতিক্রম। এক মাত্র এই জেলাতেই দশটি আসনে বাম এবং কংগ্রেস উভয় পক্ষই প্রার্থী দিয়েছে, ‘বন্ধুত্বপূর্ণ লড়়াই’ হয়েছে। যদিও প্রচার পর্বে সেই ফাটল ষথাসম্ভব মেরামত করার চেষ্টা করে গিয়েছে দু’পক্ষই। তৃণমূলকে রুখতে কিছু ক্ষেত্রে এমনকী শরিক প্রার্থীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে কার্যত কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছে সিপিএম। তা সত্ত্বেও কি গণনার ঠিক আগে জেলাকে তৃণমূল-শূন্য করার প্রশ্নে কিছুটা সংশয়ে জোট শিবির?
গত বিধানসভায় নেই-নেই করেও শেষ পর্যন্ত একটি আসনে শিকে ছিঁড়েছিল তৃণমূলের। অধীরের গোঁজ প্রার্থীর দৌলতে সাগরদিঘি আসনটি পেয়ে যায় তারা। গত পাঁচ বছরে এই জেলায় তৃণমূলের শক্তি অনেকটাই বেড়েছে। অন্যের ঘর ভাঙিয়ে প্রায় শতাধিক পঞ্চায়েতের দখলও নিয়েছে তারা। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দলের মধ্যেকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও। ফলে অর্জিত শক্তিকে ইভিএম পর্যন্ত কতটা পৌঁছে দিতে পেরেছে তৃণমূল, এই নির্বাচন কার্যত তারই পরীক্ষা। শাসক দলের নেতারা জানেন, জেলা তৃণমূলশূন্য হলে তাঁদের পরিণাম কেমন হবে।
এই অবস্থায় ভোট পরবর্তী সমীক্ষা তৃণমূল নেতাদের বাড়তি অক্সিজেন দিয়েছে, সন্দেহ নেই। যদিও জোটের নেতারা ওই সব সমীক্ষাকে আমল দিতে নারাজ।
কংগ্রেসের এক সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র অশোক দাসের দাবি, “এ সব অর্থহীন সমীক্ষা। এ সবের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা আছে বলেই আমরা মনে করছি না। আর তো ২৪ ঘন্টা মাত্র। ফল বেরোলে দেখা যাবে, সমীক্ষকেরা ঢোঁক গিলছেন। কংগ্রেস মনে করে, এ জেলায় ২২টি আসনই জোট পাবে।”
সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য আবার সাবধানী— “আমরা তো জোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করি না। এ ধরনের সমীক্ষা কে কী ভাবে করে, তা-ও জানা নেই। তবে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বলছি, জেলায় ২২টি আসনের মধ্যে হরিহরপাড়া নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে। অন্য ২১টি নিয়ে সিপিএম নিঃসংশয়।”
মজার ব্যাপার, তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনও বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করছেন না এই সব সমীক্ষা। গণনার ঠিক এক দিন আগে তিনি বলছেন, “তৃণমূল এই জেলায় ৮-৯টি আসন পাবে। সব দলের মধ্যে জেলায় শতাংশের হিসেবেও সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে তৃণমূল।”
পার্টি অফিস, চায়ের দোকান, বাসস্ট্যান্ড, বাজারহাট, বাস-ট্রেনে শুরু হয়ে গিয়েছে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা।
আর তো কয়েকটা ঘণ্টা!