কেশপুরের দোগাছিয়ায় একটি বুথের সামনে দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।
বজ্র আঁটুনি যেমন আছে, তেমনই রয়েছে ফস্কা গেরো!
কড়া কেন্দ্রীয় বাহিনী রয়েছে। কিন্তু, সে শুধু বুথের ভেতরেই। বুথ থেকে চার পা বাইরে তাদের কোনও নজরদারি নেই। কাজেই বুথের বাইরে রাজনৈতিক জটলা, হুমকি, চমকানি সবই চলছে অবাধে। অভিযোগের দু’টি আঙুলের একটি যদি কেন্দ্রীয় বাহিনীর দিকে ওঠে, অন্য আঙুলটি উঠছে শাসকদলের দিকে। রাজ্যে প্রথম দফা ভোটের দ্বিতীয় পর্যায়ে সোমবার সকাল থেকে বিভিন্ন জায়গায় দ্বিমুখী এই অভিযোগই উঠছে।
কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে থাকা বুথের ভেতরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমনই কড়া যে, অনেক ক্ষেত্রে সেখানে প্রার্থীদেরও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। নারায়ণগড় বিধানসভা কেন্দ্রের একটি বুথে সিপিএম প্রার্থী সূর্যকান্ত মিশ্রকেও আটকে দেওয়া হয়। প্রথমে পরিচয়পত্র দেখানো সত্ত্বেও তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অথচ প্রার্থীদের বুথে ঢোকার অনুমতি রয়েছে। পরে প্রিসাইডিং অফিসারের হস্তক্ষেপে তিনি ভেতরে ঢোকেন। বিরোধী দলের বেশ কয়েক জনকে তো বটেই, গড়বেতা বিধানসভা কেন্দ্রে শাসক দলের প্রার্থী আশিস চক্রবর্তীকেও বুথের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয় কেন্দ্রীয় বাহিনী।
অথচ বুথের বাইরের চিত্রটা একেবারেই আলাদা। যেমন কেশপুর। একটা সময় সিমিএমের খাস তালুক ছিল। পরিবর্তনের নির্বাচনেও কেশপুর থেকে জিতেছিলেন সিপিএম প্রার্থী রামেশ্বর দলুই। এ বার সেই কেশপুরের প্রায় ৫০ শতাংশ বুথে নির্বাচনী এজেন্ট দিতে পারেনি তারা। ভোট শুরু হওয়ার দু’ঘণ্টার মধ্যেই সিপিএমের তরফে অভিযোগ করা হয়, একতরফা ভোট হচ্ছে। বিরোধীদের ভোট দিতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিটি বুথের বাইরেই শাসক দলের জটলা। ভোট দিয়ে বেরোলেই ভোটারদের উদ্দেশে সেই জটলা থেকে ভেসে আসছে নানা মন্তব্য। দলীয় সমর্থকদের জন্য যেমন হাসি মুখের ধন্যবাদ রয়েছে, তেমনই বিরোধীদের জন্য রয়েছে কঠোর মুখের হুমকি। ‘বেইমানি করলেন তো’, ‘একটা মাস আর, তার পর কে বাঁচায় দেখে নেব’— ভোটাররা এমন হুমকি শুনলেও কেন্দ্রীয় বাহিনী কিন্তু নির্বিকার। ওটা যেন তাদের এক্তিয়ার বহির্ভূত এলাকা!
আরও পড়ুন
প্রমাণ করুন এ ঘাঁটি দুর্জয় শুধু দুর্বৃত্তের জন্যেই, সুজনের জন্য নয়
একই অভিযোগ উঠেছে নারায়ণগড়েও। বেশ কয়েকটি বুথে সিপিএমের এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অথচ কেন্দ্রীয় বাহিনী নীরব। শেষে জোটের প্রার্থী সূর্যবাবুর হস্তক্ষেপে ওই বুথের বেশ কয়েকটিতে এজেন্ট বসানোর ব্যবস্থা করা হয়। ওই বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রভাবিত বেশ কয়েকটি জায়গায় বুথ জ্যামের অভিযোগ ওঠে। সেই সব বুথে সূর্যবাবু হাজির হলে তৃণমূলের হুঁশিয়ারি ভেসে আসে। স্থানীয় নেতৃত্বকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এমনকী, সংবাদমাধ্যমকেও খবর দেওয়ার জন্য তাঁদের চমকানো হয় এই বলে, ‘এক মাস পরে আমরা ফের ক্ষমতায় আসছি। মনে রাখিস, তখন এটা দেখে নেব।’ বুথের বাইরের ঘটনা বলে, এ ক্ষেত্রেও যথারীতি নীরব দর্শকের ভূমিকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী।
অথচ, এলাকায় রুট মার্চ করে, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে, ভয় কাটিয়ে ভোট দিতে আসার পরিস্থিতি তৈরি করাটাও কেন্দ্রীয় বাহিনীর কাজের মধ্যেই পড়ে। শুধু বুথ নয়, বুথের বাইরেটাও তাদের এক্তিয়ারভুক্ত। অথচ অভিযোগ উঠেছে, সে সব কিছুই তারা করেনি। গ্রামে গ্রামে ধমক-চমকের ঘটনা ঘটেছে ভুরুভুরি। টাকাপয়সা দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। শাসকদলের বিরুদ্ধে ওঠা সেই অভিযোগ তারা খারিজও করেছে। কিন্তু, ভোট দিয়ে বেরোনোর পর বিভিন্ন জায়গায় ভোটারদের উদ্দেশে ভেসে আসা নানা মন্তব্য অভিযোগের সত্যতাকেই প্রমাণ করে। ‘যা বলেছিলাম, সেই মতো দিয়েছেন নিশ্চয়ই’ বা ‘ভোটটা জলে গেল না তো’— বুথের বাইরের জটলা থেকে উড়ে আসা এমন টুকরো টুকরো মন্তব্যের সঙ্গে চোখরাঙানি শাসকদলের মরিয়া ভাবকেই প্রমাণ করে। অথচ, এ সবকে গুরুত্ব দিতে চাইছে না কেন্দ্রীয় বাহিনী।
খড়্গপুর গ্রামীণ বিধানসভা কেন্দ্রের লোহানিয়া হাই মাদ্রাসায় বুথের ৫০ মিটারের মধ্যেই তৃণমূলের ক্যাম্প অফিস। অথচ, বিরোধীদের অভিযোগ পাওয়ার আগে কেন্দ্রীয় বাহিনী বিষয়টায় নজরই দেয়নি। কমিশনে অভিযোগ করার পর সেই ক্যাম্প সরানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অভিযোগ উঠছে প্রচুর। অথচ, স্থানীয়দের প্রায় কেউই মুখ খুলতে চাইছেন না। দুপুর একটার মধ্যে কমিশনের কাছে ১১৫০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। কমিশনের দাবি, এর মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ৯৫০টি ক্ষেত্রে।
বুথের মধ্যে কড়া নিরাপত্তা, অথচ বাইরে চূড়ান্ত ভয়ের ছবি। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে, ভয় কাটিয়ে কী ভাবে ২ সেকেন্ডের জন্য ইভিএম-এর বোতাপ টেপার সময় নিজের পছন্দের প্রার্থীকে এক জন ভোটার ভোট দেবেন, বিরোধীরা আপাতত সেই প্রশ্নেই সরব।