রাজ্যবাসী ধন্য ধন্য করেছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ফল ভুগতে হবে বলে শাসিয়েছেন। রাজ্য পুলিশের কাছে এখন চ্যালেঞ্জ, তাঁরা ফের মাথায় ফাইল চাপা দিয়ে টেবিলের তলায় লুকোবেন, নাকি শিরদাঁড়া সোজা করে উর্দির দায়িত্ব পালন করবেন! সোমবার পুলিশের বিভিন্ন মহলে কান পাতলে একটা বার্তা কিন্তু পরিষ্কার— প্রকাশ্যে শাসানি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকর্মীদের জেদই বাড়িয়ে দিয়েছেন। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্তা যেমন স্পষ্টই বলে দিলেন, ‘‘মনে রাখবেন আনুগত্যের একটা সীমা আছে। অনেক নীচে নেমেছি আর পারব না!’’
এ বারের ভোটে নির্বাচন কমিশন শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মোট ৬৭ জন পুলিশ অফিসারকে বদলি করেছিল। তার পর ভোটের তৃতীয় দফা থেকেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নিজের কাজ করে দেখিয়েছে রাজ্য পুলিশ। বীরভূমে শান্তিপূর্ণ ভোট হওয়ার পরে কলকাতায় তিন দফা এবং বিধাননগরে পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসা অর্জন করেছে। শাসকের ভূতেদের দাঁত ফোটাতে না দিয়ে নিজের ভোট নিজে দিয়েছেন মানুষ। ৫ মে, শেষ দফার ভোটে পূর্ব মেদিনীপুর এবং কোচবিহারে এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে কি না, এখন সেই জল্পনাই প্রবল। তারই মধ্যে রবিবার পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরের সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খোলাখুলি বলে দেন, ‘‘যা যা হয়েছে সব কিছুর উত্তর আমি বুঝে নেব।... যারা (পুলিশি তাণ্ডব) করল, আগামী দিনে তাদের ভুগতে হবে।’’
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যা-ই বলুন, রবিবার রাতেই রাজ্য পুলিশ ও জেলা পুলিশের সদর দফতর থেকে বার্তা গিয়েছে থানায় থানায়, ‘যে রকম সোজা ব্যাটে খেলছিলেন, তেমনই খেলতে থাকুন।’ কলকাতা পুলিশ ও জেলা পুলিশের ডজনখানেক ইনস্পেক্টর, সাব-ইনস্পেক্টর পর্যায়ের অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেও বোঝা যাচ্ছে, এই প্রথম ‘পুলিশ’ হয়ে ঘরে-বাইরে যে সম্ভ্রম পাচ্ছেন, তা আর ফেরত দিতে রাজি নন ওঁরা। ৫ মে, শেষ দফাতেও উর্দির মান রেখে ভোট করানোটাকে বাড়তি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছে পূর্ব মেদিনীপুর পুলিশ-প্রশাসন। এক কর্তা সোমবার বললেন, ‘‘আমরা ম্যাডামের থেকে বেতন পাই না। সূর্যকান্ত মিশ্রের থেকেও নয়। ভারত সরকারের হয়ে কাজ করি। ভোটের দিনও সে ভাবেই কাজ করব।’’ পুলিশকে এই ভাবে হুমকি দেওয়ায় বামফ্রন্ট এবং বিজেপি নির্বাচন কমিশনের কাছে মমতার নামে অভিযোগও জানিয়ে এসেছে।
পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার এখন অলোক রাজোরিয়া। ২০১২ সালে ২৫ জন ডব্লুবিপিএস ক্যাডারের অফিসারকে তৃণমূল সরকার আইপিএস হিসেবে মনোনীত করায় ‘সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল’-এ (ক্যাট) রাজ্য সরকার এবং ওই অফিসারদের বিরুদ্ধে মামলা করেন অলোক। তাঁর অভিযোগ ছিল, সরাসরি আইপিএসদের পদোন্নতি না দিয়ে সরকার বিভাগীয় অফিসারদের পদোন্নতি দিয়েছে। এহেন পুলিশ সুপারের অধীনে উর্দি তার উপযুক্ত কাজই করবে বলে জেলাবাসীর আশা।
৫ মে কোচবিহারেও ভোট। শোনা যাচ্ছে, এক তৃণমূল নেতা এর মধ্যেই কোচবিহারের এক থানার ওসিকে ফোন করে ধৃতদের মধ্যে কয়েক জনের ব্যাপারটা ‘দেখে নিতে’ বলেছিলেন। সেই ওসি বলেছেন, ‘‘সরি, অনুরোধ মানতে পারলাম না।’’ বার্তাটা স্পষ্ট। ‘বি নিউট্রাল, ডু অ্যাকর্ডিং টু ল’— এই আপ্তবাক্য থেকে সরছেন না উত্তরবঙ্গের পুলিশ কর্তারাও।
কী ভাবে এই বদল এল পুলিশের? বাহিনীর অন্দরমহলে কথা বলে বেরিয়ে আসছে দু’টো উত্তর। এক, দলদাসের তকমা গায়ে লাগতে লাগতে পুলিশের একটা বড় অংশ নিজেরাই আজ ক্লান্ত, বিরক্ত। নির্বাচন কমিশন যে মুহূর্তে তাঁদের নিজের কাজ নিজে করতে বলেছে, তাঁরা সুযোগটা লুফে নিয়েছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক থানার অফিসার ইন-চার্জের কথায়, ‘‘ভোটের দিন কয়েক আগে, আমাদের কাছে নির্দেশ আসে— পুলিশ পুলিশের কাজ করবে। এই নির্দেশটাই এত দিন উপর থেকে পাইনি। এখন মুখ্যমন্ত্রী কী বললেন সেটা নিয়ে ভাবছিই না।’’ দ্বিতীয়ত, পুলিশের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে মহার্ঘভাতার বকেয়া। বাঁকুড়া থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর থেকে মুর্শিদাবাদ একাধিক পুলিশ কর্তা ক্ষোভের সুরে বলেছেন, “শুধু চাপ দিলে তো হবে না। ডিএ নেই। উল্টে শাসক দলের একের পর এক দাদাকে টাকা জোগাতে হচ্ছে। তার পরেও শুধু শাসানি আর গালিগালাজ। সে জন্যই আজ পুলিশ খেপেছে।’’
অর্থাৎ? সরকার ডিএ বাকি রেখে যে ভাবে হুমকির সুরে কথা বলছে, তাতে বাহিনীর অনেকেরই মনের ভাবটা দাঁড়িয়েছে, ‘ভাত দেওয়ার নাম নেই কিল মারার গোঁসাই!’ মুখ্যমন্ত্রীর শাসানিতে তাঁরা অত্যন্ত অপমানিত বোধ করছেন। তাতেই আরও শক্ত হচ্ছে চোয়াল। রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক পদস্থ কর্তা যেমন বলছেন, ‘‘গত পাঁচ বছরে সরকারের পাশে থাকার চেষ্টা তো কম করিনি। তার পরেও এ ভাবে শাসালে নিজেদের চাকরবাকর মনে হয়, বড় গায়ে লাগে!’’ দক্ষিণ শহরতলির এক আইসি-র কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে মনে হচ্ছে আমরা পাবলিক সার্ভেন্ট নই, কোনও ব্যক্তিগত সংস্থার কর্মচারী। যখন মনে হবে আমাদের ছাঁটাই করে দেবে।’’ এর পরেও বর্তমান শাসক দল ক্ষমতায় ফিরলে কী হবে, ভেবেই আতঙ্কিত তাঁরা। তাঁদের আশঙ্কা, তখন দলের ছোট-বড় নেতারা থানায় ঢুকে পুলিশকে দাবড়াবেন, সেটাও সহ্য করতে হবে।
রবিবার মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনে অনেকেই নিশ্চিত, তাঁর রাগ মূলত কলকাতার নতুন পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্র এবং বিধাননগরের কমিশনার জাভেদ শামিমের উপরে। নিচুতলাতেও যাঁরা সুষ্ঠু ভাবে ভোট করিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আতঙ্কের বশে বাহিনীর একটি ছোট অংশ প্রভাবিত হতেও শুরু করেছেন। যেমন মুখ্যমন্ত্রীর হুমকির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কলকাতার পাটুলি এলাকায় পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে তৃণমূলের বাইক বাহিনীর তাণ্ডব দেখেছে বলে অভিযোগ। লালবাজারকে বাহিনী পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার মনে করছেন, ‘‘এমনটা অস্বাভাবিক নয়। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের কিছু প্রভাব তো পড়বেই।’’ অবসরপ্রাপ্ত এডিজি চয়ন মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘বাহিনী যে সুনাম অর্জন করেছে, একাংশের জন্য তা নষ্ট হলে দুঃখজনক।’’ পাটুলি থানার এক কর্মী কিন্তু জোরগলায় বললেন, ‘‘কয়েক জনের সঙ্গে পুরো বাহিনীকে জড়াবেন না। ভোটে আমরা নেতাদের গালাগাল খেলাম। আবার আমাদের মধ্যে থেকেই দু’জন মুখ্যমন্ত্রীকে ভোট দেওয়াতে নিয়ে গেলেন বুথের মধ্যে। পাটুলির ওসি-র ব্যাপারটাও সে রকম।’’
ঘটনা হল, ‘সে রকম’ অফিসারের সংখ্যাটা কমে যাচ্ছে। তাতেই অশান্ত হয়ে উঠছেন মুখ্যমন্ত্রী। সূর্যকান্ত মিশ্র কটাক্ষ করছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর রবিবারের কথা শুনে বুঝতে পারছি, আপনার লোক আর আপনার নেই।’’