গত অক্টোবরে বিধাননগর পুরভোটে মার খেয়ে রক্তাক্ত এবিপি আনন্দের সাংবাদিক অরিত্রিক ভট্টাচার্য। পুলিশের বহু দুর্নাম থাকলেও মেরুদণ্ডটা পুরোপুরি বিকিয়ে দেয়নি, এ বিশ্বাস ছিল। বিশ্বাসটা সে দিনই গুঁড়িয়ে যায়।
এসএলআর হাতে তিন জন পুলিশ কোনও দিকে না-তাকিয়ে হুড়মুড় করে ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ (এটিআই)-এর গেট দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। কী হয়েছে, বুঝতে আমরা ভেতরে দৌড়লাম। সম্ভ্রান্ত চেহারার এক বৃদ্ধ হস্টেলের দিক দিয়ে দ্রুত পায়ে কাঁপতে কাঁপতে আসছেন। এই ওয়ার্ডেরই ভোটার। উত্তেজনায় মুখ লাল। কাঁপা গলাতেই চিৎকার করছেন, ‘‘কাওয়ার্ড, স্কাউন্ড্রেল! বুথ লুঠ করছে আর পুলিশ পালাচ্ছে! এটা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন? এটা ভোট হচ্ছে?’’
দেখলাম, আরও যে কুড়ি-পঁচিশ জন ভোটার ছিলেন, তাঁরা তখন ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছেন। এক পাশে বিরোধী দলের এজেন্টরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে। ২১৪, ২১৫ নম্বর বুথের সামনে-পেছনে সব দরজা বন্ধ। ভেতরে ‘অপারেশন’ চলছে!
মাত্র সাত মাস আগের কথা। ৩ অক্টোবর, ২০১৫। বিধাননগর পুরভোট।
সেই বিধাননগরই আবার একটা ভোটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। সে দিনের টুকরো-টুকরো ছবিগুলো ভাবনায় ক্রমাগত ধাক্কা মারছে। ষোলো বছরের সাংবাদিক জীবনে ভোট-কভার তো কম হল না। তা হলে কোনও একটা ভোটের ‘হ্যাংওভার’ মাথায় চেপে থাকবে কেন?
থেকেছে, কারণ শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান উপনগরীর ‘ভদ্রলোকের ভোট’-এর ঐতিহ্যটা সে দিন খাক হয়ে গিয়েছিল। সল্টলেক আগে এমন ভোট দেখেনি। আর দ্বিতীয়ত, সাংবাদিক পরিচয়ের বাইরে বংশ-পরম্পরায় পুলিশের বাড়ির মেয়ে হওয়ায় লুম্পেন বাহিনীর তাণ্ডবের সামনে সেই পুলিশেরই নজিরবিহীন নিষ্ক্রিয়তা দেখে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল।
এফডি ব্লকের এটিআইয়ের সামনে ফোর্স নিয়ে পুলিশের উচ্চপদস্থ অফিসারেরা পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে। তাঁদের নাকের ডগায় অটোর পর অটো ভর্তি করে বহিরাগতরা ঢুকছে। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা গুন্ডাবাহিনী লেলিয়ে দিচ্ছেন সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকদের ওপরে! তারা ভাঙা বাল্ব, থান ইট, ভাঙা কাচের বোতল— যা পাচ্ছে, তা-ই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে! ভাবা যায়!
পুলিশের বহু দুর্নাম থাকলেও মেরুদণ্ডটা পুরোপুরি বিকিয়ে দেয়নি, এ বিশ্বাস ছিল। বিশ্বাসটা সে দিনই গুঁড়িয়ে যায়।
পুলিশের অনেক দুর্নাম থাকলেও তারা মেরুদণ্ডটা পুরোপুরি বিকিয়ে দেয়নি, এ বিশ্বাস ছিল। বিশ্বাসটা সে দিনই গুঁড়িয়ে যায়।
বন্ধ দরজায় প্রাণপণ ধাক্কা দিয়ে ছিটকিনি আলগা হতেই এটিআইয়ের ২১৪ নম্বর বুথের ভেতরে ঢুকে পড়েছিলাম আমি আর একটি বাংলা খবরের চ্যানেলের এক মহিলা সাংবাদিক। দেখলাম, ভোটের অফিসার-কর্মীরা সিঁটিয়ে বসে। গোটা আটেক মস্তান গোছের লোক মাখনের মতো কাজ চালাচ্ছে। দেওয়ালের সিসিটিভি খুলে মাটিতে ফেলা। ফার্স্ট পোলিং অফিসারকে চেয়ার থেকে তুলে সেখানে এক বেয়াদব চেহারা সটান বসে পড়েছে। সে খাতা দেখে পরপর ভোটারদের নাম আর সিরিয়াল নম্বর চিৎকার করে বলে যাচ্ছে। বাদবাকি বাহিনী ঠাট্টা-মস্করা করতে করতে একের পর এক প্যাঁ-পো করে ইভিএমের বোতাম টিপে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে নামে টিক দিয়ে যাচ্ছেন প্রিসাইডিং অফিসার !
আমরা ঢুকতেই তেড়ে এল চেহারাগুলো। গা থেকে ভকভক করে মদের গন্ধ, গলা জড়িয়ে যাচ্ছে, মুখ দিয়ে থুতু ছিটছে। দু’জন আমাদের ঠেসে ধরল দেওয়ালে। আমার বাঁ হাতটা মুচড়ে ধরে শুরু হল ‘মধুর’ বাণী— ‘‘কী করছি তা নিয়ে তোদের কী রে? বেশি পাঁয়তারা করলে বাইরে বেরোলে মুখে অ্যাসিড ঢালব।’’
২০১৫-য় সল্টলেকের পুরভোটের দিন সুজিত বসু। —ফাইল চিত্র।
তত ক্ষণে আমাদের ফটোগ্রাফার স্বাতী, আরও কয়েক জন সাংবাদিক এবং চিত্রসাংবাদিক দরজা ঠেলে ঢোকার চেষ্টা করছেন। বীরপুঙ্গবেরা দৌড়ে দরজাটা ঠেসে ধরল। দুই পাল্লার ভিতর স্বাতীকে পিষে দেওয়ার চেষ্টা করল। জল মাথার ওপরে উঠে যাচ্ছে দেখে আমরা রিপোর্টার-ফটোগ্রাফারেরা এ বার ওই গুন্ডাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে রুখে দাঁড়ালাম। স্টিল আর মুভি মিলিয়ে এতগুলো ক্যামেরা দেখে ওরা ঘাবড়াল। ‘দেখে নেওয়া’র হুমকি দিয়ে বুথের পেছনের দরজা খুলে ছুট লাগাল। ত্রিসীমানায় তখন কোনও পুলিশ নেই!
খবর এল, এফডি কমিউনিটি হলের সামনে কয়েকশো বাইরের ছেলে ভোটারদের আটকে দিয়ে বুথে ঢুকে পড়েছে। ছুটলাম। সুভাষ চক্রবর্তীর বাড়ির দিকে বাঁক ঘুরতেই দেখি, আশপাশের গলিতে ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলে। পুলিশ খানিকটা তেড়ে গিয়ে তাদের পিছু হঠাচ্ছে, আবার তারা ফিরে আসছে এবং পুলিশের সামনেই কলার উঁচিয়ে ২১০ এবং ২১১ নম্বর বুথে ঢুকছে। এই নিয়ে অভিযোগ জানাতে গেলেন স্থানীয় বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার সৌমিত্র লাহিড়ী। এক পুলিশকর্তা ধাক্কা মেরে প্রবীণ সৌমিত্রবাবুকেই মাটিতে ফেলে শাসালেন, ‘‘চলে যান এখান থেকে। না হলে লকআপে ভরে দেব।’’ কিছু ক্ষণ পর ওই জায়গাতেই ভোট-লুঠেরাদের কয়েক জন এক কনস্টেবলকে কলার ধরে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করল। তখন আর স্থির থাকতে পারলেন না ডিউটিরত এক আইসি। পাল্টা লাঠি চালিয়ে কিছু ক্ষণের জন্য হামলাকারীদের হঠিয়ে দিলেন। দিয়েই সাংবাদিকদের বললেন, ‘‘এই মারের ছবিটা প্লিজ কোথাও দেখাবেন না। তা হলে আর আমার চাকরি থাকবে না!’’
দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজনৈতিক নেতার ফোন ঘনঘন আসতে শুরু করেছে পাশে দাঁড়ানো আর এক পুলিশকর্তার মোবাইলে। পাশের ওয়ার্ডের এক সাব-ইনস্পেক্টর নাকি বড্ড বাড়াবাড়ি করছেন। মেরে বার করে দিচ্ছেন বহিরাগতদের। ওই সাব-ইন্সপেক্টরকে গ্যারেজ করে দিতে হবে। ‘হ্যাঁ স্যর, এক্ষুনি করছি স্যর’ বলে কপালের ঘাম মুছলেন বড়কর্তা। ঠিক সেই সময়ে খবর মিলল, এটিআইয়ের সামনে সাংবাদিক আর চিত্রসাংবাদিকদের ফেলে মারা হচ্ছে। আমরা বাকিরা দল বেঁধে আবার সে দিকে ছুটলাম।
এটিআইয়ের সামনে তখন ‘অপূর্ব’ দৃশ্য! বিধাননগর কমিশনারেটের দুই উচ্চপদস্থ কর্তা ফোর্স নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সামনে কয়েকশো মারমুখী মস্তান। তাদের মাঝখানে জঙ্গি মেজাজে দাঁড়িয়ে তৃণমূল নেতা সুজিত বসু। আমাদের দেখেই ভিড় থেকে উড়ে আসতে লাগল এলোপাথাড়ি ইট আর টিউবলাইট। চিৎকার করে সুজিতবাবুকে বললাম, ‘‘এটা কী হচ্ছে? আপনি কিছু করুন!’’ চোয়াল শক্ত করে তিনি উত্তর দিলেন, ‘‘কিছু করার নেই। পুলিশ আর মিডিয়া যা করছে, ছেলেরা খেপে গিয়েছে।’’ নেতার বচনে বল পেয়ে দ্বিগুণ উদ্যমে শুরু হল ইটবৃষ্টি। সঙ্গে এ বার কাচের বোতল। উপায় নেই, প্রাণ বাঁচাতে যে যে দিকে পারলাম ছুটলাম। কয়েক জন মাটিতে পড়ে গেলেন। লোহার রড দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হল দু’জন ক্যামেরাম্যানের।
পুলিশ প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই তাণ্ডব দেখল। তার পর গাড়িতে উঠে পালাল। চোরের মতো!