মাত্র পাঁচ বছরেই পুরো উল্টে গেল ছবিটা। ১৮০ ডিগ্রি অবস্থান বদল তৃণমূলের! গত বিধানসভা নির্বাচনে কমিশন আর কেন্দ্রীয় বাহিনীর জয়ধ্বনি শোনা গিয়েছিল তৃণমূলের মুখে। এ বার কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘিরে ধরে কোথাও বিক্ষোভ তৃণমূল বিধায়কের। কোথাও মন্ত্রী বলছেন, নির্বাচন কমিশন সন্ত্রাস চালাচ্ছে। কোথাও দুষ্কৃতী বাহিনী নিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপর হামলার চেষ্টায় তৃণমূল নেতা।
সোমবার ভোটগ্রহণ শুরুর কয়েক ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই অভিযোগের সুর শোনা যেতে শুরু করেছে তৃণমূল নেতাদের মুখে। রাজারহাট-গোপালপুরে এ বারও তৃণমূল প্রার্থী রাজ্যের বিদায়ী কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। ভোট শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর অভিযোগ, ‘‘এলাকায় নির্বাচন কমিশন চাপা সন্ত্রাস চালাচ্ছে।’’ মন্ত্রীর এই মন্তব্যে চাঞ্চল্য ছড়ায় বিভিন্ন মহলে। যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে একের পর এক নির্বাচনে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা, সেই তৃণমূলের প্রার্থীই এ বার সন্ত্রাসের অভিযোগ তুললেন! তাও আবার নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে! কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গেও এ দিন বচসায় জড়ান পূর্ণেন্দু। একটি ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে সিআরপিএফ তাঁকে বাধা দেওয়ায় পূর্ণেন্দু বসু মেজাজ হারান। সিআরপিএফ জওয়ানদের তিনি বলেন, ‘‘শুনুন, এটা গণতন্ত্রের উৎসব, কোনও জরুরি অবস্থা নয়।’’ তবে পূর্ণেন্দু বসুর কোনও যুক্তিতেই কান দেয়নি বাহিনী। কয়েক মাস আগের পুর নির্বাচনে পূর্ণেন্দুবাবুর এলাকায় যে রকম গোলমাল আর সন্ত্রাসের ছবি দেখা গিয়েছিল, তা থেকেই শিক্ষা নিয়েছে কমিশন। রবিবার রাত থেকেই গোটা এলাকায় প্রায় খানাতল্লাশির ঢঙে দুষ্কৃতীদের খোঁজ শুরু হয়। ধানমাঠ এলাকার কাছে একটি বাড়িতে তৃণমূল দুষ্কৃতীদের জড়ো করছে বলে জানতে পেরে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছয় বাহিনী। এলাকা ফাঁকা করে দেয়। কোনও বহিরাগতকে আশ্রয় দেওয়া হবে না বলে ওই বাড়ির প্রোমোটারের কাছ থেকে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হয়। বহিরাগত বাহিনীর জন্য বিরিয়ানির অর্ডার দেওয়া হয়েছিল যে দোকানে, তাঁর দোকানের বিভিন্ন মালপত্র রাতেই বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয়। কমিশনকে বুড়ো আঙুল দেখানোর সব ছক এমন ভাবে ভেস্তে যাবে, একেবারেই ভাবতে পারেননি তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনার ভোট ম্যানেজাররা। ফলে সোমবার সকাল থেকে অসহায় আস্ফালন করতে আর মেজাজ হারাতে দেখা গিয়েছে বারবার।
এখানেই শেষ নয়। পূর্ণেন্দু বসুর পাশের কেন্দ্র বিধাননগরেও একই ছবি। নির্বাচন কমিশন তথা কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে বিবাদে জড়ালেন বিধাননগরের তৃণমূল প্রার্থী সুজিত বসুও। বিধাননগর পুরভোটে অবাধ সন্ত্রাসের কথা মাথায় রেখে এ বার ভোটগ্রহণের দিনদুয়েক আগে থেকেই সল্টলেক এবং লেকটাউনে কড়া নজরদারি শুরু করেছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী। বিধাননগরের কোনও এলাকা থেকে সে ভাবে গোলমালেরও খবর আসেনি। আর মেজাজ ধরে রাখতে পারেননি বিধাননগরের বিদায়ী বিধায়ক। নিজের খাসতালুক দক্ষিণদাঁড়িতে সুজিত বসু তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গাড়ি ঘেরাও করেন বলে অভিযোগ।
একই ছবি ভাটপাড়ায়। ২০০১ সাল থেকে টানা সেখানে জিতে আসছেন তৃণমূলের অর্জুন সিংহ। এ দিন তাঁকেও টেনশনে কাটাতে হল গোটা দিন। ভাটপাড়া পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডে আদর্শ হিন্দু বিদ্যালয়ের বুথে এক মহিলা ভোটারকে দেখে সন্দেহ হওয়ায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা তাঁর পরিচয় জানতে চান। তার পর দেখা যায়, ওই মহিলার আঙুলে ভোটের কালি লাগানো রয়েছে। জওয়ানরা ওই তাঁকে বুথ থেকে বার করে দেন। এর পরই গোলমাল শুরু। তৃণমূল অভিযোগ করে, ওই মহিলা আদৌ ভোট দেননি, তবুও তাঁকে বুথে ঢুকতে দেওয়া হল না। জওয়ানরা তাঁকে চুলের মুঠি ধরে বার করে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ তোলা হয়। খবর পেয়েই প্রচুর লোকজন নিয়ে এলাকায় হাজির হন অর্জুন সিংহ। দ্রুত অতিরিক্ত বাহিনী আনিয়ে বুথে ঢোকার সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দীর্ঘ ক্ষণ গোলমাল করেও বুথে ঢুকতে পারেননি অর্জুন।
ব্যারাকপুরের বাম প্রার্থী দেবাশিস ভৌমিককে হেনস্থার ঘটনাতেও বাহিনী চার তৃণমূল কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। ব্যারাকপুরের বাচস্পতিপাড়ায় তৃণমূলের নেতা লালন পাসোয়ানের ঘনিষ্ঠ এক মহিলা তৃণমূল কর্মী এ দিন অভিযোগ করেন, সিপিএম প্রার্থী তাঁর শ্লীলতাহানি করেছেন। এর পর সিপিএমের উপর চড়াও হন স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা। ভেঙে দেওয়া হয় ডিওয়াইএফআই-এর একটি অফিস। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় অতিরিক্ত বাহিনী। চার দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করা হয়।
দিনভর বিভিন্ন বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী ও কর্মীরা যে ভাবে গোলমালে জড়িয়েছেন, তাতে নানা জল্পনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক শিবিরে। তৃণমূল নেতারা কি টেনশনে পড়ে গিয়েছেন? দিকে দিকে বিদায়ী বিধায়করা কি অশনিসঙ্কেত পেয়েছেন? তাই কি মেজাজ হারিয়ে কমিশনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তোলা হচ্ছে? বিরোধীরা বলছেন, হ্যাঁ, সেটাই সত্যি। তবে সত্যিটা কী, পরিষ্কার হবে ১৯ মে দুপুরের মধ্যেই।