বাঁ দিক থেকে নাসিম, জাইদি, তাপস, মমতা ও শিখা। — নিজস্ব চিত্র
ভোর-ভোর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন নাসিম-জাইদি।
‘‘চললে কোথায়?’’— চৌকাঠ থেকে উঁকি দিয়ে পিছু ডাকেন মমতা।
‘‘যাবে আর কোথায়, বেগুনের চারাগুলো সূর্য ওঠার আগেই লাগাতে হবে যে’’— দাঁতন করতে-করতে দাওয়া থেকে ফুট কাটেন তাপস।
‘‘বেলা চড়ার আগে দু’টো রুটি-গুড় মুখে কেটো গো’’— নাসিমের দিকে চেয়ে হাঁক পাড়েন শিখা।
নাসিম রা কাড়েন না। দ্রুত পা চালিয়ে সামনের বাঁক ঘুরে যান।
কে না জানে, নাসিম জৈদী মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, যাঁর দাপটে এ রাজ্যে আপাতত বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খাচ্ছে?
কে না জানে, মমতা কার নাম?
নদিয়ায় ‘তাপস’ বললে প্রথমেই কার কথা মনে পড়ে যেন? অভিনেতা থেকে নেতা, নেতা থেকে সাংসদ, পালপবংশীয় কীর্তিমান, তাই না?
আর শিখা? ‘সোনার বাংলার সোনার ছেলে’ সোমেন মিত্রের বিধায়ক স্ত্রী?
কথা হল, এঁরা সবাই এক বাড়িতে থাকেন। হোগলবেড়িয়া থানার কুমরি গ্রামে। সে বাড়িতে নাসিম কিন্তু ‘জৈদী’ নন, ‘বিশ্বাস’। জাইদিরও নাম কিন্তু নাসিম নয়, রহিমবক্স (জাইদি তাঁর ডাকনাম। মমতা তাঁর স্ত্রী, ফলে তিনিও ‘বিশ্বাস’, বন্দ্যোপাধ্যায় নন। দম্পতির বড় ছেলে তাপস, তিনিও পাল হয়ে উঠে কারও বিশ্বাসে আঘাত দেননি। ছোট ছেলে নাসিম। তাঁর স্ত্রী শিখাই বা ‘মিত্র’ হন কী করে? তিনিও জুড়ে নিয়েছেন ‘বিশ্বাস’।
কিন্তু কুমরি গ্রাম একঝুড়ি রসিকে ভর্তি। তাঁরা বলছেন— কী কাণ্ড! যে বাড়ির কর্তা নির্বাচন কমিশনার, সেই সংসারেরই কর্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী। তাপস একেবারে ছেলে! এ তো গেল রুলিং পার্টি। জোট আবার পোলিং এজেন্ট করেছে শিখাকে। ভোট জমজমাট!
বাড়িতে ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে খুব?
সকাল-সন্ধে নির্বাচন কমিশনারের নামে গাল পাড়ছেন মমতা?
লাজুক হাসছেন বিশ্বাস-গিন্নি— ‘‘না গো, আমাদের খুব মিলমিশ, কোনও ঝগড়া নেই!’’
পাড়ার লোকে জ্বালায় না?
‘‘নামের মিল থাকায় রাস্তায় সকলে আমাকে মুখ্যমন্ত্রী বলে ডাকে’’ — হাসছেন মমতা—‘‘ছেলেকে বলে সাংসদ আর বৌমাকে বিধায়ক।’’
পড়শি আলম বিশ্বাস বলেন, “ওঁরা সকলেই খুব রসিক। ওঁদের নাম নিয়ে মশকরা করতেও কেউ ছাড়ে না। মুখ্যমন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক তো ছিলেনই, এ বার নির্বাচন কমিশনারও মিলে যাওয়ায় গাঁয়ের লোক আরও মজা পেয়েছেন।’’
বাড়িতে এত সব তালেবর লোক, অথচ টানাটানি লেগেই থাকে। টিন আর টালির ছাউনি দেওয়া দু’টো ঘর। জাইদি (ওঁর নাম যে রহিমবক্স, তা ভোটার কার্ড ছাড়া আর কেউ জানে না) দুই ছেলেকে নিয়ে বিঘা দেড়েক জমিতে চাষ করেন। তাতে পেট চলে না, আয় বাড়াতে দিনমজুরিও করতে হয় তিন জনকে।
‘‘বিপিএল তালিকায় নাম উঠেছে ঠিকই, কিন্তু কোনও সরকারি সাহায্য পাইনি। যে বাড়িতে এত বড়-বড় সব লোক, সে বাড়িতে কি অভাব থাকার কথা?” — একটু তেতোই গলাতেই প্রশ্নটা করে ফেলেন মমতা।
গাঁয়ে সকলেই জানেন, জাইদি সরল মানুষ। কথায়-কথায় প্রাণ খুলে হাসেন। সামলে নিয়ে পাশে বসে হেসে ফেলেন মমতাও— ‘‘সকলে যখন মুখ্যমন্ত্রী বলে, মন্দ লাগে না!”