হাত মেলাতে। ক্যানিংয়ে বামেদের হয়ে প্রচার শেষে সমর্থকদের মাঝে সনিয়া গাঁধী। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
এই দৃশ্যটাই বোধহয় শুধু বাকি ছিল!
মঞ্চ থেকে মাঠে নেমে পড়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী। জনতার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। আর সুযোগ পেয়ে ঢাউস লাল পতাকা হাতে ভিড়ের মধ্যে থেকে তাঁর দিকে দৌড়চ্ছেন সিপিএম সমর্থকেরা!
শত্রু এবং সমালোচকদের মুখে ছাই দিয়ে তৃণমূকে হারাতে এ বার বাম-কংগ্রেসের সমঝোতা হয়েছে। জোটের তরফে যৌথ প্রচার চলছে। সে প্রচারে সাড়া এতটাই যে, জোট এখন রাজ্যে বিকল্প সরকার গড়ার স্বপ্নও দেখছে। তবু সনিয়া গাঁধী আর লাল ঝান্ডার পরস্পরকে কাছে টেনে নেওয়া— মঙ্গলবার বিকালের আগে শুধু এ রাজ্য কেন, এ দেশের রাজনীতিতে অনেকের কাছে অলীক স্বপ্নই ছিল!
ভোটের প্রচারে দ্বিতীয় বার রাজ্যে এসে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং এবং হুগলির শ্রীরামপুরে সরাসরি লাল ঝান্ডার নাম করে বামেদের ভোট দেওয়ার আবেদন জানালেন সনিয়া। দু’জায়গাতেই ময়দানে নেমে এসে উপস্থিত জনতার উষ্ণতা বোঝার চেষ্টা করলেন। তার মধ্যেই বাড়তি অভিঘাত থেকে গেল শ্রীরামপুর স্টেডিয়ামে। যেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সঙ্গেই বামপন্থীদের লড়াইয়ের প্রশংসা করে জনতার উদ্দেশে সনিয়া আর্জি জানালেন, ‘‘ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিতে হবে আপনাদের। রাজ্যের নতুন ভবিষ্যৎ রচনা করতে হবে। কংগ্রেস ও লাল ঝান্ডার প্রার্থীদের বিপুল ভোটে জেতান! নতুন যে সরকার তৈরি হবে, সেটা আপনাদেরই সরকার হবে!’’
নিখাদ সমাপতন হবে হয়তো! তবু সনিয়া ঐতিহাসিক দায়িত্বের কথা বলার সময়েই ইতিহাসের পরিহাসের মতো একটা অদৃশ্য যোগসূত্র কোথাও যেন তৈরি হল! কারণ, যে জেলায় দাঁড়িয়ে এমন আহ্বান জানাচ্ছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী, কাছাকাছি সময়ে সেই জেলারই অন্য প্রান্তে তারকেশ্বরে এ বারের ভোটে বাংলায় প্রথম বার প্রচারে নেমেছেন প্রকাশ কারাট! ইউপিএ-১ সরকারের উপর থেকে যাঁর সমর্থন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তের জেরেই বামেদের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ১০, জনপথের দরজা! মাঝে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়েছে। বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে বন্ধ দরজা আবার খুলিয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরিরা। তবু কারাটের হুগলিতে পা রাখার দিনেই সনিয়ার গলায় ‘লাল ঝান্ডা’ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকল!
জোটের জোর বাড়াতে ফের রাজ্যে সনিয়া গাঁধী। মঙ্গলবার।ছবি: পিটিআই।
বামেদের সঙ্গে সমঝোতায় বিশেষ ভূমিকা এ বার ছিল রাহুল গাঁধীর। রাজ্যে প্রচারে এসে তিনি খোলাখুলিই বাম প্রার্থীদের সমর্থন করার কথা বলেছেন। কিন্তু এখনও সহ-সভাপতি ছেলের চেয়ে সভানেত্রী মায়ের কথার ওজন বেশি। আর আগের বার রাজ্যে এসে জোট-প্রশ্নে সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন সনিয়া। তৃণমূলের একাংশ দাবি করছিল, বামেদের হাত ধরতে ১০, জনপথবাসিনীর তেমন আগ্রহ নেই! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবানীপুর-সহ রাজ্যে ষষ্ঠ পর্বের ভোটের আগে ক্যানিংয়ে সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী, কংগ্রেসের অর্ণব রায় প্রমুখ এবং শ্রীরামপুরে আব্দুল মান্নান, রবীন দেব, শুভঙ্কর সরকার-সহ জোট-প্রার্থীদের উপস্থিতিতে সেই জল্পনাকেই এ দিন গঙ্গায় ছুড়ে ফেললেন সনিয়া!
শ্রীরামপুরের মঞ্চে উপস্থিত সিপিএমের হুগলি জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় রটিয়ে দিয়েছিলেন, বামপন্থীদের সঙ্গে সমঝোতায় সনিয়ার আগ্রহ নেই। সনিয়ার কীসে আগ্রহ, তাঁর নিজের মুখেই সবাই শুনে নিল!’’
রাজ্যে এসে এ বার নজিরবিহীন ভাবে মমতাকে আক্রমণ করছেন কংগ্রেস সভানেত্রী। জোড়া সভায় এ দিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ক্যানিংয়ে সনিয়ার মন্তব্য, ‘‘পুকুরে একটা মাছ খারাপ থাকলেই অন্য মাছের বিপদ হয়। তৃণমূল হল সেই মাছ! তাদের জন্য এই এলাকায় ইলিশ মাছও আসতে পারছে না!’’ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসের মধ্যে তৃণমূল এবং বিজেপি-কে ফের এক বন্ধনীতেও এনেছেন সনিয়া।
তবে গেরুয়া খোঁচার চেয়ে সনিয়ার লাল সঙ্কেতেরই প্রভাব রয়ে গেল বেশি!