রাজ্যে তৃতীয় পর্বের ভোটকে একাই ব্যতিবস্ত রেখেছেন অনুব্রত মণ্ডল। বিরোধীদের লাগাতার অভিযোগ ও চাপের মুখে নড়েচড়ে বসে নির্বাচন কমিশন তাঁকে নজরদারিতে রাখার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। এ বার বীরভূমে ভোট শুরুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে অনুব্রতকে নিয়ে ‘সার সত্য’ ফাঁস করে দিলেন আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা!
ভাঙড় থেকে এ বারের তৃণমূল প্রার্থী রেজ্জাক জানিয়ে দিয়েছেন, অনুব্রত বা মনিরুল ইসলামের মতো ‘ভয়ঙ্কর’ লোকদের হাতেই ভোটের ‘মেশিনারি’ ছেড়ে রেখেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুব্রত কৌশলে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে পকেটে রাখেন। কেন্দ্রীয় বাহিনী চোখ বুজে থাকে আর সেই সুযোগে অনুব্রতের বাহিনী বুথ দখল করে দেদার ছাপ্পা দেয়! তার আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয় দেখানো তো আছেই। আর সশস্ত্র দুষ্কৃতী বাহিনীকে ভোটের জন্য ভাড়া করে আনাও অনুব্রতদের কর্তব্য।
রেজ্জাক যা বলেছেন, তার মধ্যে নতুন আবিষ্কার কিছু নেই। গত কয়েক বছরে বীরভূমে ভোট দেখতে অভ্যস্ত সাধারণ মানুষ থেকে সব রাজনৈতিক দলের কর্মী, সকলেই এই সত্য সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু ভোটের সময়ে শাসক দলেরই এক প্রার্থীর জবানে এই কাহিনি ফাঁস হয়ে যাওয়া তৃণমূলের জন্য নতুন অস্বস্তির কারণ বৈকি! তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে কেউ যে কারণে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। তবে ঘরোয়া ভাবে দলের এক প্রথম সারির নেতার মন্তব্য, ‘‘রেজ্জাক তৃণমূলে এলেনই তো এই সে দিন! এর মধ্যেই এত কিছু বলতে শুরু করে দিলেন!’’
কী বলেছেন রেজ্জাক? সিপিএম ছেড়ে সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া বর্ষীয়ান এই নেতার মন্তব্য, ‘‘অনুব্রত, আরাবুল (ইসলাম), মনিরুল (ইসলাম)— সব এক একটা নটোরিয়াস লোক। তাই মমতা ওদের কাউকে কাউকে ভোটে দাঁড় করায় না। ওরা ভোটের মেশিনারিটা সামলায়।’’ নিজের ভাষায় রেজ্জাকই ব্যাখ্যা দিয়েছেন, অনুব্রত যে ‘গুড়-জল’ বলেন, সেই গুড়ের মানে হল ‘মাল’ অর্থাৎ মদ! কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সব ‘মাল’ দিয়ে দেয় অনুব্রতের বাহিনী। শাসক দলের সহজ ছক হল, কেন্দ্রীয় বাহিনী খেয়েদেয়ে শুয়ে থাকবে আর তারা বুথে ছাপ্পা দেবে! তার আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদেরও বলা
হবে, তৃণমূলে ভোট না পড়লে থান পাঠিয়ে দেব!
রেজ্জাক যে তল্লাটে রাজনীতি করেন, সেই গ্রামবাংলায় এই হুমকির খেলা অবশ্য বহু দিনের রেওয়াজ। অনুব্রতদের হাতে পড়ে তা আরও শাঁস-জল পেয়েছে, আরও বেপরোয়া হয়েছে। বাংলার এই ‘সংস্কৃতি’র দিকে ইঙ্গিত করেই রেজ্জাক বলেছেন, ‘‘সব দলই ভোটের আগে মাস্কেট বাহিনী ভাড়া করে। ওরা ৬০ হাজার টাকা করে নেয়। ভোটের আগে আগাম ৩০ হাজার দিতে হয়। সঙ্গে টানা কয়েক দিনের খাবার আর মালও! ওরা সব মুর্শিদাবাদ, নদিয়া আরও কিছু জেলা থেকে এসে কাজ করে দিয়ে
চলে যায়।’’ আর ব্যক্তি অনুব্রত সম্পর্কে রেজ্জাকের অননুকরণীয় মূল্যায়ন— ‘‘ওকে তো দেখে মনে হয় একটা ছোট হাতি! হোঁদল কুৎকুৎ! ছোট গণ্ডার একটা!’’
তৃণমূলের অন্দরের চেনা ছক রেজ্জাক একেবারে দু’হাট করে দেওয়ার পরে বিরোধীরা স্বভাবতই ফের সরব হয়েছে। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, ‘‘ওই গোয়ালে ঢুকে রেজ্জাক বুঝতে পারছেন, কোন ধরনের জীবের সঙ্গে বাস করতে হচ্ছে! সিন্ডিকেট, দুর্নীতি, দক্ষ সংগঠকদের নিয়ে মমতার দল চলছে! এর বাইরে আর কী দেখে রেজ্জাক ওই দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, জানি না!’’ বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের ঘরের ভিতরে ঢুকে রেজ্জাক এখন যা দেখছেন, তা-ই বলে ফেলেছেন! তবে উনি কয়েক জনের নাম করেছেন। ওই রকম অনুব্রত, মনিরুল প্রতি জেলায় আছে। রাজ্য প্রশাসনেও ওদের হয়ে কাজ করার লোক আছে।’’ আর বিজেপি-র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের তির্যক মন্তব্য, ‘‘কিছু দিন আগে রেজ্জাক তৃণমূলের
মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পুরনো ব্যথা বোধহয় হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছে!’’